২০১০ সালের ২৮শে জুলাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি এবং নিরাপদ স্যানিটেশনকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করে। একইসাথে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক কমিটি অধিকারের ৪টি মৌলিক বিষয়কে সামনে রেখে বিশেষ কোন বৈষম্য ছাড়াই এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি দেশ কিভাবে সর্বজনীন নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের সুবিধা দিতে পারে ব্যাপারে একটি দিক নির্দেশনামূলক ধারণা দেয়। জাতিসংঘের পানি ও স্যানিটেশনের অধিকার বিষয়ক বিশেষ বার্তাবাহক প্রাপ্যতা, প্রবেশগম্যতা, সামর্থকতা ও গুণগত মান অধিকারের এই চারটি স্তম্ভ নিশ্চিত হলে পানি ও স্যানিটেশনের মানবাধিকার নিশ্চিত হবে বলে বিভিন্ন মাধ্যম্ে উল্লেখ করেন। তবে এই চার স্তম্ভ পানির ক্ষেত্রেই হোক, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেই হোক কিংবা শিক্ষার ক্ষেত্রেই হোক একই। অধিকারের এই চার স্তম্ভ মাথাপিছু মাসিক আয়-ব্যয় ও ভোগ-ব্যয়ের সাথে জড়িত। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২ অনুযায়ী মাসিক মাথাপিছু জাতীয় আয় ২২,০৬৭ টাকা। যেখানে মাসিক ভোগ-ব্যয় জিডিপির ৭৮.৪৪%(১৬৭৩০ টাকা)। এই ভোগ-ব্যয়ের মধ্যে যদি মাথাপিছু পানি স্যনিটেশনের ভোগ-ব্যয় পর্যাপ্ত না হয় তাহলে টেকশই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জন সম্ভব না।
সুপেয় পানি ও ভালো স্যনিটেশন ব্যবস্থা প্রাপ্তি সকলের অধিকার হলেও বিষয়টি সহজবোধ্য করে সকলের কাছে এখনও না পৌঁছানোর কারণে এই বিষয়ে জনগণের আস্থা অর্জনে সময় লাগছে। অন্যদিকে পানি ও স্যনিটেশনকে জনগুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে পর্যাপ্ত আলাপ-আলোচনার জায়গায়, বিশেষ করে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সময় লাগছে বলেও ধারণা করা হয়।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমরা সত্তর দশক থেকেই উন্নয়ন ধারায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এছাড়া নারীরাই প্রধানত পারিবারিক ব্যবহারে পানি সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করে এবং দিনের একটি অংশ পানি সংগ্রহে ব্যয় করে। সুপেয় বা নিরাপদ পানি প্রাপ্যতা এখনও দেশের কোথাও কোথাও মরীচিকা। সম্প্রতি সুইডেনের স্টকহোম বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষণায় জানা যায়, বৃষ্টির পানিও এখন পানের জন্য নিরাপদ নয়। বৃষ্টির পানিতে সহনীয় মাত্রার বেশী কেমিক্যাল পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা ও ইউনিসেফ(২০২১) পরিচালিত জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম(জেএমপি) সূত্র মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৯ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি প্রাপ্যতার সুবিধার আওতায় আছে এবং নিরাপদ স্যনিটেশন সুবিধার আওতায় আছে ৩৯ শতাংশ মানুষ। এ পরিস্থিতিতে টেকশই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা ২০৩০ অর্জনে সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও টেকসই স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা বেশ কষ্টসাধ্য। আর ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও টেকসই স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য এ খাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ হওয়া ও তা শুদ্ধাচার মেনে বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন। এবারের বাজেট ২০২২-২৩ তে সামগ্রিক বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী(্এনুয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম-এডিপি) ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধির তুলনায় ওয়াশ এর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রস্তাবিত এঅই বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাজেটে মোট ওয়াশ বাজেট হলো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বরাদ্দের ২৪৬০৬৬.০৯ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ১১,৮২০ কোটি টাকা।
খানা আয় ও ব্যয় জরীপ ২০১৬ অনুযায়ী ২০০৫ সালে দারিদ্র্যে হার ছিল ৪০ শতাংশ। ২০১৬ সালে হ্রাস পেয়ে তা ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে। সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশে দাড়িয়েছে। যদিও ২০২০ সালের করোনার আঘাতের পর বিভিন্ন বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এরও বেশী। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সাড়ে ১৬ কোটির ২০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ দায়িত্বসীমার নীচে। আমরা বুঝতেই পারি এই জনগোষ্ঠীর জীবনমান পরিচালনার তালিকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন নাই। এই জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে পানি ও স্যানিটেশনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তা না হলে জাতিসংঘের ঘোষণা এবং পরবর্তীতে মানবাধিকার আইনের স্বীকৃতি কাগজেই থেকে যাবে।
সরকার দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ও এতিমদের কল্যাণে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। স্থানিক বৈষম্য চিহ্নিত করে এবারের বাজেটে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে; তবে, কিছু খাতে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। সর্বজনীন পানি ও স্যনিটেশন- সেবার মূল ধারনা হচ্ছে- যারা পানি ও স্যনিটেশন সেবা থেকে বঞ্চিত তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং সকলকে সেবার আওতায় আনা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে হাওর ও পার্বত্য এলাকায় বাজেট বরাদ্দ বেশ ইতিবাচক। তবে, চর এবং উপকূলীয় এলাকায় বরাদ্দ বাড়েনি। দূরবর্তী অঞ্চলের প্রান্তিক কমিউনিটির মানুষের জন্য আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় বর্তমান বাজেটে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা অপ্রতুল।
ওয়াশাগুলোর মধ্যকার বরাদ্দে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে যেমন ঢাকা ্ওয়াশার বরাদ্দ কমেছে এবং চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে বেড়েছে, কিন্তু খুলনা ওয়াশায় বরাদ্দ আগের মতোই কম। তবে, চারটি ওয়াশায় ওয়াশ এর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর বরাদ্দ ২০২১-২২ অর্থবছরের ৩৬ শতাংশ থেকে ২০২২-২৩ এ ৩০ শতাংশ কমেছে। শহরাঞ্চলের মধ্যে বাজেট বরাদ্দের বৈষম্য এখনো বিরাজমান রয়েছে। বরাবরই ওয়াশ এর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে শহর এলাকা বরাদ্দের একটা বড় অংশ পেয়ে আসছে। কিন্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্রামের জন্য বরাদ্দ ২০২১-২২ অর্থবছরের বরাদ্দ ২২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। ওয়াশ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে স্থানিক বৈষম্য দূরীকরণে বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক বণ্টন নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এফএসএম খাতের বরাদ্দ হ্রাসের বিষয়টি দেশজুড়ে স্যানিটেশন কাভারেজ বৃদ্ধির বিষয়টিকে বাধাগ্রস্ত করবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় প্রকল্পগুলো নির্বাচনের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে মনোযোগী হওয়া এবং গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ কে সর্বজনীন পানি ও স্যনিটেশন-সেবার আওতায় আনার জন্য এ খাতের বরাদ্দের ব্যবধান ঘোচানো দরকার। শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যকার বাজেট বরাদ্দ বৈষম্য দূর করতে হবে। ন্যায্যতাভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ হলেই অধিকার বাস্তবায়ন সম্ভব। লেখক: গবেষণা পরিচালক, ডরপ্।