বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থাকাকালে ১৯৭৭ সালে সামরিক আদালতের বিচারকে ‘প্রহসনমূলক হত্যাকাণ্ড’ উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘কমিশন গঠন করে এই হত্যার বিচার করতে হবে।’ গতকাল মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) দুপুরে আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে ‘১৯৭৭ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গুম ও খুনের বিচার চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
গণমানুষের প্রয়োজনে আইনের ব্যত্যয় ঘটে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘বিচারপতি (শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক) বলে গেলেন, মৃত ব্যক্তির বিচার হয় না। তবে গণদাবিতে অনেক কিছুই হয়। আইনের বাইরেও অনেক কিছু করতে হয়। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি, সেটা তো আইন মেনে করিনি। গণমানুষের প্রয়োজনে আইনের ব্যত্যয়ও ঘটে। পৃথিবীতে মরণোত্তর বিচারের নজির আছে, বহু দেশে মরণোত্তর বিচার হয়েছে। সাজা না পেলেও ইতিহাসে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে অনেকেই। খুনি জিয়া ও তার সহযোগীদের মরণোত্তর বিচার হোক। এটা করা কোনও বেআইনি কাজ হবে না। কী ঘটেছে– সেটার সত্য উদঘাটন করাও আইনের দায়িত্ব। সেই দায়িত্বববোধ থেকে জিয়ার মরণোত্তর বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয় ও জরুরি। কমিশন গঠন করে এই হত্যার বিচার করতে হবে। ১৯৭৫-এর হত্যাকা-ের পেছনে যারা ছিল তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’ আলোচনা সভায় অংশ নেওয়া অন্য বক্তাদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি আপনাদের বক্তব্যের নোট নিয়েছি। আগামীকাল সংসদে আপনাদের কথাগুলো জাতির সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।’
মোজ্জাম্মেল হক আরও বলেন, ‘নাটক কিংবা সিনেমায় দেখা যায়, কিছু সময়ের জন্য খলনায়ক মহানায়কের চরিত্রে চলে আসে। শেষ মুহূর্তে ভিলেন তার জায়গায় চলে যায়। আর নায়ক নায়কের জায়গায় আসে। ১৯৭৫ সালে খলনায়ক জিয়া মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে মনে করেছিল, বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা এ দেশে থাকবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এক ও অভিন্ন। তারা মনে করেছিল, ব্যক্তি মুজিবকে হত্যা করলেই মুজিবের আদর্শকে হত্যা করা যাবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পেরোনোর পরে সারাবিশ্ব জানে জীবিত বঙ্গবন্ধুর থেকে মৃত বঙ্গবন্ধু অনেক শক্তিশালী। তিনি মরেও অমর হয়ে আছেন।’ জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে মেরেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশে নজির রয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা অপরাধ করলে তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়। কিন্তু খুনি জিয়া আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা কারণে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে মেরেছে। কিছু দিন আগে ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। তারপর আমি তদন্ত করে দেখি, আদেশ হওয়ার তিন মাস আগেই অনেকের ফাঁসি হয়েছে।’ এ সময় তিনি ভুক্তভোগীদের পক্ষে উত্থাপিত সাত দফা দাবির প্রতি সমর্থন জানান। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, ‘আজ একটি নারকীয় দিবস। এ রকম নারকীয় দিবস আমাদের দেশে অনেক হয়েছে, যার শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে। সেদিন আমাদের জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হয়েছিল। এ রকমই আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৭ সালে। এসব কিছুর মূল নেতৃত্বে ছিল খুনি জিয়াউর রহমান। তার মতো একজন হৃদয়হীন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমি মনে করি, বিগত সময়ে যদি কাউকে তৈমুর লঙ, চেঙ্গিস খান, নাদির শাহ উপাধি দিতে হয়, তাহলে জিয়াকে দিতে হবে।’
বিভিন্ন দলিলপত্রের তথ্য অনুযায়ী প্রমাণ পাওয়া যায় যুদ্ধকালীন সময়ে জিয়াউর রহমান পাকিস্তানিদের গুপ্তচর ছিল– এমন দাবি করে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা তাকে গুপ্তচর হিসেবে পশ্চিম বাঙলায় পাঠিয়েছিল। পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে তার বন্দুক থেকে একটি গুলিও ফোটেনি। আমরা অনেক দলিলপত্র পাচ্ছি, সেখানে প্রমাণিত হয়– সে পাকিস্তানিদের চর ছিল। ১৯৭৭ সালে জাপানি বিমান গুম করাকে কেন্দ্র করে জিয়া অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। বিচারের নামে এই প্রহসনের হত্যাকা-ের মাধ্যমে জিয়া নিজেকে ইতিহাসের ধিকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।’ এ সময় তিনি উত্থাপিত সাত দফা দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন।
সভাপতির বক্তব্যে ১৯৭৭ সালের সামরিক আদালতের বিচারের ভুক্তভোগী সার্জেন্ট আবুল বাসার খানের মেয়ে বিলকিস বেগম বলেন, ‘বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর কেউ আমাদের কোনও খোঁজ রাখেনি। আজও আমার মাকে হাসপাতালে রেখে আসতে গিয়ে এখানে আসতে আমার দেরি হয়েছে। চার বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে কেঁদে কেঁদে সময় পার করেছি। জানি না, কোথায় বাবার কবর হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে আবেদন, তিনি যেন ১৯৭৭ সালের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার করেন। এতোটা সময় পার করেছি, কেউ আমাদের দিকে ফিরে তাকাইনি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমার মায়ের দাবি, খুনিদের বিচার হোক। সবাই যেন জানে, আমার বাবা নির্দোষ ছিলেন।’ সভায় ১৯৭৭ সালের ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বজনদের পক্ষে সাত দফা দাবি পেশ করা হয়। দাবিগুলো হলো: ১৯৭৭ সালের অক্টোবর সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্য– যারা জিয়াউর রহমানের সামরিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অন্যায়ভাবে ফাঁসি-কারাদণ্ড ও চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন তাদের নির্দোষ ঘোষণা করা, তাদের প্রত্যেককে স্ব-স্ব পদে সর্বোচ্চ পদোন্নতি দেখিয়ে বর্তমান স্কেলে বেতন-ভাতা ও পেনশনসহ সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ হিসেবে ঘোষণা করা এবং কবরস্থান চিহ্নিত করে কবরস্থানে নামসহ স্মৃতি তৈরি করা, সামরিক ষড়যন্ত্রের শিকার সেসব সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের পূর্নবাসিত করার লক্ষ্যে তাদের পোষ্যদের যোগ্যতা অনুসারে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া, সেনা ও বিমান বাহিনীর সেসব সদস্যের তালিকা প্রকাশ করা, অন্যায়ভাবে ফাঁসি, কারাদ- ও চাকরিচ্যুত করার অপরাধে খুনি জিয়ার মরণোত্তর বিচার হওয়া, জিয়াউর রহমানের তথাকথিত কবর জাতীয় সংসদ এলাকা থেকে অপসারণ করা।