বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি মূল্যবোধের আদর্শকে ভিত্তি করে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম হয় বিএনপির। জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলটি তখন দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। সেই দলটি আজ বৃহস্পতিবার (১ সেপ্টেম্বর) ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে যাচ্ছে। কয়েক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতাবলয়ের বাইরে। এই দলটিই এখন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণে টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে। তারা ঘুরে দাঁড়াতে ব্যস্ত সময় পার করছে।
চার দশক ধরে নানা চড়াই-উতরাই পার করে চলছে বিএনপি। এখন দলটির কাছে অন্যতম অগ্রাধিকার ইস্যু হচ্ছে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন। বিএনপির নেতারা প্রায়ই অভিযোগ করেন, বর্তমান সরকারের আমলে তাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের প্রায় ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, ৬০০ নেতাকর্মী নিখোঁজ হয়েছেন। প্রায় সহস্রাধিক নেতাকর্মীর নিহত হওয়ার অভিযোগও করেন তারা।
এসব অভিযোগ করে আসা দলটি ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর ছয় বছর পার করলেও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর বিরতিতে আর কোনো কাউন্সিলের উদ্যোগ নিতে পারিনি। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তিত না হলেও ঢাকা ও বিভিন্ন মহানগরসহ জেলা কমিটিতে নির্বাচন হচ্ছে। এতে দলে প্রাণ ফিরছে বলে দাবি করেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবির রিজভী। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, ‘আন্দোলন-সংগ্রামে যারা মাঠে আছে, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতে তাদের সমন্বয় করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি মনে করেন, ‘এতে দল প্রাণশক্তি ফিরে পাবে। সাম্প্রতিক সময়ে দলের যেসব কর্মসূচি পালিত হচ্ছে, তাতে নেতাকর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এই সিদ্ধান্তেরই ফল।’
ক্ষমতার পক্ষপুটে জন্ম হওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়লেও প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে এর প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিহত হলে সেদিনকার গৃহবধূ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নয় বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে ফের ক্ষমতায় আসে বিএনপি।
মাগুরা-২ আসনের বহুল বিতর্কিত উপনির্বাচনের পর যখন তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জনপ্রিয়তা পায়, তখন এককভাবে ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে বিএনপি; যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিল পাস হয়। এরপরই বাংলাদেশের ইতিহাসে সাংবিধানিকভাবে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একই বছরের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করলে ১১৬টি আসন পেয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে দলটি।
২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ‘নিশি রাতের’ নির্বাচন বলে অভিহিত করে। আগামী বছর ২০২৩ সালের নির্বাচনের শিডিউল রয়েছে। এরই মধ্যে এই প্রথমবার আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন করা হয়েছে। তবে বিএনপি দাবি তুলেছে, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচনে ইভিএমে ভোট নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত ইসি নিয়েছে, তাও নাকচ করে দিয়েছে দলটি।
এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি গত ২২ আগস্ট থেকে মহানগর ও জেলা শহরগুলোতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে আসছে। এ কর্মসূচি চলবে আগামী ১০ সেপ্টম্বর পর্যন্ত। এর পরই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। অন্যদিকে সরকারের বিরুদ্ধে অভিন্ন দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করতে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে সংলাপও করছে দলটি। এ অবস্থায় বিএনপি তার ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনে দুদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন, একই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে তিনি একটি নতুন দল গঠন করেন। সেই দলটি ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। এই দল জন্ম নিয়েছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে। দলটি প্রতিষ্ঠা করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের মানুষের সামনে নতুন আশার আলো জাগিয়ে তুলেছিলেন। আমরা দেখেছি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এখানে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির প্রতিষ্ঠবার্ষিকী অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। কারণ, বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতাকে রক্ষা করা, গণতন্ত্রকে রক্ষা করা, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি অর্জন–এসব বিএনপির মাধ্যমেই শুরু হয়। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এসবের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন। দেশনেত্রী খালেদা জিয়া এগুলোকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এখন সেই পতাকা ধারণ করে আছেন আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।’
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুই দিনের কর্মসূচি : আজ ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির ৪৪তম প্রতিষ্ঠবার্ষিকী উপলক্ষে দুই দিনের কর্মসূচি পালন করা হবে।
দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, আজ ১ সেপ্টেম্বর বিকালে রাজধানীতে বর্ণাঢ্য র্যালি রয়েছে। এদিন বেলা ১২টায় দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
এর আগে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে দলীয় কার্যালয়ে ভোর ৬টায় দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে।
তিনি জানান, ২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিএনপির উদ্যোগে আলোচনা সভা হবে। এতে দলটির জাতীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারাসহ দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন। অনুরূপভাবে দলটির জেলা ও মহানগরসহ সব ইউনিট তাদের সুবিধা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি গ্রহণ করবে বলেও জানান তিনি। দিবসটি উপলক্ষে এরই মধ্যে পোস্টার প্রকাশিত হয়েছে এবং ক্রোড়পত্রও প্রকাশিত হবে।