গত ৭ সেপ্টেম্বর ছিল ডিএনএমসি হাঁটা দিবস। ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের উদ্যোগে ২০১৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর যাত্রারম্ভ হয় এই দিবসটির। জনগণের মধ্যে হাঁটার হিতকর প্রভাবের গুরুত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে দিবসটি সূচনার পরিকল্পনা করেন অত্র বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. নওশের আজিমুল হক। পরবর্তীসময়ে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান উপাধ্যক্ষ সহযোগী অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল ও মেডিসিন বিভাগের আরপি ডা. মাকসুদুল আলমের সহযোগিতায় সব শ্রেণির শিক্ষক, চিকিৎসক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ র?্যালি ও সেমিনারের মাধ্যমে অতি উৎসাহ সহকারে দিবসটি উদযাপন করে থাকেন। সাংবাদিক বন্ধুগণও অনুষ্ঠানমালায় উপস্থিত হয়ে দিবসটির তাৎপর্য প্রচার করেন স্ব স্ব মিডিয়ায়। এটি জাতীয় দিবসে রূপান্তরিত হোক।
চিকিৎসা বিজ্ঞান যত উন্নত হচ্ছে, মানবদেহে রোগও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। নানাবিধ রোগের মধ্যে বর্তমান সময়ে অসংক্রামক ব্যাধির কথা না বললেই নয়। কারণ এ ধরনের অসুখ শুধু যে দৈহিক বিভিন্ন রকমের পীড়ার মাধ্যমে মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় তাই নয়, বরং এগুলোর কারণে পারিবারিক ও রাষ্ট্রের ওপর বৃদ্ধি পায় অর্থনৈতিক চাপ। চাকরি কিংবা ব্যবসায় শারীরিক সক্রিয়তা খর্ব হওয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিগণ কষ্ট পান বিভিন্ন মানসিক যন্ত্রণায়। অসংক্রামক রোগের মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো : ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, মাত্রাতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা, পলিসিস্টিক ওভারি সিলড্রোম (পিসিওএস), বন্ধ্যাত্ব, বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার, ফুসফুসের সমস্যা ইত্যাদি। বর্তমান ডিজিটাল বিশ্বে আমাদের জীবনযাপন প্রণালির গুণমানের ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ায় এসব রোগ পুরোপুরি প্রতিরোধের সুযোগ এখন হয়তো আর নেই। তবে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অসংক্রামক ব্যাধির কতিপয় জটিলতা নিবারণ অনেকাংশে সম্ভব। তাই ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা’ এখন সর্বজনের সময়ের দাবি। শৈশব থেকেই চাই স্বাস্থ্যশিক্ষা। স্বাস্থ্যের মৌলিক কিছু জ্ঞানার্জন করতেই হবে সব বয়সি নারী-পুরুষদের। স্বাস্থ্যশিক্ষার মধ্যে দুটি বিষয় অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এক. সুষম খাদ্য খাওয়া, দুই. নিয়মিত ব্যায়াম চর্চা। শারীরিক কসরতের মধ্যে ‘একটু দ্রুত হাঁটা’ অসাধারণ একটি ব্যায়াম। হাঁটার নানা প্রকারের উপকারিতার মধ্যে লক্ষণীয় হচ্ছে :এক. ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বৃদ্ধি পাওয়া অর্থাৎ দেহে ইনসুলিনের কাজ যথাযথ হয়, যার ফলে শরীরের পেশিগুলো তাদের শক্তির জন্য প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ রক্ত থেকে সংগ্রহ করতে পারে; দুই. কোষসমূহে শ্বসন অঙ্গাণু অর্থাৎ মাইটোকন্ড্রিয়াগুলোর সংখ্যা বেড়ে যায়, যেগুলো হলো জীবকোষের শক্তি উৎপাদক কেন্দ্র; তিন. রক্ত সংবহনের মাধ্যমে দেহের কোষগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ ভালো হয়, যার দরুন উন্নত হয় শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা এবং বেড়ে যায় স্মৃতিশক্তি; চার. রক্তের ভালো কোলেস্টেরল এইচডিএল বৃদ্ধি ও খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএল হ্রাসের মাধ্যমে সুস্থ থাকে হৃদপি-; পাঁচ. ফুসফুসের সক্ষমতা বেশ উন্নত হয়ে সহজেই সামলানো যায় শ্বাসকষ্ট। সর্বোপরি, যে কোনো রোগাক্রান্তের সময় শরীর অনায়াসেই সহনশীলতা অর্জন করতে সমর্থ হয়।
যেসব রোগে হাঁটা অতি জরুরি : ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, দৈহিক বাড়তি ওজন বা স্থূলতা, ফ্যাটি লিভার, রক্তে চর্বি বাড়লে, বাতব্যথা হলে, গর্ভধারণে সমস্যা, অনিয়মিত মাসিকে, আর বয়স্ক নারীর মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে। একনজরে হাঁটার বিধিবিধান :আরামদায়ক পোশাক ও জুতা পায়ে দিয়ে নিজ নিজ পেশার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটা যায় দিনের যে কোনো সময়। সকাল-বিকেল নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে সকালে হাঁটার সুবিধা হলো এ সময় বাতাস নির্মল থাকে, প্রকৃতি থাকে শান্ত। প্রতি দিন সম্ভব না হলে সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন অন্তত ৩০ মিনিট করে হেঁটে সুস্থ থাকা যায়। একবারে ৩০ মিনিট হাঁটতে না পারলে তিন বারে ১০ মিনিট করে অথবা একবারে ১০ মিনিট আরেক বার ২০ মিনিট হাঁটা যেতে পারে। তবে হাঁটা চাই একটু দ্রুত গতিতে। মনে রাখুন, শুরুতে কিন্তু দ্রুত ও বেশি হাঁটা যাবে না। যেমন প্রথম সপ্তহে ১০ মিনিট, দ্বিতীয় সপ্তহে ২০ মিনিট, এভাবে ধীরে ধীরে হাঁটার সময় ও গতি বাড়াতে হয়। খাবার ঠিক আগে কিংবা খাওয়া শেষ করেই, এমন কি অতিরিক্ত রোদে হাঁটতে নেই। হাঁটা ভালো পার্ক কিংবা খোলামেলা গাছপালাযুক্ত স্থানে। সকালে ঘুম হতে জেগেই হাঁটাতে না বেরিয়ে বরং ১০-১৫ মিনিট পরে হাঁটতে বের হোন। আরেকটি জরুরি কথা হলো, শীতকালে বাতাসে অধিক ঠান্ডা ভাব থাকলে বেশি সকালে হাঁটার প্রয়োজন নেই। পাশাপাশি হাঁটতে গিয়ে কোনোরকম অস্বস্তিবোধ হলে তখনো না হেঁটে বিশ্রাম নেওয়া ভালো। হাঁটার বিকল্প কী? না, হাঁটার কোনো বিকল্প নেই। মন না চাইলে জোর করে হলেও হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। সুস্থতার জন্য হাঁটা চাই চাই। হাঁটা একটি অভ্যাসগত বিষয়। হাঁটার জন্য মনকে উৎসাহিত করতে হয়। প্রথম প্রথম সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেহে অলসভাব জাগবে। তবে একটু কষ্ট করে ভোরে জেগে যদি দুই-তিন সপ্তাহ হাঁটা যায় তাহলে দেখা যায়, এটি এক ধরনের নেশায় পরিণত হয়ে যায়। তখন না হাঁটলেই যেন ভালো লাগে না। সত্যি বলতে কিÍআহার, নিদ্রা ও প্রাত্যহিক জৈবিক কাজ সাধনের মতো প্রয়োজনীয় কর্মের চেয়েও জীবনের জন্য হাঁটার প্রয়োজনীয়তা অধিক এমনটি ভাবতেই হবে। হাঁটা এমন একটি মহৎ কাজ, যার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির কাছে যেতে পারি। অব্যাহত নগরায়ণের প্রভাবে বর্তমান প্রজন্ম শারীরিকভাবেই যে অসুস্থ হচ্ছে তা নয়, বরং তাদের মধ্যে থেকে ধাপে ধাপে হারিয়ে যাচ্ছে মনের সুকোমল বৃত্তিগুলো, বাড়ছে মানসিক রোগ। ফুলের মনোমুগ্ধকর সৌরভ, পাখিদের সুমধুর গুঞ্জনসহ প্রাকৃতিক নানা সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে তারা আজ বঞ্চিত। পরিণামে আসক্ত হচ্ছে তারা বিভিন্ন মাদক দ্রব্যে। লোপ পাচ্ছে মনুষ্যত্ববোধ। তাইতো পিতামাতা, শিক্ষক, ধর্মীয় গুরু, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সবাইকে এ বিষয় নিয়ে অতি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতেই হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে হাঁটার সাতকাহন অন্তর্ভুক্ত করতেই হবে। রোগ হলেই যে হাঁটতে হবে তা নয়, রোগ প্রতিরোধেও যে হাঁটার মূল্য অনেক, এটা সবাইকে জানাতে হবে। শারীরিক ও মানসিক বিকাশে শিশুদের জন্য হাঁটা যেমন অপরিহার্য, বয়সজনিত বহুবিধ ব্যাধি নিরোধেও হাঁটা অত্যাবশ্যক। লবণ না থাকলে রান্নাকৃত খাবার যেমন মূল্যহীন, পানি বিনা বেঁচে থাকা যেমন সম্ভব নয়, নিশ্বাসের মাধ্যমে বায়ু হতে যেমন অক্সিজেন সংগ্রহ করতেই হয়, হাঁটার বিষয়টি ঠিক তেমনি। হাঁটাকে বাদ দিয়ে শরীরের কোনো দেহযন্ত্রই ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। আর তাই ‘জীবনের জন্য হাঁটা’Íএটাই এবারকার হাঁটা দিবসের স্লোগান। এই স্লোগান সার্থক হোক। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল