মৃত্যু জীবনটা যে কী তা ভাবতে গেলেই খেই হারিয়ে ফেলি। সৃষ্টি এক আজব রহস্য। বিশ্বব্রহ্মা- সৃষ্টি, প্রাণের সৃষ্টি-তারপর মৃত্যু, সবকিছুর বিদায়-এসব কী এক খেলা! আল্লাহ, খোদা, ঈশ্বর, ভগবান, সৃষ্টিকর্তা, প্রভু-যে নামেই হোক, তিনি কে, তার এত ক্ষমতা কীভাবে হলো? উত্তর পাওয়া যায়? এক পর্যায়ে থেমে যেতে হয়-ঘড়ি তার মেকার সম্পর্কে কতটুকুই আর ভাবতে পারে? অতএব কূলকিনারা নেই, খেই তো হারাতেই হবে। আমার ঘাস-তোলার সাথী আদরই দেখি সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটল থেকে বড় প-িত। একদিন সে বলল, আল্লাহর বুদ্ধি ইংরেজ থেকেও বেশি।
আমি তো হতবাক, আদর বলে কী! সে ব্যাখ্যা করে-ইংরেজ রেলগাড়ি বানিয়েছে, একটা মালগাড়ি ৫০-৫২ বগি নিয়ে সমান্তরাল দুটি লাইনে কীভাবে যে চলে, একটুও কাত হয় না, পড়ে না-এটা কী আজব নয়? অতএব ইংরেজের বুদ্ধি বেশি। পরে সে দেখল, আল্লাহর বুদ্ধি আরও বেশি, আল্লাহ মানুষ বানাল কীভাবে? বিয়ের পরে সে আরও তাজ্জব হলো-একটা মেয়ে মানুষের থেকে আরেকটা মানুষ পয়দা হয়ে যাচ্ছে-কী এক মহাকা- না? অতএব আল্লাহর বুদ্ধি ইংরেজ থেকে বেশি। আমি হাঁ করে তার দিকে চেয়ে থাকি, আমিও তো কখনো এভাবে ভাবতে পারিনি!
প্রকৃতই স্রষ্টার বুদ্ধি বেশি। কিন্তু মৃত্যু কেন দিল আবার? না, তা-ও বুদ্ধির ব্যাপার-মরতে না দিলে জায়গা হতো কোথায়? আর চিরযৌবন ছাড়া চিরজীবনের তো কোনো মূল্যই নেই। তাই তো টেনিশনের টিথোনাস চিরযৌবন ছাড়া চিরজীবন চেয়ে পরে আবার মৃত্যু মাগে। আমি বলি, শক্তি-সামর্থ্য থাকতেই মরে যেতে পারলে ভালো, কষ্ট পেয়ে মৃত্যুবরণ বড় কষ্টকর। আদম (আ.) থেকে এ যাবত কত মানুষ এলো, কত মানুষ চলে গেল; আরও কত আসবে, কত যাবে কেয়ামত পর্যন্ত তার হদিস কে করতে পারবে? অথচ এর মাঝে ক্ষুদ্র জীবনে কত মানুষ কত কিছু করে-যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। মৃত্যু অবধারিত জেনেও যেন ভুলে যাই আমরা, আরও চাই আরও চাই, কেবল খাই-খাই ভাব আমাদের। কিন্তু কতটুকু খেতে পারি? এক সময়ে অন্যের খাওয়াটা দেখার মধ্যেই যেন আনন্দ, নিজে তো আর খেতে পারি না। যৌবন শেষ তো সব যেন পানশে, কিন্তু চাওয়ার তো শেষ নেই। পদ চাই, পদোন্নতি চাই; ক্ষমতা চাই, চেয়ার চাই সচিব হব, নেতা হব, এমপি হব, মন্ত্রী হব, প্রধানমন্ত্রী হব, রাষ্ট্রপতি হব, বিশ্বনেতা হব; সাংবাদিক হব, সম্পাদক হব, পত্রিকা-টেলিভিশনের মালিক হব; দোকানদার হব, ব্যবসায়ী হব, শিল্পপতি হব; শিক্ষক হব, প্রধান শিক্ষক হব, অধ্যক্ষ হব, ভাইস-চ্যান্সেলর; শিক্ষক নেতা হব, নীল দল হব, সাদা দল হব; গায়ক-গায়িকা হব, নায়ক-নায়িকা হব, সুরকার হব, সঙ্গীতজ্ঞ হব; প্রকৃতির নিয়মে বাবা হব, মা হব, দাদা হব, দাদি হব-প্রজন্মের পর প্রজন্মে কেবল হতেই থাকব। হতেই থাকব…। কিন্তু বড় আফসোস, যেতে হবে যে! না গিয়ে যে উপায় নেই।
আমি ভোরে আজানের আগে জেগে যাই। নামাজ-কুরআন শরিফ পড়ে পাখির খাবার দেই। ওরা আসে, খায়, আবার চলে যায়। বারান্দার দরজা খোলার পরই শুরু করে কিচির-মিচির-বুঝে এখন খাবার দেব। কত প্রাণীর সৃষ্টি-আবার তাদের খাবারের কী কী এক সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা-সৃষ্টির মহারহস্য এখানেই। আগে যাদবের পাটিগণিত দেখে বিস্মিত হতাম-কীভাবে হিসাব বের করল? পিথাগোরাস নিয়ে তো আরও অবাক! এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানের মহাহিসাবে আর কূলকিনারা করতে পারি না। বলে কী? এমনও নক্ষত্র রয়েছে নাকি যার আলো এখনো পৃথিবীতে পৌঁছেনি। ওসব নক্ষত্র নাকি কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে! একটু গুণ করে দেখলে কি তা ক্যালকুলেটর মিলাতে পারবে-এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল ী৬০ী৬০ী২৪ী৩৬৫=এক আলোকবর্ষের দূরত্ব। এবার তাকে গুণ করতে হবে কোটি কোটি দিয়ে-মাথায় ধরে? কুরআনের অমোঘ বাণী-হে জিন এবং মানুষ পারলে যাও তো আকাশম-লী ও পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে, কিন্তু তোমরা তা পারবে না, শক্তি ব্যতিরেকে (সূরা আর রাহমান, আয়াত-৩৩)। মানুষ কি আল্লাহ প্রদত্ত এ শক্তি বলেই চাঁদে গেল, মঙ্গলে যাচ্ছে-বিজ্ঞান আরও কতদূর নিয়ে যাবে তা কি এখন বোঝা যাবে? বিদ্যুৎ একটা শক্তি আর রুহ একটা হুকুম-কী অবাক কা- না? এই আমি জীবিত আবার এই আমি মৃত-হুকুমটা চলে গেল; বিদ্যুৎটা চলে গেল, বাতিটা নিভে গেল, পাখাটা বন্ধ হয়ে গেল। সারা বিশ্বে যদি এক মাস বিদ্যুৎ না থাকে, তাহলে বিশ্বের মানুষের অবস্থাটা কী হবে-ভাবা যায়! কুন-পাইয়াকুনের মালিকের এসব কা-ের শেষ কোথায়?
আগে মৃত্যু নিয়ে তেমন ভাবতাম না। এখনো ভাবি না-তবে অনেক অনেক চেনাজানা জীবিত মানুষকে মাটি দিয়ে, তাদের জানাজা পড়ে এখন মাঝে মধ্যে একটু-আধটু আগ্রহ হয় ভাবতে-আমি কবে মরব, কীভাবে মরব-আরামে না কষ্টে, স্বাভাবিকভাবে না অস্বাভাবিক। মানুষের কষ্ট দেখতে হাসপাতালে যাই, সুযোগ পেলেই কবরস্থানে যাই, চেনাজানা অনেক অনেক মানুষের কবর দেখতে। নিজেদের পারিবারিক কবরস্থান আর পাশের মাঝি বাড়ির কবরস্থানে গেলে মনে পড়ে যায়-এখানে আমার দেখা কত কত মানুষ রয়েছেন। দাদা-দাদি শ্রেণির থেকে শুরু করে কত মানুষ চলে গেল। আমার থেকে বয়সে ছোট আমাদের বাড়িরও কতজন মরে গেল, কতজনের জানাজায় শরিক হলাম, কতজনকে মাটি দিলাম। নিজের দাদা-দাদি, মা-বাবা, চাচা-চাচি, ভাইবোন, মামা-মামি, ফুপা-ফুপু, বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী-কত কত মানুষ চলে গেল!
জীবিত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে আমার যত ভালো লাগে, তার চেয়ে বেশি ভালো লাগে মৃত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে, আরও ভালো লাগে তাদের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। তখন স্মৃতিগুলো জীবিত হয়, চোখের সামনে ভেসে উঠে, আমি তাদের সঙ্গে কথা বলি, তারা কেমন আছে জানতে চাই, তাদের জন্য দোয়া করি। ১৩ ফেব্রুয়ারি এলেই আমি মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চলে যাই, ২০২১ শুধু যেতে পারিনি। হুমায়ুন ফরীদির মৃত্যু দিবস এই ১৩ ফেব্রুয়ারি। এ বছর, ২০২২-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি গিয়ে দেখলাম কারা যেন ফুল দিয়ে গেল। ২৬ আগস্ট, ২০২২ সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে মাটি দিতে গিয়ে দুপুরের পর মৃতদেহ আসতে বিলম্ব দেখে আবার গেলাম সেখানে। বিশাল কবরস্থানে মসজিদের চারপাশে কত কত কবর, আমার জানাশোনা অনেকেরও। এখানে আছেন বিখ্যাত একান্ত সচিব সফিক উল্ল্যাহ, বন্ধু ফজলে ইলাহীর স্ত্রী, সোবহানবাগের ঘনিষ্ঠ নজরুল হক, তার স্ত্রী এবং ছেলে, আমার নজরুল স্যার, সাববাদ মামা, মামি, আমাদের গ্রামের কাস্টমস সুপার মফিজুল হক, বন্ধু ইস্কান্দারের বড় বোন, দুলাভাই, আমার ছোট ছেলের শ্বশুর, সচিব শাহনাজ আরেফিনের বড় ছেলে, বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাখ্যাত আনোয়ার হোসেন, যার বাড়িতে ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট আমার বিয়ে হয়েছিল, আরও অনেকে। এবার মসজিদের উত্তর পাশেই সমাহিত হলেন মাহবুব তালুকদার। ওপাশে গিয়ে এবার অনেক কবরের/স্মৃতিস্তম্ভের একটি তালিকাও করলাম। হ্যাঁ, তারা জীবিত ছিলেন, এখন নেই। ঢুকতেই প্রথমে রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান (০২.০২.১৯৫৩-২৮.১০.১৯৭১) এবং বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান (২৯.১০.৪১-২০.০৮.৭১), তার স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন হয়েছে ১০.১০.২০০৬। এরপর একে একে দেখে গেলাম-আমার চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষক আলাউদ্দিন আল আজাদ (০৬.০৫.৩২-০৩.০৭.২০০১), মাহবুবে আলম, অ্যাটর্নি জেনারেল (১৭.০২.৪৯-২৭.০৯.২০২০), ড. এআর মল্লিক (৩১.১২.১৮-০৪.০২.১৯৯৭), এম কোরবান আলী (২৮.০১.২৪-২৩.০৭.১৯৯০), এম নূরুল কাদের, সিএসপি (০২.১২.৩৫-১৩.০৯.১৯৯৮), রাহাত খান (০১.০১.৪০-২৮.০৮.২০২০), বজলুর রহমান, সম্পাদক (০৩.০৮.৪১-২৬.০২.২০০৮), গোলাম সারওয়ার, সম্পাদক (০১.০৪.৪৩-১৩.০৮.২০১৮), তাকে প্রথমে মসজিদের উত্তর পাশে কবর দেওয়া হয়েছিল, পরে এ পাশে আনা হয়েছে। তার দাফন নির্ধারিত সময়ের আধা ঘণ্টা আগে হয়ে যাওয়ায় আমি মাটি দিতে পারিনি, ঢাকা-১৪-এর এমপি আসলামুল হকও পারেননি; কেজি মুস্তাফা (০১.১১.২৮-১৩.০৩.২০১০), আমার শিক্ষক খান সারওয়ার মুরশিদ (০১.০৭.১৯২৪-০৮.১২.২০১২) ও তার স্ত্রী বেগম নূরজাহান মুরশিদ (২২.০৫.১৯২৪-০১.০৯.২০০৩), শহিদুল হক মামা (০১.১০.৫৩-৩০.০৬.২০১৭), সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক (২৪.০৬.৩৯-০৩.০২.২০০৮), হুমায়ুন ফরীদি (২৯.০৫.৫২-১৩.০২.২০১২), এমআর আখতার মুকুল (০৯.০৮.২৯-২৬.০৬.২০০৪), আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (১২.১২.৩৪-১৯.০৫.২০২২), স্ত্রীর পাশে; আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল (৩১.১২.৫৬-২২.০১.২০১৯), আতিকুল হক চৌধুরী (১৫.১২.৩১-১৭.০৬.২০১৩), সংগীতগুরু সোহরাব হোসেন (০৯.০৪.২২-২৭.১২.২০১২), পাশে স্ত্রী; ড. আফতাব আহমাদ (১৮.১২.৪৯-২৬.০৯.২০০৬), সা জ ম আকরামুজ্জামান, সাবেক বিভাগীয় কমিশনার সিলেট (৩১.০৩.৪৭-২৩.০৪.২০০০), অভিনেতা ও আবৃত্তিকার গোলাম মুস্তাফা (০২.০৩.৩৫-২০.০২.২০০৩), ভাষাসৈনিক সাইয়িদ আতীকুল্লাহ (০৭.০২.৩৩-১৪.১১.১৯৯৮), শওকত ওসমান (০২.০১.১৭-১৪.০৫.১৯৯৮), স্ত্রী-মেয়েসহ অধ্যাপক কবীর চৌধুরী (০৯.০২.২৩-১৩.১২.২০১১), আবদুল কুদ্দুস মাখন (০১.০৭.৪৭-১০.০২.১৯৯৪), জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক (মৃত্যু ২৮.১১.১৯৯৯), জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমেদ (০৮.০৪.৪২-১৬.০২.১৯৯৯), জাতীয় নেতা মহীউদ্দীন আহমেদ (১৫.০১.২৫-১২.০৪.১৯৯৭), সঙ্গে স্ত্রী; মেজর মোহাম্মদ ওসমান গণী (বিডিআর) (০৩.০৪.৩০-১২.০৬.১৯৯৯), মেজর এমএ জলিল (০৯.০৪.৪২-১৯.১১.১৯৮৯), নুর আলম জিকু (২৬.১০.৩৬-২১.০২.২০১০), মুস্তাফা নূরউল ইসলাম (০১.০৫.২৭-০৯.০৫.২০১৮), সালাম সালাম হাজার সালাম-এর মো. আবদুল জব্বার (১০.০২.৩৮-৩০.০৮.২০১৭), সঙ্গে স্ত্রী হালিমা জব্বার; লাকী আখন্দ (০৭.০৬.৫৬-২১.০৪.২০১৭), শিল্পী কলিম শরাফী (০৮.০৫.২৪-০২.১০.২০১০), কবরটির পাশে একটা আগাছায় নামকরণটি ঢেকে গিয়েছিল, গাছটি ভেঙে দেই; যে ছিল দৃষ্টির সীমানায় এবং সুরস্রষ্টা সম্রাট আলাউদ্দীন আলী (২৪.১২.৫২-০৯.০৮.২০২০), এবং আরও কেউ কেউ। বড় বিস্ময়ে কবরের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। তাদের কে না চেনে? কিন্তু চলে যেতে হয়েছে, অথচ নিজকর্মে তারা অমর। আমিও তাদের অনেককে ব্যক্তিগতভাবে, কাউকে কাউকে তাদের কর্মে চিনি, জানি ও শ্রদ্ধা করি।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অফিসে এক কাজে এলে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার আমার সৌভাগ্য হয়। আলাউদ্দিন আল আজাদ তো চট্টগ্রাম কলেজে আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন, যেমন ছিলেন মমতাজউদ্দিন আহমদ, নাট্যকার। এম কোরবান আলীকে এরশাদের আমলে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবে পেয়েছি। নোটে চমৎকার সিদ্ধান্ত দিতে দেখেছি তাকে, কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে এরশাদের অধীনে আসা আমার অপছন্দীয় ছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর এবং তারও পরে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার দল পরিবর্তন দেখেছি অবশ্য। সম্পাদক বজলুর রহমান তো কর্মেই বিখ্যাত, বীর মুক্তিযোদ্ধাও, মতিয়া চৌধুরীর স্বামীও। সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের মাধ্যমেই আমার যুগান্তরে লেখা শুরু। তখন সোহরাব হাসানও (এখন প্রথম আলোতে) যুগান্তরে ছিলেন, মতিঝিল অফিসে। সারওয়ার সাহেবের মাধ্যমে আমি সমকালেও লেখা শুরু করেছিলাম, যখন তিনি সমকালের সম্পাদক। শহিদুল হক মামার সঙ্গে অনেকবার আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তিনি মামা বাহিনীর প্রধান ছিলেন। হুমায়ুন ফরীদি বড় বন্ধুবৎসল এবং আমুদে ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন এমআর আখতার মুকুলের সে কণ্ঠ কে না জানে? দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আকাশবাণীর খবরপাঠও আমাদের মুগ্ধ করত তখন। ড. আফতাব আহমদকে তো চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ঘনিষ্ঠভাবে জানতাম। চমৎকার বক্তৃতাও করতে পারতেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থাকাকালীন আমার ইআরডির বৈঠকেও আসতেন। তার অবসর সময়ে এলিফ্যান্ট রোডের ২১০ নং টোকিও মোটরসে আমরা প্রায়ই গল্প করতাম। আর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কথা কি আমার যোগ্যতায় বলা যায়? তার তৃতীয় মত পড়তাম নিয়মিত। ২০ মে, ২০২২ শুক্রবার তো পত্রিকায় তারই শিরোনাম-কিংবদন্তির বিদায়, কিংবদন্তির মহাপ্রস্থান ইত্যাদি। যুগান্তরে তার ২০২২-এর ১১ জানুয়ারি, ১৭ জানুয়ারি, ৩১ জানুয়ারি, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ, ২১ মার্চ এবং ২৮ মার্চের লেখাগুলো এখনো মনে পড়ে। আগে, তার আরও কত লেখা পড়লাম। ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি লিখলেন ‘আমি থাকব না গানটি তো থাকবে’, হ্যাঁ, তিনি এ এক গানেই-আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…’ অমর। গত ২৮ মার্চ তার যুগান্তরে শেষ লেখা ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দীন সম্পর্কে কিছু কথা’। তার জানাজায় গেলাম, খাটিয়াতে পা ধরলাম, মাটি দিলাম। ড. এনামুল হকেরও লাশের পা ধরে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। তবে গাফ্ফার চৌধুরী কেন যে জয়নাল হাজারীর সঙ্গে প্রেস ক্লাবে গেলেন তা আজও বুঝলাম না। আরও কত জানাজায় গেলাম-ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. সা’দত হুসাইন, বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, মেয়র আনিসুল হক, নায়করাজ রাজ্জাক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ। গত রোববার চলে গেলেন সংগীত জগতের এক নক্ষত্র গাজী মাজহারুল আনোয়ার। নিজ আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, রাজনৈতিক নেতা এবং সহপাঠী-সহকর্মীদের তালিকা তো অনেক বড়। সত্যটা হলো, তাদের যেতে হলো, আমাদেরও যেতে হবে। কর্ম দিয়ে নন্দিত হব, না নিন্দিত হব-তা-ই বিবেচ্য। ( ( দৈনিক যুগান্তরের সৌজন্যে) লেখক: বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান