রিজার্ভের পরিমাণ কমে এলেও বাংলাদেদশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েই চলছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদেশী উৎস থেকে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ১১৭ কোটি ডলার। চলতি বছরের মার্চ শেষে বিদেশী এ ঋণের পরিমাণ ৯৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৯ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিদেশী এ ঋণ দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২১ শতাংশ। বিপুল অংকের এ ঋণের ৭৩ শতাংশই সরকারের। বাকি ২৭ শতাংশ ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত।
এশিয়ার উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। যেমন চীনের বর্তমান রিজার্ভ ৩ হাজার ১০৪ বিলিয়ন ডলার। গত এক বছরে দেশটির রিজার্ভ ১২৮ বিলিয়ন ডলার কমেছে। তার পরও চীনের রিজার্ভ কমার হার বাংলাদেশের তুলনায় খুবই কম।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত চীনের রিজার্ভ কমেছে ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ। একই সময়ে ভারতের রিজার্ভ ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ কমেছে। এশিয়া অ লের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ডের ১৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার ৫ দশমিক ৪৬, ইন্দোনেশিয়ার ৫ দশমিক ৩৮, মালয়েশিয়ার ৫ দশমিক ৬৬ এবং ভিয়েতনামের ১ দশমিক ৯ শতাংশ রিজার্ভ কমেছে। বিপরীতে একই সময়ে বাংলাদেশের রিজার্ভ কমেছে ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এশিয়া প্যাসিফিক অ লের দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫৯০ বিলিয়ন ডলার কমেছে বলে পরিসংখ্যান দিয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা ‘ফিচ’। সংস্থাটির তথ্য বলছে, চলতি বছর জুলাই পর্যন্ত সময়ে এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি চীন, সিঙ্গাপুর ও জাপানের রিজার্ভ সবচেয়ে বেশি সংকুচিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রিজার্ভ কমেছে ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ডেরও। তবে পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এশিয়া অ লের উদীয়মান ও উন্নত দেশগুলোর মধ্যে রিজার্ভ কমে যাওয়ার বিবেচনায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। গত এক বছরে বাংলাদেশের রিজার্ভ ২২ শতাংশেরও বেশি কমেছে। ২০২১ সালের আগস্টে রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভের পতন হয়েছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে রিজার্ভের পরিমাণ নেমে আসে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে। এ হিসেবে গত জুলাই শেষে আগের বছরের আগস্টের তুলনায় রিজার্ভ কমেছে ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ আরো কমে ৩৭ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। সর্বশেষ অবস্থা আমলে নিলে গত বছরের আগস্টের তুলনায় রিজার্ভ ২২ শতাংশেরও বেশি কমেছে। এটি এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে রিজার্ভের সর্বোচ্চ পতন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন. কভিড সংক্রমণের দুই বছরে এশিয়া অ লের বেশির ভাগ দেশেরই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। চলতি বছর চলছে করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সময়। অর্থনীতির চাহিদা বাড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকোচন ও মূল্যস্ফীতির উচ্চহার বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের রিজার্ভকে চাপে ফেলেছে।
গত কয়েক বছরে করা ভুলের খেসারত বাংলাদেশ এখন দিচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলেন, স্থিতিশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে অনেক বেশি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। এ কারণে বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের সময়ে ওইসব দেশের জনগণকে চড়া মূল্য দিতে হয়নি। কিন্তু সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী সংস্থাগুলো গত কয়েক বছর উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে ডলারের দাম সমন্বয় করার দরকার ছিল। কিন্তু সেটি না করে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখা হয়েছে। এ কারণে গত ছয় মাসেই টাকার ২৩ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এত বড় অভিঘাত নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের ভাষ্য হলো সরকার সমীক্ষা ও সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এজন্য বিদেশী ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছে। দেশের আমদানি ব্যয় ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। অথচ রেকর্ড এ আমদানির কোনো প্রতিফলন অর্থনীতিতে নেই। আমদানি-রফতানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থপাচার ঠেকানো যায়নি। কী পণ্য আমদানি হয়েছে, সেটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
বৈশ্বিক অর্থনীতির নানা তথ্য-উপাত্তের ওয়েবসাইট সিইআইসিডাটার পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের আগস্টে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৫৭৮ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের জুলাইয়ে দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ ৫১১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ভারতের রিজার্ভ সংকুচিত হয়েছে ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। তবে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্য বলছে, গত ২ সেপ্টেম্বর সংরক্ষিত স্বর্ণসহ ভারতের মোট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৫৫৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ছিল ৪৯২ বিলিয়ন ডলার।
গত এক বছরে পরিমাণ কমে এলেও এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশ কোরিয়ার ৪১৫ বিলিয়ন ডলার, থাইল্যান্ডের ১৯৯, ইন্দোনেশিয়ার ১২৩, মালয়েশিয়ার ১০০ এবং ভিয়েতনামের ১০৩ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মজুদ রয়েছে। এ দেশগুলোর মধ্যে রিজার্ভ সবচেয়ে কম সংকুচিত হয়েছে ভিয়েতনামের। গত এক বছরে দেশটির রিজার্ভ কমেছে মাত্র ১ দশমিক ৯০ শতাংশ।
গত এক বছরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু গত অর্থবছরেই (২০২১-২২) রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় ৭৪০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরেও এখন পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে ২৮০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রি করায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অন্তত ১১ বিলিয়ন ডলার কমে গিয়েছে। এ অবস্থায় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির নীতি থেকে সরে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের বিনিময় হার বাজার পরিস্থিতির ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ায় একদিনেই ইতিহাসের সর্বোচ্চ দরপতন দেখেছে বাংলাদেশী মুদ্রা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণা অনুযায়ী, গত সোমবার প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৯৬ টাকা। একদিনের ব্যবধানে মঙ্গলবার প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা পর্যন্ত উঠে যায়। আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে লেনদেন হওয়া ডলারের এ দরকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে একদিনের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে সাড়ে ১০ শতাংশেরও বেশি টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। ডলার প্রতি বিনিময় মূল্য বাড়ে ১০ টাকা ১৫ পয়সা। গতকাল ডলারের বিনিময় হার আরো বেড়েছে। এদিন আন্তঃব্যাংকে ১০৬ টাকা ৯০ পয়সায় ডলার বিক্রি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চেও প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৬ টাকা। গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতি ডলার ১০৬ টাকা ৯০ পয়সায় গিয়ে ঠেকল। এ হিসাবে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হলো ২৩ শতাংশেরও বেশি। আর গত এক যুগের হিসাব আমলে নিলে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী মুদ্রা টাকা ৫৬ শতাংশ দর হারালো। ২০১০ সালে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৬৮ টাকা।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক করতে গত এক বছর ধরেই বিভিন্নমুখী উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন পর্যন্ত এসব উদ্যোগের সুফলও পাওয়া গিয়েছে। এ কারণে রিজার্ভের ওপর চাপও কিছুটা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির নীতিও কঠোর করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি ডলারের চাপ কমিয়ে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে বলেও মনে করছেন তিনি।