বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৫১ অপরাহ্ন

অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ

আহনাফ আবদুল কাদির:
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ইসলামপূর্ব যুগে নারীদের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই তারা হেনস্তা ও হয়রানির শিকার হতেন। ইসলামের আগমনে তারা জীবন ও জীবিকার নিরাপদ পরিবেশ খুঁজে পেলেন। হজরত ওমর ফারুক রা: বলেন, আল্লাহর কসম, জাহেলি যুগে আমরা নারীদের কোনো মর্যাদাই দিতাম না। অতঃপর আল্লাহ কুরআনে তাদের জন্য আয়াত অবতীর্ণ করলেন এবং তাদের প্রাপ্য বণ্টন করে দিলেন (বুখারি ও মুসলিম)। এ কথা জেনে রাখা দরকার, পরিবারের ব্যয়ভার বহন করা পুরুষেরই দায়িত্ব। নারীরা এ দায়িত্ব পালনে বাধ্য নন। নারীদের ঘরের কাজের মূল্য নির্ধারণ করা হলে তা পুরুষদের বাইরের কাজের অর্থমূল্যের চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না। বরং নারীর শ্রম ও সাধনার অর্থমূল্য আরো বেশি প্রমাণিত হবে। পুরুষ যা রোজগার করে তাতে নারীর অধিকার রয়েছে পূর্ণমাত্রায়। তাই কোনো পুরুষ কর্তা সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ করতে কৃপণতা করলে স্ত্রী বিনা অনুমতিতে পুরুষ কর্তার অর্থ-সম্পদ বৈধ পথে ব্যয় করতে পারেন। বুখারি ও মুসলিমের একটি হাদিস থেকে জানা যায়, আবু সুফিয়ানের স্ত্রী নবীজী সা:-এর কাছে তার স্বামীর ব্যাপারে অভিযোগ করে বলেন, আবু সুফিয়ান আমার ও সন্তানদের ব্যয়ভার ঠিকমতো বহন করেন না। গোপনে তার সম্পদ থেকে নিয়ে সংসারের জন্য ব্যয় করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। এ কথা শুনে নবীজী সা: বলেন, ‘তুমি তোমার নিজের ও সন্তানদের প্রয়োজন পূরণের জন্য পরিমাণ মতো অর্থ তার সম্পদ থেকে গ্রহণ করতে পারো।’
নারীর কাজকর্ম ঘরোয়া পরিবেশে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। বিশেষত আভাসভূমিকে শান্তির নীড় হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও জান্নাতি পরিবেশে গড়ে তোলাই নারীর প্রধানতম দায়িত্ব। তবে ঘরকন্যার কাজ ছাড়াও ঘরের বাইরের কার্যাবলিও যাতে নিরাপদ ও নির্বিঘেœ চালিয়ে যেতে পারেন সে ব্যবস্থাই তাদের করে দিয়েছে ইসলাম। তবে এ ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতি প্রয়োজন।
নবীজীর আদর্শ সমাজে নারীরা তাদের প্রয়োজন ও জীবন ধারণের তাগিদে কারিগরি, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ময়দানে অংশ নিতেন। সে যুগে নারীরা পশুপালন, হস্তশিল্প, কৃষিকাজ, শিল্প উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, নার্সিং, চিকিৎসা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও গৃহকর্মসহ অনেক কাজেই নিয়োজিত ছিলেন। এসব কাজে অংশগ্রহণের ব্যাপারে দু’টি বিষয় তাদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
প্রথমত, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা অর্জনের মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের দরিদ্রতা লাঘব করে সম্মানজনক জীবন যাপনের প্রচেষ্টা। দ্বিতীয়ত, উপার্জিত অর্থ দিয়ে আল্লাহর পথে ব্যয় ও মানবিক কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্মান এবং উচ্চমর্যাদা লাভের প্রেরণা। পবিত্র কুরআনুল কারিমে নারীর কাজের বিষয়টি স্বীকৃত। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ ধনসম্পদ দিয়ে কাউকে কারো ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তোমরা তার জন্য লালায়িত হয়ো না। পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ আর নারী যা অর্জন করে তাও তার প্রাপ্য অংশ। আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করো। আল্লাহ নিশ্চয়ই প্রতিটি বিষয়ে জানেন’ (সূরা নিসা-৩২)। নবীজী সা:-এর স্ত্রী উম্মুল ম্ুিমনিন হজরত খাদিজা রা: ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী মহিলা, যিনি নিজের ব্যবসায় পরিচালনা করতেন। তার সাথে বিয়ের আগে ও পরে নবীজী তার ব্যবসায় তদারকি করতেন। আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- পর্দার আয়াত নাজিল হওয়ার পর উম্মুল মোমিনিন হজরত সাওদা রা:-কে বাইরে যেতে দেখে ওমর রা: তার সমালোচনা করেন। ঘরে ফিরে এসে তিনি নবীজীর কাছে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করেন। তখনই নবীজী সা:-এর ওপর ওহি নাজিল হয়। তারপর তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অনুমতি দিয়েছেন’ (বুখারি)।
নবীজীর অনেক সাহাবির আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হতো। এক বেলা খেলে পরের বেলা খাবার জুটত না। তাই অনেক সাহাবির স্ত্রীরও তার স্বামীর সাথে আয়-রোজগারে শরিক হতেন। সাংসারিক বোঝা লাঘবে স্বামীদের সহযাত্রী হতেন। এতে যেমন পরিবারের বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা হতো, তেমনি স্বামীর প্রতিও অনুগ্রহ করা হতো। বুখারির কিতাবুন নিকাহতে বর্ণিত একটি হাদিসে আমরা দেখি, আবু বকর রা:-এর কন্যা হজরত আসমা রা: তার সাংসারিক জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, জুবায়েরের সাথে সবেমাত্র আমার বিয়ে হয়েছে। একটি পানিবাহী উট আর একটি ঘোড়া ছাড়া সম্পদ বলতে তার আর তেমন কিছুই ছিল না। আমি নিজেই ঘাস কেটে ও পানির পাত্র ভর্তি করে তার ঘোড়া ও উটকে আহার দিতাম। আবার আমাকেই আটার খামি বানিয়ে রুটি তৈরি করতে হতো যদিও আমি ভালো করে রুটি তৈরি করতে পারতাম না তখনো। তবে এ কাজে আমার ঘনিষ্ঠ ও নিঃশর্ত কিছু বান্ধবী প্রতিবেশি আমাকে সাহায্য করত। আমাদের এই দুরবস্থা দেখে নবীজী বাড়ি থেকে দুই মাইল দূরে একখ- জমি চাষ করতে দিয়েছিলেন। সেই জমি থেকে খেজুরের আঁটি বেঁধে আমি নিজে মাথায় করে আনছিলাম। পথে নবীজীর সাথে আমার দেখা হয়ে গেল। তখন তাঁর সাথে ছিলেন কিছু আনসারি সাহাবি। আমি তাদের সাথে পথ চলতে লজ্জাবোধ করছিলাম। বিশেষত আমার স্বামী জুবায়েরের কথা ভেবে। কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত আত্মমর্যাদাবান মানুষ। তিনিও পছন্দ করবেন না যে আমি তাদের সাথে একসাথে পথ চলি। নবীজী আমার ইতঃস্তত মনোভাব বুঝতে পেরে আমাকে অতিক্রম করে দ্রুত চলে গেলেন।
লক্ষ করুন, নবীজীর সমাজব্যবস্থায় নারীরা কিভাবে অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করত। পারিবারিক ব্যয় নির্বাহে স্বামীর সহযোগী হয়ে আবার কখনো কখনো স্বামীর চেয়েও বেশি দায়িত্ব পালন করে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণতার নজির স্থাপন করত। বুখারি শরিফের কিতাবুল জুময়ায় বর্ণিত আরেকটি হাদিসে নবীজীর সাহাবি সাহল ইবনে সাদ একজন মহিলার কথা উল্লেখ করেন, যার নিজের ফসলি জমি ছিল। সে তার জমিতে সেচ দিয়ে গাজরের চাষ করত। সাহল ইবনে সাদসহ অন্যান্য সাহাবি জুমার দিন তার বাড়িতে বেড়াতে গেলে তিনি গাজর ও আটার তৈরি পায়েশ খেতে দিলেন।
নবীজীর কাছে এসে মহিলারা ব্যবসায়-বাণিজ্যের বিভিন্ন নিয়ম-নীতি জেনে নিতেন। নবীজী তাদের কাছে ইসলামের বাণিজ্যনীতি সবিস্তারে বর্ণনা করতেন। একবার এক মহিলা সাহাবিয়্যাহ নবীজীর কাছে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি একজন মহিলা। আমি ব্যবসায় পরিচালনা করি। আমাকে ইসলামের বাণিজ্যনীতি সম্পর্কে অবহিত করুন। এরপর ওই মহিলা নবীজীর কাছ থেকে সবিস্তারে ব্যবসায়সংক্রান্ত নিয়ম-নীতি জেনে নিলেন (তাবাকাতে ইবনে সাদ, অষ্টম খ-, পৃষ্ঠা-২)। বিখ্যাত সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা:-এর স্ত্রী রায়িতা রা: হস্তশিল্পে দক্ষ ছিলেন। তিনি বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি করতেন এবং উপার্জিত অর্থ দান করে দিতেন (মুসনাদে আহমাদ-১৬০৩০)। নবীজী সা:-এর রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিভিন্ন পেশায় নারীদের স্বতঃস্ফূূর্ত অংশগ্রহণ বিদ্যমান ছিল। নারীরা অর্থ উপার্জন করে নিজের ও পরিবারের জন্য ব্যয় করতেন। সামাজিক ও কল্যাণমূলক কাজে দান করতেন। খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগেও নারীরা নির্বিঘেœ তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য পরিচালনা করতেন। হজরত ওমর রা:-এর যুগে আসমা বিনতে মাখরামা নামক এক মহিলা সাহাবিয়্যাহ তার ছেলেকে সাথে নিয়ে আতরের কারবার করত।
আমরা বিনতে তাবিখ নামে এক মহিলা বলেন, একবার আমি দাসীকে সাথে নিয়ে বাজার থেকে মাছ কিনে বাড়ি ফিরছি। মাছের মাথা ও লেজ থলের বাইর থেকে দেখা যাচ্ছে। পথিমধ্যে হজরত আলী রা: মাছটি দেখে বললেন, কত নিয়েছে? মাছটি তো খুবই সুন্দর ও তরতাজা। পরিবারের সবাই তৃপ্তিসহকারে খেতে পারবে (তাবাকাতে ইবনে সাদ, অষ্টম খ-, পৃষ্ঠা-২১২)। পরবর্তী সময়ে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসনামলেও নারীরা নিরাপদে অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করতেন। খলিফা হারুনুর রশিদের স্ত্রী জোবায়দা দীর্ঘ খাল খনন করে হাজীদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেন। সেলজুক শাসক সুলতান মালিক শাহর স্ত্রী তুরকান বিনতে তুরাজ বাগদাদে তিনটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তা পরিচালনার জন্য বিপুল সম্পদ ওয়াক্ফ করেন (তারিখু দাওলাতুল আব্বাসিয়া, পৃষ্ঠা-৯৭)। ইসলামের ইতিহাসের পাতায় পাতায় নারীদের অর্থনৈতিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। এ জন্য যে বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে- ঘরে-বাইরে নারীদের নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করা। নারীদের জন্য নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরি করা। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে নারীরা কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হন। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ নয় বরং এমন নিরাপদ ও মনোরম পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে নারী জাতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com