আদল আরবি শব্দ, যার বাংলা অর্থ সমতা রক্ষা, ভারসাম্য রক্ষা, ইনসাফ করা, দু’জনের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া, প্রকাশ্যে ও গোপনে সঠিকতা ইত্যাদি। মুফতি আমিমুল ইহসান বলেন, বাড়াবাড়ি, সীমালঙ্ঘন এবং অবহেলা ও শিথিলতার মাঝামাঝি অবস্থানের নাম আদল। ইসলামী পরিভাষায় কোনো বস্তুকে সমান অংশের অধিকারীদের মধ্যে এমনভাবে ভাগ করে দেয়া যাতে কারো অংশ বিন্দু পরিমাণ কম বা বেশি না হয়। সহজ কথায় সর্বাবস্থায় ইনসাফ বা ন্যায়বিচার কায়েম করাকে আদল বলে। আদলের বিপরীত হচ্ছে জুলুম।
ইসলামে আদল বা ন্যায়পরায়ণতার গুরুত্ব মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন- পারিবারিক জীবনে- মা-বাবা, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির পারস্পরিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে। সামাজিক জীবনে- প্রতিবেশীসহ অন্যদের সাথে কথাবার্তা, আচার-আচরণ, ক্রয়-বিক্রয়, লেনদেনের ক্ষেত্রে। অর্থনৈতিক জীবনে- ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রীয় জীবনে- বিচারব্যবস্থায় নিয়োজিত বিচারকদের বিচার কার্যে। এভাবে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আপন আপন অঙ্গনে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধ, সন্ধি, লেনদেনের ক্ষেত্রে আদল বা ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে জগৎস্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা জোর নির্দেশ দিয়েছেন। এ জন্য মানবজীবনের সর্ব ক্ষেত্রে আদল বা ইনসাফ কায়েম করা মোস্তাহাব নয়; বরং এটি কুরআনিক নির্দেশ ফরজ। যেমন- মহান আল্লাহ তায়ালা বিচার ফায়সালার ক্ষেত্রে বলেন, ‘যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচার ফায়সালা করো, তখন আদলের সাথে করো।’ (সূরা নিসা-৫৮)
তিনি অন্যত্র আদলের গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো এবং আল্লাহর জন্য সত্যের সাক্ষী হিসেবে নিজেকে পেশ করো, যদিও এটি তোমার নিজের, নিজের পিতামাতার কিংবা আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়।’ (সূরা নিসা-১৩৫)
মহানবী সা: ন্যায়বিচারের গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার (আরশের) ছায়াতলে আশ্রয় দেবেন, সে দিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কারোর ছায়া থাকবে না। (প্রথম জন) ন্যায়পরায়ণ নেতা।’ (মুসলিম-২৪২৭)
মহানবী সা: আরো বলেন, ‘ন্যায়পরায়ণ শাসক মহান আল্লাহর কাছে নূরের উচ্চ মিনারায় অবস্থান করবে, যা থাকবে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ডান পাশে।’ (মুসলিম-৪৮২৫) এখানে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বোঝা যায়, বিচারের ক্ষেত্রে আদল বা ন্যায়বিচারের গুরুত্ব কত! আমরা অনেকে মুসলমানের বাহ্যিক বেশভুষা, কিছু বহ্যিক মোস্তাহাব আমলকে খোদাভীতির বড় মাপকাঠি বলে মনে করি। অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘তোমরা আদল বা ন্যায়বিচার করো এটি খোদাভীতির অতি নিকটবর্তী।’ (সূরা মায়িদা-৮)
যদি আমরা খোলাফায়ে রাশেদিনদের শাসনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, পরবর্তী খলিফাদের সাথে তাদের মৌলিক পার্থক্য ছিল তাদের শাসনের সর্বত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। ওমর বিন আবদুল আজিজ ছাড়া পরবর্তীতে কোনো উমাইয়া কিংবা আব্বাসি খলিফা এভাবে শাসনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এ জন্য মুসলিম উম্মাহ তাদেরকে মুসলমানদের খলিফা বলেছেন। কিন্তু খোলাফায়ে রাশেদিন নামে অভিহিত করেননি। এই হলো মুত্তাকিন বা পরহেজগারির মাপকাঠি যা এখন মুসলিম সমাজের প্রায় সর্বত্রই উপেক্ষিত। এতটুকু বলে অত্যুক্তি হবে না যে, কখনো কখনো মুসলমানদের ক্রিয়াকলাপে এত বেশি বেইনসাফি পরিলক্ষিত হয়, যা অমুসলমানদের ক্রিয়াকলাপকেও হার মানায়। অথচ মুসলমানরা হলো ওহির জ্ঞানের ধারক ও আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী।
আজ মুসলমানদের মধ্যে ঘুষ, দ্রব্যে ভেজাল, জালিয়াতি,পরকীয়া, মা-বাবার হক আদায় না করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো, সুদের বাণিজ্য, পরের হক নষ্ট করা, পাঠদানে ফাঁকি দেয়া, অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা, ঠগবাজি, আপন দায়িত্বে অবহেলা ইত্যাদি হাজারো আদলের বরখেলাপ কাজ লালিত হচ্ছে।
সুতরাং এসব বেইনসাফি বা জুলুমমূলক কাজ যে কত মারাত্মক কবিরা গোনাহ ও পরপারে এর পরিণাম যে কত ভয়াবহ! তা কুরআন-হাদিসের দিকে তাকালে বোঝা যায়। তওবা ছাড়া এসব গুনাহের পাপ কখনো মাফ হয় না। আর তওবার নিয়ম হলো- মহান আল্লাহর হককেন্দ্রিক বেইনসাফি করলে তওবা করে সে কাজ চিরজীবনের মতো বন্ধ করতে হবে। ওজর ছাড়া কখনো তার পুনরাবৃত্তি করা যাবে না।
আর মানুষের হককেন্দ্রিক বেইনসাফি করলে তার তওবা বা শোধন হলো- ওই মানুষ যতক্ষণ তাকে মাফ না করবে মহান আল্লাহ পাক ততক্ষণ তাকে মাফ করবেন না। এ প্রক্রিয়ায় মাফ পাওয়া যে কত কঠিন! নি¤েœর উদাহরণগুলোর দিকে আমরা একটু খেয়াল করি-
১. ধরে নিই চাকরি পরীক্ষায় যে প্রথম হয়েছে অর্থের বিনিময়ে হোক, কিংবা দলীয় বা স্বজনপ্রীতির কারণে হোক বা অন্য কোনো কারণে হোক তাকে বি ত করে অপরজনকে চাকরি দেয়া হলো। তাহলে এই চাকরিপ্রাপ্ত ব্যক্তি বর্তমান যে বেতনভাতাসহ সব সরকারি সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন এটি মূলত তার হক নয়; বরং যাকে বি ত করা হয়েছে মূলত এটি তার হক, হয়তোবা সে এখন নিদারুণ কষ্টে আছে। এখন যিনি বা যারা নিয়োগ বোর্ডে ছিলেন তারা যদি এ পাপ থেকে নিজেদের শোধন করতে চায় তাহলে সে পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তাদের সামনে কোনোপথ খোলা আছে কি? এভাবে ঘুষখোর কর্মকর্তা,পরের হক বি তকারী ব্যক্তি যারা ছয়কে নয় আবার নয়কে ছয় করেছে, তিনকে পাঁচ আবার পাঁচকে তিন করেছে তাদের শোধনের উপায় কী? বিষয়গুলো কত কঠিন ভেবে দেখেন তো!
২. যদি একজন ব্যক্তির শুধু একটি কন্যাসন্তান থাকে তাহলে সে তার সব সম্পত্তির অর্ধেক পাবে। আর যদি দুই বা ততধিক কন্যাসন্তান থাকে তাহলে তারা পাবে তার সম্পত্তির চার ভাগের তিন ভাগ। উভয় অবস্থায় স্ত্রী পাবে আট ভাগের এক ভাগ। বাকি সম্পত্তি তার ভাতিজারা কিংবা ক্ষেত্র হিসেবে অন্য স্বজনরা পাবে। অন্যরা পাবে এ ভয়ে বাবা সব সম্পত্তি কন্যাদেরকে লিখে দিলেন। এমনকি অনেকে স্ত্রীকেও ফাঁকি দেয় এ ভেবে যে, সে মারা গেলে তার সম্পত্তিরও কিছু অংশ তার ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা পেয়ে যাবে। মানুষ এখন দুই সন্তান নেয়াতে বেশি অভ্যস্ত তাই এখন অনেকের আছে শুধু দু’টি মেয়ে, ছেলে নেই। সুতরাং এ হক বি তকরণের পাপও এখন সমাজে বেশি চলছে। জীবনের কোনো একপর্যায়ে এসে যদি ওই ব্যক্তি নিজের এ অবিচার বা পাপের শোধন করতে চায় তা হলে এর উপায় কী? সে যদি বারবার তওবা করে কিংবা ইস্তিগফার পড়ে তা হলে কি মাপ হবে? মহান আল্লাহই ভালো জানেন।
৩. শিক্ষাঙ্গনে এমন অনেক শিক্ষক আছেন যাদের পাঠদানে ফাঁকির কারণে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী তাদের শিক্ষার আলো থেকে বি ত হয়েছে। এদের অনেকে আবার বেশ তৎপর নিজেদের দাবি-দাওয়া বা অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে। অথচ পরের অধিকার আদায়ে মাথাব্যথা নেই। এখন প্রশ্ন হলো এরা যে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর প্রতি বেইনসাফি করেছে এবং সরকার থেকে বেতন নিয়ে বলা যায় দেশের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদের তওবার সিস্টেম বা উপায় কী?
অনুরূপভাবে যে ব্যবসায়ী পণ্যে ভেজাল দিয়ে, কখনো ফরমালিনের মতো বিষাক্ত দ্রব্য মিশিয়ে শত শত মানুষের হার্ট, কিডনি,পাকস্থলী শেষ করে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার কেউ বা মৃত্যুর আগে জমিগুলো ছেলেদের নামে লিখে দিয়ে মেয়েদেরকে বি ত করেছে। কৌশলে অনেকে জমি জাল দলিল করে প্রকৃত জমির মালিককে বি ত করেছে, যৌতুক দাবি করে স্ত্রীর ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেছে, কৌশলে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে, এরূপ হাজারো আদলের বরখেলাপ পাপ কাজে আজ মুসলিম সমাজ কলুষিত। আর এসব পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় যে কত কঠিন তা একটু ভাবুন তো!
অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা সর্বাবস্থায় এগুলো বর্জন করে, সর্ব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা মায়িদা-৪২) তিনি এ ব্যাপারে আরো তাকিদ দিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদল বা ইনসাফ ও ইহসানের সাথে কাজ করার হুকুম করেছেন।’ (সূরা নাহল-৯০) আর এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এ আয়াতখানি ইমাম সাহেব প্রতি জুমায় ছানি খুতবায় আমাদের শুনিয়ে থাকেন যাতে আমরা এর ওপর আমল করি। (আগামীকাল সমাপ্ত)
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক