দ্বিতল পদ্মা সেতুর ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। এজন্য স্প্যানের ভেতরে ২ হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাব বসিয়ে তৈরি করা হয়েছে ট্রেন চলার গতিপথ। এসব স্ল্যাবের ওপর বসানো হবে পাথরবিহীন ব্রড গেজ রেলপথ। মূল পদ্মা সেতুতে রেলপথ বসানোর কাজ মাস খানেক আগে উদ্বোধন করেছেন রেলমন্ত্রী। তবে এখনো কাজটি শুরু করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি)। বিপত্তি বেঁধেছে রেলওয়ে স্ল্যাবের উচ্চতা নিয়ে। রেলপথ বসানোর জন্য প্রয়োজন হয় সমতল জায়গা। কিন্তু পদ্মা সেতুতে যেসব রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হয়েছে, সেগুলোর উচ্চতা কোথাও কোথাও রেলপথের জন্য নির্ধারিত নকশার চেয়ে বেশি হয়ে গিয়েছে। বিদ্যমান নকশায় সেতুতে রেলপথ বসালে তা সমতল হবে না। কাজ শুরুর আগে জরিপ করতে গিয়ে বিষয়টি ধরা পড়েছে। বর্তমানে পদ্মা সেতুর জন্য করা রেলপথের নকশায় সংশোধন করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পে নকশা সংশোধনের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগে ২০২০ সালে সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের সঙ্গে সড়কপথের নকশা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। সে সময় মাওয়া প্রান্তের রেলওয়ে ভায়াডাক্টের কাজ করতে গিয়ে দেখা যায় নিচের সড়কের তুলনায় ওপরের রেলপথের উচ্চতা প্রয়োজনের তুলনায় কম। সেক্ষেত্রে সড়ক দিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু যানবাহন চলাচল করতে গেলে তা রেলওয়ে ভায়াডাক্টের সঙ্গে সংঘর্ষের আশঙ্কা ছিল। একই রকম জটিলতা দেখা দিয়েছিল জাজিরা প্রান্তেও। এজন্য সংশোধন করা হয় রেলপথের নকশা। এতে সময় লেগে গিয়েছিল প্রায় চার মাস।
সেতুর রেলপথে নকশার বর্তমান জটিলতাটি দেখা দিয়েছে রেলওয়ে স্ল্যাবের উচ্চতা নিয়ে। রেল সংযোগ প্রকল্প কার্যালয়ের তথ্য বলছে, পদ্মা সেতুর দুই পাশের সংযোগ ভায়াডাক্টের (উড়ালপথ) সঙ্গে মিল রেখে প্রস্তুত করা হয় মূল সেতুতে রেলপথের নকশা। জরিপে উঠে এসেছে, কয়েকটি স্থানে রেলওয়ে স্ল্যাবের উচ্চতা নির্ধারিত নকশার চেয়ে ৪০-৬০ মিলিমিটার পর্যন্ত বেশি রয়েছে। বিদ্যমান নকশায় রেলওয়ে স্ল্যাবের ওপর রেলপথ বসালে তা উঁচু-নিচু হয়ে যাবে, যা ট্রেন চলাচলের জন্য উপযোগী হবে না। চলতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়বে ট্রেন।
চীনের কাছ থেকে ২৬৭ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। এ ঋণ গ্রহণের জন্য চুক্তি সম্পাদনের সময় প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৭৮ টাকা ৮৫ পয়সা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় হার এখন ১০৮ টাকা। ডলারের বিপরীতে টাকার মান অবনমন হওয়ায় দিন দিন ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে প্রায় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার প্রকল্প। নকশা জটিলতার কারণে কাজ বিলম্বিত হলে প্রকল্পটি আরো ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।
পদ্মা সেতুর স্প্যানের ভেতরে রেলওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজটি করেছে রেল সংযোগ প্রকল্পের ঠিকাদার সিআরইসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ (এমবিইসি)। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প কার্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, জরিপে রেলওয়ে স্ল্যাব অসমতল হওয়ার বিষয়টি ধরা পড়লেও শুরুতে তা মানতে চাননি এমবিইসির প্রকৌশলীরা। পরে দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা মিলে জরিপের বিষয়বস্তু খতিয়ে দেখার পর রেলওয়ে স্ল্যাব অসমতল হওয়ার বিষয়ে একমত হন। এরপর মূল পদ্মা সেতুতে রেলপথের নকশা সংশোধনের কাজ শুরু করেন সিআরইসির প্রকৌশলীরা।
রেলপথ বসানোর জায়গাটি অসমতল হলে কী সমস্যা হতে পারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, রেলের জন্য একটা সমান উচ্চতার জায়গা প্রয়োজন। রেলপথের তলটা হতে হবে নিখুঁত। রেলপথের তল নিখুঁত করতে না পারলে সে রেলপথে ট্রেন পরিচালনা করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।
পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এর সঙ্গে মাওয়া প্রান্তে ২৬৬ মিটার ও জাজিরা প্রান্তে আরো ২৬৬ মিটারসহ সব মিলিয়ে ৬ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার এলাকায় রেলপথ বসানো হবে। গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন শুরু হয় যানবাহন চলাচল। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে রেল সংযোগ প্রকল্পটি বাংলাদেশ রেলওয়ের। নিয়ম অনুযায়ী, পদ্মা সেতুতে কাজ শুরুর জন্য সেতু কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল রেলওয়ের, যা সংস্থাটি চলতি বছরের ১৭ জুলাই পেয়ে যায়। অনুমোদনের পর মূল সেতুতে রেলপথ স্থাপনের কাজ শুরুর জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট ও ঠিকাদার যৌথভাবে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। রেলওয়ে স্ল্যাব অসমতল থাকার বিষয়টি এ জরিপ থেকেই ধরা পড়ে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
রেলওয়ে স্ল্যাব অসমতল হওয়ার প্রেক্ষাপটে নকশা সংশোধনের বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ও প্রধান প্রকৌশলী (ট্র্যাক অ্যান্ড ওয়ার্কস) আব্দুল জলিল বলেন, পদ্মা সেতুর ওপরে রেলপথ বসানোর জন্য আমরা জরিপ করেছি। জরিপ করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, রেলওয়ে স্ল্যাবের সঙ্গে রেল ট্র্যাকের উচ্চতায় কিছুটা কমবেশি রয়েছে। এজন্য এখন নকশা সংশোধন করা হচ্ছে। নকশা সংশোধনের কাজটি করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তারা এখনো সংশোধিত নকশা আমাদের কাছে জমা দেয়নি। সংশোধিত নকশা বুঝে পাওয়ার পর সেতুর ওপরে রেলপথ বসানোর কাজ শুরু হবে।
নকশা সংশোধনের কারণে নির্মাণকাজ বিলম্বিত হতে পারে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, নির্মাণকাজ বিলম্বিত হবে কিনা তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। সংশোধিত নকশা আগে আমরা বুঝে পাই, তারপর বলা যাবে। তবে আমরা মনে করি, এ সমস্যার কারণে রেলপথ বসানোর কাজ সময়মতো শেষ করতে কোনো সমস্যা হবে না।
রেলওয়ে স্ল্যাবের উচ্চতা কত বেশি রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এখনো চূড়ান্ত হিসাব পাইনি। আর বিষয়টি খুব বেশি অস্বাভাবিকও নয়। যেকোনো ধরনের নির্মাণকাজে ‘মিলিমিটার টু মিলিমিটার’ হিসাব করে মেলানো কঠিন। সাধারণ একটি বাড়ির ছাদ ঢালাই করতে গেলেও ছাদের সব জায়গা সমতল করা সম্ভব হয় না।
রেলপথ বসানোর কাজ শুরু না হলেও আনুষঙ্গিক কাজগুলো এগিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, প্রয়োজনীয় নির্মাণ উপকরণগুলো সেতুর ভেতরে নেয়া হচ্ছে। যে ক্রেন দিয়ে রেলপথ বসানো হবে, সেই ক্রেন চলাচলের জন্যও একটি রেলপথ প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বর্তমানে অসমতল রেলওয়ে স্ল্যাবের সঙ্গে রেলপথটি সমন্বয়ের কাজ চলমান রয়েছে জানিয়ে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, কাজ করার জন্য আমাদের সবকিছুই প্রস্তুত করা আছে। মূল সেতুর দুই পাশে অন্যান্য কাজ সমানতালে করা হচ্ছে। তবে মূল সেতুতে একটা ত্রুটিপূর্ণ বিষয় নিয়ে তো আমরা কাজ করতে পারি না। সেজন্যই একটু সময় নিয়ে সমস্যাটি সমাধানের কাজ চলছে। পদ্মা সেতুতে মূল অগ্রাধিকার কিন্তু সড়কপথ, যা এরই মধ্যে চালু হয়ে গিয়েছে। রেলপথের কাজ শেষ করতে একটু দেরি হলেও অসুবিধা নেই। আর আমাদের প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত। আমরা এ সময়ের মধ্যেই সব কাজ সম্পন্ন করতে পারব।- বণিক বার্তা