রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৪:৪৮ অপরাহ্ন

জীবিত উদ্ধার রহিমা, বস্তাবন্দি লাশটা তাহলে কার?

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায় দাফন হওয়া এক নারীর লাশ নিজের মায়ের বলে দাবি করেছিলেন খুলনার দৌলতপুরের মরিয়ম মান্নান। শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টার দিকে ফুলপুর থানায় গিয়ে উদ্ধারকৃত নারীর পোশাক ও সংরক্ষিত আলামত দেখে এমন দাবি করেন তিনি। তার এমন দাবির একদিন পরই নিখোঁজ রহিমা খাতুনকে (৫২) জীবিত অবস্থায় ফরিদপুরের বোয়ালমারী ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিখোঁজের ২৮ দিন পর শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাত পৌনে ১১টার দিকে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে ফুলপুর উপজেলায় দাফন হওয়া লাশটি আসলে কার? এ বিষয়ে জানতে শনিবার রাতে ফুলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে কথা বলেছেন সাংবাদিকরা।
ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলা বলেন, ‘সেদিন পোশাক ও অন্যান্য আলামত দেখে মরিয়ম মান্নান দাবি করেছেন লাশটি তার মায়ের। তখন আমরা বলেছি, ডিএনএ পরীক্ষা না করে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। ডিএনএ পরীক্ষার পরই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
তিনি বলেন, ‘১০ সেপ্টেম্বর বস্তাবন্দি অবস্থায় ওই লাশটি আমরা উদ্ধার করেছিলাম। প্রাথমিকভাবে এটি হত্যাকা- বলে মনে হয়েছে আমাদের। হত্যাকা-ের বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা লাশের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি। ওই দিনই অজ্ঞাত লাশটি উদ্ধারের খবর পেয়ে নওগাঁ থেকে এক নারী ফুলপুর থানায় আসেন। তিনি দাবি করেন, লাশটি তার নিখোঁজ মেয়ের হতে পারে। এরপর আমরা তাকে সব আলামত দেখাই। কিন্তু তাতে তার সন্দেহ থেকে যায়। এরপর আমরা তার মেয়ের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে অনুসন্ধান চালাই। দুদিন পর তার মেয়েকে ঢাকার বসুন্ধরা থেকে উদ্ধার করে দিই। এর মধ্যে লাশের দাবিদার না পাওয়ায় দুদিন পর দাফন করা হয়।’
ওসি বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ খুলনার মরিয়মের কল আসে আমাদের কাছে। তখন মোবাইলে ধারণ করা লাশের আলামত ও পরনের পোশাকের ছবি তার কাছে পাঠানো হয়। ওই ছবি দেখেই মোবাইলে মরিয়ম জানান, লাশটি তার মায়ের। মরিয়মের মা ও দাফন করা নারীর বয়সের গরমিল এবং কিছু তথ্য অস্বাভাবিক মনে হওয়ায় তাকে থানায় এসে যাবতীয় আলামত দেখে লাশ শনাক্ত করতে বলেছিলাম। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে তিনি ফুলপুর থানায় আসেন। এরপর লাশ উদ্ধারের স্থান ও কবর দেওয়া স্থান ঘুরে দেখেন। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। পরে লাশের পরিহিত কাপড় ও যাবতীয় আলামত দেখে মরিয়ম দাবি করেন, লাশটি তার মায়ের। তখন আমরা ডিএনএ পরীক্ষার কথা বললে মরিয়ম রাজি হন। পরে মরিয়ম ফুলপুর থানায় ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আব্দুল মোতালিব শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) আদালতে লাশের ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। ওই দিন রাতেই খুলনা পুলিশ মরিয়মের মাকে জীবিত উদ্ধার করেছে বলে খবর পাই। রবিবার সকালে এই খবর আদালতে পৌঁছানোর আগেই ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন মঞ্জুর হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আমরা আর ডিএনএ পরীক্ষা করবো না। কারণ আবেদনকারীর মাকে পাওয়া গেছে।’
ওই লাশটি তাহলে কার, তার পরিচয় ও হত্যাকারীদের শনাক্তে পুলিশ কোনও পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা জানতে চাইলে ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমার থানা ও আশপাশের এলাকায় খোঁজ নিয়েছি আমরা। এখানে কেউ নিখোঁজ নেই৷ আমাদের ধারণা, অন্য কোনও স্থানে হত্যা করে ওই নারীকে বস্তাবন্দি করে এখানে ফেলে যাওয়া হয়েছে। পরিচয় নিশ্চিত হতে আমরা ইতোমধ্যে ওই নারীর ছবি দিয়ে পোস্টার লাগিয়েছি বিভিন্ন এলাকায়। পত্রপত্রিকায় তা প্রকাশ করেছি। বেতার বার্তায় ছবিসহ বিভিন্ন জেলায় খবর পাঠিয়েছি। এখনও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। একইসঙ্গে হত্যাকা-ে জড়িতদের শনাক্তে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআইয়ের খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘ফুলপুর থানা এলাকা থেকে বস্তাবন্দি এক নারীর লাশ উদ্ধার হয়। ওই থানার ওসি আমাদের জানিয়েছেন, বয়স ৩২ উল্লেখ করে লাশ দাফন করা হয়েছে। অথচ মরিয়মের মা রহিমার বয়স ৫২ বছর। এজন্য ডিএনএ পরীক্ষা করে লাশ শনাক্ত করতে বলেছি আমরা। কারণ মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছেন আদালত।’
ফুলপুর থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ১০ সেপ্টেম্বর উপজেলার বওলা গ্রামের দারোগা বাড়ির পেছনের একটি ঝোপের ভেতর থেকে লাশের গন্ধ পান গ্রামবাসী। পরে পুলিশ গিয়ে গলিত লাশ উদ্ধার করে। পরিচয় নিশ্চিত হতে না পারায় লাশটি আঞ্জুমান মফিদুলের মাধ্যমে ফুলপুর উপজেলা সদরের একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়। লাশের পরনে ছিল গোলাপি রঙের সালোয়ার, লাল ও গোলাপি ছাপের কামিজ এবং গাঢ় লাল রঙের ওড়না। উদ্ধার ওই লাশের বয়স ৩২ বলে রেজিস্টার খাতায় উল্লেখ করেছে পুলিশ। এর আগে গত ২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার বাসার উঠানের নলকূপে পানি আনতে যান রহিমা খাতুন। কিন্তু এক ঘণ্টা পরও তিনি বাসায় না ফেরায় সন্তানরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। এরপর নলকূপের পাশে মায়ের জুতা, ওড়না ও পানির পাত্র পড়ে থাকলেও মাকে খুঁজে পাননি সন্তানরা।
এ ঘটনায় ওই রাতেই রহিমার ছেলে দৌলতপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরদিন তার মেয়ে আদুরী আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে থানায় অপহরণ মামলা করেন। পাশাপাশি বিষয়টি র‌্যাবকেও জানানো হয়। এ মামলায় ছয় জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে দীর্ঘদিন ধরে রহিমার সন্ধান না পাওয়ায় মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছেন আদালত।
পিবিআইর বক্তব্য কাউকে অপহরণ করলে সাথে এত জিনিস থাকার কথা নয় : খুলনা নিজ বাড়ি থেকে নিখোঁজ রহিমা বেগমকে ফরিদপুর থেকে উদ্ধারের সময় একটি শপিং ব্যাগ পেয়েছে পুলিশ। এতে থাকা বিভিন্ন জিনিস দেখে পুলিশের কাছে মনে হয়েছে, তাকে অপহরণ করা হয়নি। তবে এটা একবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের বক্তব্য বলে জানিয়েছে পিবিআই। রহিমা বেগমকে গতকাল রোববার সকালে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কার্যালয়ে নেয়া হয়েছে। সেখানেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় নগরের হাজী মহসিন রোডে পিবিআই খুলনার কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়।
ব্রিফিংয়ে পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা এখনো মামলাটির তদন্ত করছি। তবে প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে, তার কাছ থেকে সাদা রঙের একটি শপিং ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে ওড়না ছিল, হিজাব ছিল, আয়না, শাড়ি, আইড্রপ, ওষুধ ছিল। তার পরিধেয় সালোয়ার-কামিজ ছিল, সাথে ছোট একটি অর্নামেন্টাল পার্টস ছিল। স্বাভাবিকভাবে একজনকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে এই জিনিসগুলো থাকার কথা নয়। তবে আমরা একবারে প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। আমরা বিস্তারিত তদন্ত শেষে আপনাদের সবকিছু জানাব। তবে আপাতদৃষ্টিতে এটা অপহরণ না-ও হতে পারে।’ তিনি বলেন, রহিমা বেগম সুস্থ আছেন। তবে একটু ভীত বলে মনে হচ্ছে। তিনি কী কারণে নিখোঁজ হয়েছিলেন, তাকে অপহরণ করা হয়েছিল নাকি আত্মগোপন করেছিলেন সে ব্যাপারে কিছুই বলছেন না। আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তদন্ত অব্যাহত রেখেছি। বিস্তারিত জানার পর সাংবাদিকদের জানাতে পারব। রহিমা বেগমের নিখোঁজের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের পোস্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিভ্রান্ত করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়া ময়মনসিংহে অজ্ঞাতনামা নারীর লাশকে নিজের নিখোঁজ মা রহিমা বেগমের বলে দাবি করায় প্রশাসন বিভ্রান্ত হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, রহিমা বেগম অপহরণের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া ছয়জনের বিষয়ে আদালতে সিদ্ধান্ত হবে। এ ছাড়া রহিমার সাথে ফরিদপুর থেকে পুলিশি হেফাজতে নেয়া আরো তিনজনের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। তবে নিরপরাধ কাউকে এ ঘটনায় সম্পৃক্ত করা হবে না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে পাঠানো হবে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত আদালত থেকে হবে। এর আগে সকালে রহিমা বেগমকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে পিবিআই কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে নেয়ার সময় দৌলতপুর থানার উপপরিদর্শক দোলা দে বলেন, রহিমা বেগম তার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে কিছু বলেননি। তিনি সন্তান ও স্বামীর কাছে যেতে চান না। তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান সকালে দেখা করতে এলেও দেখা করতে চাননি। রহিমা বেগম পরে দেখা করলেও তাদের সাথে কথা বলেননি। গত ২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার বাসার উঠানের নলকূপে পানি আনতে যান রহিমা বেগম। এর পর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। পরদিন তার মেয়ে আদুরী আক্তার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায় অপহরণ মামলা করেন। এ মামলায় ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মায়ের সন্ধান চেয়ে ঢাকায় মানববন্ধনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করে আসছিলেন তার সন্তানেরা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com