সবুজ পাহাড় ও পাহাড় সংলগ্ন পতিত জমিতে সারি সারি মাল্টা গাছ। সেসব গাছে থোকায় থোকায় গাঢ় সবুজ রঙের মাল্টা ঝুলছে। এ মাল্টার রঙ সবুজ হলেও স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয়। এর পুষ্টিগুণও অনেক বেশি। এভাবে গাছে গাছে মাল্টা ঝুলে আছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের কৃষি উদ্যোক্তা আকবরের মাল্টা বাগানে। শুধু অকবর নয়, মাল্টা চাষ করছেন আরও অনেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরসরাইয়ের বিস্তির্ণ পাহাড়জুড়ে মাল্টা চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। পাহাড় ও পতিত জমিতে অনেকেই এখন মাল্টা চাষ করছেন। মাল্টা চাষ খুব লাভজনক হওয়ায় উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে মাল্টা চাষ।
পাহাড় অ লের মাটি উর্বর এবং এখানকার আবহাওয়া শুষ্ক ও উষ্ণ হওয়ায় সাইট্রাস (লেবু) জাতীয় ফল চাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এ জাতীয় ফল বিশেষ করে লেবু ও মাল্টা চাষ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি অর্থ আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।
চাষিরা জানান, কেমিকেল দিলে বাজারে থাকা বিদেশি মাল্টার মতো রঙ আনা যায়। কিন্তু তারা সেটা না করে সবুজ রঙের মাল্টাই সাধারণ মানুষের মন আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে পরিপূর্ণ মাল্টার রঙ কিছুটা হালকা কাঁচা হলুদের রঙ আসে। এসব মাল্টার বেশ চাহিদাও রয়েছে।
জানা গেছে, প্রায় ১০ একর পাহাড়জুড়ে মাল্টা চাষ করেছেন তরুণ উদ্যোক্তা মো. ওমর শরীফ। ওই জায়গায় ৪৫০০ মাল্টা গাছ রয়েছে। উঁচু নিচু পাহাড় ও পাহাড়ের ঢালুতে গাছের মধ্যে থোকায় থোকায় ঝুলছে রসালো মাল্টা। গত বছর থেকে বাজারে মাল্টা বিক্রি করছেন। কোনো ধরনের কেমিকেল ছাড়া তার বাগানে উৎপাদিত মাল্টা বাজারজাত করা হয়। ওমর শরীফ বলেন, বিগত কয়েক বছর পূর্বে লিজ নিয়ে পাহাড়ে সমন্বিত বাগান করেছি। বাগানে সবচেয়ে বেশি জায়গাজুড়ে মাল্টা ও আমের চাষ করেছি। এতো বছর শুধু পুঁজি দিয়েছি, এখন ধীরে ধীরে মাল্টা, আম, পেয়ারা বাজারজাত করছি। আমার বাগানের ফরমালিনমুক্ত সুস্বাদু মাল্টার দারুণ চাহিদা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমার মাল্টা ছাড়াও বাগানে দেশি-বিদেশি প্রায় শতাধিক গাছ। রয়েছে বর্তমান বিশ্বের দামি মিয়াজাকি (সূর্যডিম) কিউজাই, ব্যানানা ম্যাংগো, ইন্দোনেশিয়ান ব্রুনেই কিং, কিং অফ চাকাপাত, আলফেনসো, আলফানচুন, থাই ব্যানানা আম, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, এভোকাডো, পুলসান, রাম্বুটান, আপেল, তেঁতুল, থাই সপদা, চেনাক ফ্রুট, থাই বেরিকেডেট মাল্টা, বারমাসি মাল্টা, চাইনিজ কমলা, দার্জিলিং কমলা, চায়না ৩ লিচু, লটকন, ভিয়েতনাম নারিকেল। আমার নার্সারিতে এভোকাডো, রাম্বুটান, পুলসান, ডুরিয়া, ম্যাগোইস্টান-এর চারারও রয়েছে।
উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের খিলমুরারী পাহাড়ি এলাকায় মাল্টা চাষ করেছেন গ্রামের আকবর হোসেন। ২০০২ সালে স্নাতক পাস করার পর চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেও চাকুরি পাননি। পরবর্তীতে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুর করেছেন। চাকরি করে জীবনের মোড় না ঘুরলেও মাল্টা বাগান করে সফল হন আকবর হোসেন। ২০১৮ সালে বাড়ির পূর্বপাশের পাহাড়ে তিন একর জায়গা লিজ নিয়ে সমন্বিত ফলের বাগান গড়ে তোলেন, বাগানের নাম দেন ‘ফিউচার এগ্রো হোমস’। দৃঢ় মনোবল আর কঠোর পরিশ্রমের কারণে আকবর এখন সফল উদ্যোক্তা। ইউটিউব দেখে আকবর তার বাগান গড়ে তুলেছেন। বাগানে কোনো সমস্যা হলে বা নতুন কোনো প্রজাতির চারা রোপণ ও পরিচর্যাসহ সবই করেন ইউটিউব দেখে। আকবর হোসেন জীবন বলেন, ‘পড়াশোনা সম্পন্ন করার পর চাকরি বা ছোটখাটো ব্যবসায় আমার মন বসছিল না। পোল্ট্রি ব্যবসার জন্য একজনের কাছ থেকে জায়গাও নিয়েছিলাম, পরে করা হয়নি। এরপর ওমান যাওয়ার জন্য দ্রুত পাসপোর্ট বানিয়েছি, মেডিকেল করে রিপোর্ট পাঠিয়েছি কিন্তু ভিসা না হওয়ার কারণে যেতে পারিনি।
মনস্থির করলাম দেশে কিছু একটা করা প্রয়োজন। তখনই ২০১৮ সালে বাড়ির পূর্ব পাশে পাহাড়ে তিন একর জায়গা লিজ নিয়ে বিভিন্ন ফলের চারা রোপণ করি। ৪ বছরে আমি কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার কারণে সফলতা দেখছি। আমার বাগানের ফলে কোনো ধরনের ঔষধ ও ফরমালিন ব্যবহার করা হয় না। আমি ফেরোমেন ও লাইটিং পদ্ধতিতে পোকা দমনের ব্যবস্থা রেখেছি। এই পর্যন্ত বাগানে প্রায় ১১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ২০২১ সালে মাল্টা উৎপাদন হয় তিন টন। চলতি বছর মাল্টা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৪ মেট্রিক টন। যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবছর ৬-৮ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রির আশা করছেন তিনি।
শুধু পাহাড়ে নয় সমতলেও মাল্টা চাষ করছেন অনেকে। ২০১৬ সালে উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের পূর্ব বড় কমলদহ এলাকায় মোহাম্মদ আযম উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের পরামর্শে বাড়ির পাশের পতিত দেড় বিঘা জমিতে বারি মাল্টা-১ বাগান গড়ে তুলেন। কৃষি কার্যালয় থেকে পাওয়া ১০০টি মাল্টা চারা নিয়ে বাগান শুরু করেন আযম। কৌশলগত সব পরামর্শ ও সহযোগিতা দেন মিরসরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা। ৮ বছরে এ বাগান গড়ে তুলতে ৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে তার। দুই বছর থেকে ফল আসতে শুরু করেছে বাগানটিতে। প্রথমবার ১০০ গাছ থেকে ৭০০টির মতো পাকা মাল্টা পাওয়া যায়। ৬-৭টিতে হয় ১ কেজি। এবার ২০০-২৫০টি করে মাল্টা ধরেছে প্রতিটি গাছে। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি শুরু হবে বিক্রি।
পাইকারি দরে প্রতি কেজি মাল্টা ১৫০ টাকা করে বিক্রি করা যায়। এলাকার অনেকেই এখন আকবর, আযমের মাল্টাবাগান দেখতে আসেন। এই বাগান দেখে এলাকার ছালাউদ্দিন, আবদুল আউয়াল, মো. সোহেল, আজিজ উদ্দিন ও ইমাম হোসেনসহ অনেক যুবক মাল্টাবাগান শুরু করেছেন।
উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা কাজী নুরুল আলম বলেন, উপজেলায় চলতি বছর প্রায় ১২ হেক্টর জমিতে মাল্টা চাষ করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ১৫ টন মাল্টা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। মাল্টা চাষে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে আসছে উপজেলা কৃষি অফিস। যার ফলে মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন অনেকে। তবে কৃষি অফিসের পরিসংখ্যান সঠিক নয় বলে জানান একাধিক চাষি। উপজেলার পাহাড়েই মাল্টা চাষ হয় প্রায় ২০ হেক্টর জায়গায়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রঘুনাথ বলেন, ‘মিরসরাইয়ের মাটি মাল্টা চাষের জন্য খুবই সহায়ক। বিশেষ করে পাহাড়ের মাটিতে মাল্টা ভালো চাষ হয়। প্রত্যেক বছর মাল্টা চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাল্টা গাছের রোগ বালাই কম হয়। ফলে অল্প পুঁজিতে মাল্টা চাষ করে লাভবান হওয়া যায়। উপজেলাতে চলতি বছর প্রায় ১২ টন মাল্টা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।’