রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ১২:৪৪ অপরাহ্ন

মহান রাষ্ট্রনায়ক

তারিক জামিল
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২২

আল্লাহতায়ালা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে যুগে যুগে তার প্রতিনিধি প্রেরণ করেছেন। তাঁর জমিনে তাঁরই রাষ্ট্র সুসংহত করার জন্য সংবিধান দিয়ে পাঠিয়েছেন। সেসব প্রতিনিধি সবক্ষেত্রে আল্লাহর নীতি প্রতিষ্ঠা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। রাষ্ট্রনায়কের এ ধারার সর্বশেষ হলেন প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.)। যখন আরবে মানবিক, চারিত্রিক ও সামাজিক অবক্ষয় বিরাজমান, নেই কোনো মানবতার আশ্রয়স্থল, তখনই মানবতার রাষ্ট্রদূত ও মহান রাষ্ট্রনায়ক প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) প্রেরিত হয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে নবী! আপনি বলুন, হে লোকসব! আমি তোমাদের কাছে প্রেরিত আল্লাহর বার্তাবাহক; যার মালিকানায় এ আকাশ-জমিন।’ (সুরা আরাফ : ১৫৮)।
সামাজিক বিপ্লব সৃষ্টি: মহানবী (সা.) ছিলেন পরশপাথরতুল্য। যার ছোঁয়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষগুলো সবচেয়ে ভালো মানুষে পরিণত হয়েছে। লুণ্ঠিত সমাজ ফিরে পেয়েছে মানবতা। আশ্রয়হীন সমাজ আশ্রিত হয়েছে নীতিবান এক সমাজে। তিনিই গড়ে তুলেছেন জীর্ণ-শীর্ণ ঘুনে ধরা রাষ্ট্রকে আল্লাহর ইচ্ছে অনুযায়ী একটি আদর্শ রাষ্ট্রে। ঐতিহাসিক বেমন্ডলাজ বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য প্রথম সামাজিক বিপ্লবের সূচনাকারী হলেন ইসলামধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মদ (সা.)।’
আল মুসলিমু আখুল মুসলিম নীতি: প্রিয়নবী (সা.) সমাজ থেকে তুলে দেন ধনী-গরিবের ভেদাভেদ। অবিলম্বে মানুষে মানুষে হানাহানি, বিদ্বেষ দূর করে দেন। সুদৃঢ় করেন মানবতার বন্ধন। ফিরে আসে পারস্পরিক ভালোবাসা, হৃদ্যতা ও সহমর্মিতা। তিনি আরব জাতির মধ্যে গড়ে তোলেন সাম্যের সমাজ। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি ছিল আরবের স্বভাবজাত। গোত্রীয় বৈষম্য ছিল আরবের জঘন্যতম কালচার। গোত্রে গোত্রে সংঘাত, দ্বন্দ্ব সবসময় লেগেই থাকত। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বিবাদ গড়াত বংশের পর বংশ। এমনকি মৃত্যুর সময় অসিয়তনামার প্রথম সারিতে থাকত প্রতিশোধ নেওয়ার কথা। মহানবী (সা.) এ ধারার পরিবর্তন করে কায়েম করেন একটি শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠা করেন ভ্রাতৃত্ববন্ধনের রীতি, ‘আল মুসলিমু আখুল মুসলিম।’ (বোখারি : ২৪৪২)।
আত্মীয়তার বন্ধন নিশ্চিতকরণ: আত্মীয়তার সম্পর্ক কী, তা জানত না আরব সমাজ। সমান্য কারণে আত্মীয়তার বন্ধন ছুঁড়ে ফেলত আস্তাকুঁড়ে। অথচ সুদৃঢ় সমাজ ও সুসংহত রাষ্ট্রব্যবস্থায় আত্মীয়তার বন্ধন আবশ্যক। এজন্য দীপ্তকণ্ঠে প্রিয়নবী (সা.)-এর মুখে উচ্চারিত হলো, ‘যে আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে।’ (বোখারি : ৪৮৩০)।

নেশাজাতীয় দ্রব্য নিষিদ্ধকরণ: মদ হলো সব অনিষ্টের মূল। নেশাগ্রস্ত মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যা খুশি করে বসে। ফলে সামাজিক বিপর্যয় দেখা দেয় চরমভাবে। মদ ছিল আরবের জন্মগত স্বভাব। পবিত্র কোরআনে ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে মদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ফলে সমাজ থেকে অন্যায়-অনাচার দূর হয়। শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসে। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদাররা! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমার বেদি ও জুয়ার তীর অপবিত্র ও শয়তানি কাজ। সুতরাং তোমরা এগুলো পরিহার করো; যেন সফলকাম হতে পারো।’ (সুরা মায়িদা : ৯০)।
সুদ-ঘুষের বদলে ব্যবসা ও করজে হাসানার রীতি: সুদ-ঘুষ ছিল সেকালের মানুষের প্রধান হাতিয়ার। এর মাধ্যমে সমাজের একশ্রেণির লোক সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম করত। ফলে ধনী আরও ধনী হতো। আর গরিব হতো সর্বহারা, অসহায়। মহানবী (সা.) সুদ-ঘুষের প্রথা বন্ধ করে সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবসার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহতায়ালা ব্যবসা হালাল করেছেন, আর সুদ হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)। করজে হাসানার প্রতি মানুষকে উৎসাহী করলেন ব্যাপকভাবে। ঘোষণা করলেন করজে হাসানার ওপর অধিক সওয়াবের কথা। এরশাদ হচ্ছে, ‘যে আল্লাহকে করজে হাসানা দেবে, আল্লাহ তার এই ঋণ শত-কোটি গুণ বাড়িয়ে দেবেন।’ (সুরা বাকারা : ২৪৫)।
শুরা-ই নেজাম প্রতিষ্ঠা: প্রিয়নবী (সা.) রাষ্ট্রীয় বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। সে ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ‘শুরা-ই নেজাম’। তিনি এই শুরা-ই নেজামের মাধ্যমে রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করতেন। আল্লাহতায়ালার নির্দেশও ছিল এমন। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে নবী! আপনি সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শসভা করুন। আর যখন কাজ শুরু করবেন, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৫৯)।
সনদ প্রণয়ন: মহানবী (সা.) পবিত্র কোরআনের নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে মদিনার সব গোত্রের সমন্বয়ে ‘মদিনাসনদ’ নামে একটি সনদ প্রণয়ন করেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত ‘শাসনতন্ত্র’ নামে পরিচিত। (সিরাতে ইবনে হিশাম)।
পররাষ্ট্রনীতি: প্রিয়নবী (সা.) প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়পূর্ণ বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য শান্তিপূর্ণ বিধান নিশ্চিত করেন। ঐতিহাসিক ওয়াই বলেন, ‘মহানবী (সা.) প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ বসবাসের লক্ষ্যে সৎ ও নিরপেক্ষনীতি গ্রহণ করেন। তার পররাষ্ট্রনীতি ছিল যুদ্ধ নয়; শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদারকরণ।’
প্রদেশ বিভক্তিকরণ: মহানবী (সা.) রাষ্ট্রীয় কাজ সম্পাদনের সহজার্থে ও সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য দেশকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রত্যেক প্রদেশের জন্য উপযুক্ত প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও বিচারক নিযুক্ত করেন। ইতিহাসে যা ‘প্রদেশ বিভক্তিকরণনীতি’ নামে অভিহিত। (সিয়ারু আলামিন নুবালা)।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com