‘আমি সব মৌসুমি সবজি পাচ্ছি এবং আমার বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ করে উদ্বৃত্ত আয় করছি।’ গৃহভিত্তিক গ্রামীণ কৃষিকাজের উপকারভোগী নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার মাসুমপুর ইউনিয়নের আটগাছিয়া গ্রামের নূরমহল বেগম এভাবেই তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। নূরমহলের মতো বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ নারী বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ করে খাদ্য তালিকা সমৃদ্ধের পাশাপাশি আর্থিক সুবিধাও পাচ্ছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দেশব্যাপী গৃহভিত্তিক কৃষি প্রযুক্তি এখন গ্রামের দরিদ্রদের পুষ্টি সমৃদ্ধের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নে সহায়তা করছে। ‘বাড়ির আশেপাশে পারিবারিক পুষ্টির লক্ষ্যে বাগান স্থাপন এবং অনাবাদি পতিত জমি প্রকল্প’-এর প্রযুক্তিগত সহায়তায় নূর বেগম তার বাড়ির আশেপাশে ১.৫ ডেসিমেল জমিতে জৈব সবজি উৎপাদন করেন।
তিনি বাসস’কে বলেন, অস্বাস্থ্যকর উপায়ে উৎপাদিত সবজির চেয়ে প্রকল্পের অধীনে উৎপাদিত সবজি তুলনামূলকভাবে ‘সুস্বাদু’ এবং এসবের দামও বেশি। ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার পুটিজানা ইউনিয়নের কমলাপুর গ্রামের আরেক গৃহবধূ নুপুর আক্তার বাসস’কে বলেন, “আমরা ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটাতে বাড়ির আঙিনা থেকে প্রয়োজনীয় সবজি পাই এবং গৃহস্থালি বাগানে উৎপাদিত সবজি বিক্রি করে দেনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করি।”
সবজি চাষের পাশাপাশি ফল চাষে সফল ৩৫ বছর বয়সী ওই নারী আরও বলেন, “আমার বাড়ির বাগানে পঞ্চাশটি মাল্টা ফলের চারা রোপণ করা হয়েছে। এছাড়া পেঁপে, মাল্টা, সফেদা (সাপোডিলা)সহ এলাকাভিত্তিক ছয় ধরনের ফলের চারা লাগানো হয়েছে। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা মেটাতে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী প্রকল্পের আওতায় আ¤্রপালি আম ও পেয়ারার চারা বিতরণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করেছে।”
ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার জেসমিন আক্তার বলেন, ‘এখন আমি অর্থের জন্য আমার স্বামীর আয়ের উপর নির্ভরশীল নই।’
ইউনিসেফের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সী তিন লাখেরও বেশি শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশুরা মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।
‘গুরুতর অপচয় : একটি উপেক্ষিত শিশু বেঁচে থাকার জরুরি’ শিরোনামের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা ৩ লাখ ২৭ হাজার ৮৫৯ সংখ্যক শিশু নিয়ে এ দিক থেকে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে রয়েছে। ভারত এ ধরণের ৫৭ লাখ ৭২ হাজার ৪৭২ শিশু নিয়ে প্রথম এবং পাকিস্তান ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৯২৫ শিশু নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়নে সহায়তার পাশাপাশি গৃহভিত্তিক গ্রামীণ কৃষিকাজ প্রকল্প শিশুদের পুষ্টির চাহিদাও অনেকাংশে মেটাতে সক্ষম হবে।
লাউ, মিস্টি-কুমরা, ঢেঁড়শ, বেগুন, পেঁপে, কাঁচা মরিচ, শসা, কলমি শাক জাতীয় বিভিন্ন জল উৎপন্ন শাক, পালং শাক, লাল শাকসহ বিভিন্ন মৌসুমী সবজি এবং ডাটা শাক, পুঁইশাক বছরে তিনবার উৎপাদন করা হচ্ছে এবং খামার প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারা বছরই কিছু জাতের সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে।
কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ঘাটতির ঝুঁকির আশংকার মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ৪৩৮.৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৪টি জেলার ৪৯২টি উপজেলায় তিন বছর মেয়াদী একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী বলেন, মূলত প্রত্যন্ত অঞ্চলে খাদ্য ঘাটতি প্রশমিত করতে এবং গ্রামীণ দরিদ্রদের পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য কৃষি প্রযুক্তির অধীনে গৃহস্থালীতে ‘পাঁচ শয্যা মডেল’ চালু করা হয়েছে।
কৃষি প্রযুক্তির আওতায় গ্রামীণ সবজি চাষিরা তাদের বসতভিটা বাগানে বিভিন্ন মৌসুমি সবজি চাষের জন্য সারা বছর বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় বীজ, কম্পোস্ট সার ও সেচের সরঞ্জাম পাচ্ছেন।
প্রকল্পের শুরুর পর ড. হোসেন বলেন, সারাদেশে ১.১৩ লাখের বেশি পারিবারিক পুষ্টি বাগান ডেমো প্লট স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে ১ হাজার ৫২০ একরের বেশি পতিত জমিও চাষের আওতায় এসেছে।
কৃষকরা এখন প্রতিদিন ৩৭৮ কেজি সবজি উৎপাদনের প্রত্যক্ষ করছে এবং এ পর্যন্ত ২৬ হাজার ৬৩১ টনের বেশি সবজি উৎপাদন করে তারা ৬৬ কোটি টাকা আয় করেছে এবং ৬.৩ লাখেরও বেশি কৃষক পরিবার সরাসরি উপকৃত হবে।