মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
ভোলার বিভিন্ন চরাঞ্চল অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত লালমোহনে ডা. আজাহার উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের সভাপতিকে সংবর্ধনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের স্মরণে স্মরণসভা সিংড়ায় পরিবেশ রক্ষার্থে ৫৩৬টি ডাস্টবিন বিতরণ কাজী আজিম উদ্দিন কলেজে শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রদলের ৩১ দফা নিয়ে মতবিনিময় সভা পটুয়াখালীতে শিক্ষক দম্পতি হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন টুঙ্গিপাড়ায় ভিক্ষুক ও হতদরিদ্রদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলো সমাজসেবা অফিস জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের আওতায় এনে সহায়ক কর্মচারী অন্তর্ভুক্ত ও বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় গঠনের নিমিত্তে দাবি পেশ দাউদকান্দিতে সড়কের মাটি ধসে পড়ল খালে, দুর্ঘটনার আশংকা সীতাকুন্ডে বিতর্কিত মাদ্রাসা পরিচালকের করা মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে মানববন্ধন

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার গুরুত্ব ও করণীয়

ড. পরিতোষ চন্দ্র রায়
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০২২

বর্তমান সরকার মানবসম্পদকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও বেকারত্ব দূর করতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের তরুণ প্রজন্মকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে দেশের উন্নয়ন কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। নতুন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিলে এক্ষেত্রে তারা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারবেন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যাধুনিক অনেক বিষয় পড়ানো হচ্ছে। অনেক গ্র্যাজুয়েট এখন বিভিন্ন দেশে উচ্চতর গবেষণা করছেন। অনেকেরই বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। বিদেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কোনো কলেজে অধিভুক্তি দিয়ে আধুনিক বিষয়গুলোতে শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ করতে পারে। তাতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের ঘরে প্রযুক্তির আলো ছড়িয়ে পড়বে। দেশের কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে এভাবে প্রযুক্তি শিক্ষার আলো ছড়াতে পারলে সেটা হবে দেশের জন্য ইতিবাচক।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতির কারণে আমাদের জীবনধারায় পরিবর্তন আসছে। আমরা লক্ষ করছি, দৈনন্দিন কর্মকা-ও অধিকতর গতিশীল হচ্ছে? এখন দৈনন্দিন জীবনে সফলভাবে চলতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞানে দক্ষ হওয়ার বিকল্প নেই? কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য যেসব দেশ ৫০ বছর আগেও উন্নয়নের মাপকাঠিতে প্রায় আমাদের কাতারে ছিল, তারা জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আকাশচুম্বী সাফল্য লাভ করেছে? অথচ উন্নয়ন ও উৎপাদনবিমুখ পরিকল্পনার কারণে আমরা পিছিয়ে আছি? অতীতে জাপান, জার্মানি থেকে যে পণ্য আমদানি করা হতো, এখন সেটি করা হচ্ছে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত কিংবা চীন থেকে? বিশেষ করে ভারত সরকার বিদেশিদের কাছে গমের পরিবর্তে বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সহায়তা চেয়েছিল, যার ফলে আইআইটিগুলোর আবির্ভাব এবং সেগুলো আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভারতের পতাকা বিশ্বের সামনে উঁচু করে তুলেছে? স্বাধীনতার সময় যে ভারত ভালো মানের ব্লেড প্রস্তুত করতে পারত না, এখন তারা চাঁদে রকেট পাঠিয়ে পানির অস্তিত্ব খুঁজে পায়? প্রতি বাজেটে আমরা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করি, শিক্ষায় বরাদ্দ সর্বাধিক? কিন্তু মনে রাখতে হবে, শিক্ষায় সাধারণত জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করার পরামর্শ দেওয়া হয়? কিন্তু বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বরাদ্দের সংখ্যা কত, তা আমাদের অজানা নয়। এই সংখ্যা এর চেয়ে কম। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, অনেক স্কুল-কলেজে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নেই। বিজ্ঞান শিক্ষার অবস্থাও ভালো নয়। এই অবস্থার উত্তরণে পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমাদের মনে রাখা দরকার, বিজ্ঞানে বাঙালিদের অবদান কম নয়। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, ড. কুদরত-এ-খুদা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, পিসি রায়, মেঘনাদ সাহা, আব্দুস সাত্তার খান, ডা. শাহ এম ফারুক, ড. মাকসুদুল আলম, ড, জামাল উদ্দিন প্রমুখ বিজ্ঞানী জগদ্বিখ্যাত। কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষার বর্তমান যে দৈন্যদশা, তাতে ভবিষ্যতে ভালো মানের বিজ্ঞানী পাওয়া দুষ্কর হবে। আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগেও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ ছিল, পরীক্ষণের ব্যবস্থা ছিল? এখন পরীক্ষণের সুযোগ নাকি সংকুচিত হয়ে এসেছে? একসময় প্রতিটি স্কুলের শ্রেষ্ঠ ছাত্ররা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য রোমাঞ্চ অনুভব করত, এখন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররা পদার্থবিজ্ঞান কিংবা রসায়নশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে ব্যবসা শিক্ষায় ভর্তি হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা করছেন? ৩০-৪০ বছর আগে এরকম প্রবণতা ছিল না? এতে বোঝা যায়, বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী হওয়ার মতো প্রণোদনা শিক্ষার্থীরা দেখতে পারছে না? সাংহাইয়ের জিয়াওটং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি দুই বছর পর পর অনুষ্ঠিত বিশ্বমানের একটি কনফারেন্সে অংশ নেওয়া স্বনামধন্য শিক্ষাবিদদের স্লোগান, ‘বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে?’ এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্জনের ওপর ভিত্তি করে গণমাধ্যমে বহুল প্রচার নিশ্চিত করে তাদের র্যাংক প্রকাশ করা এবং সে অনুযায়ী পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে? আমাদের বক্তব্য হলো, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেশের দরিদ্র ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত শিক্ষালাভের সুযোগ করে দিতে পারে, তাহলে সেই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাব। একসময় ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ হিসেবে শেরেবাংলা কৃষি কলেজ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ কৃষি কলেজ এবং পটুয়াখালী কৃষি কলেজে অনার্স কোর্স চালু ছিল। পরবর্তী সময়ে এই তিন প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার এই সুদূরপ্রাসারী সিদ্ধান্তের ফসল আজ সবাই ভোগ করছে। কয়েক বছর আগে জামালপুরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেসা মুজিব নামে একটি কলেজও অধিভুক্তি দিয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এটিও বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজকে অধিভুক্তি দিয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি অনুষদের মোট ছয়টি (৬) বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুসরণ করেই সেখানে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। শিক্ষক নিয়োগেও সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। এই উদ্যোগও সাধুবাদযোগ্য। এসব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ভালো মানের বিজ্ঞানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারলে দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা উন্নতি লাভ করবে। বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সমন্বয়ে নিয়োগ বোর্ড গঠন করে লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষা নিয়ে মেধা যাচাই করে বিজ্ঞানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্ধযুগ পরে শিক্ষকদের এখন অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন করা হচ্ছে, শিক্ষক নিবন্ধন সনদ চাওয়া হচ্ছে। এটা কতটা যুক্তিযুক্ত তা ভেবে দেখা দরকার। আমরা চাই যাতে বিজ্ঞান শিক্ষা কোনোভাবে ব্যাহত না হয়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত কলেজ পর্যায়ে বিজ্ঞানে শিক্ষক নিয়োগের সময় প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রকাশনা এবং লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আমরা জানি, বিভিন্ন স্তরের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন নি¤œমাধ্যমিক (অষ্টম শ্রেণি), মাধ্যমিক (দশম শ্রেণি), উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ-দ্বাদশ) এবং স্নাতক (পাশ) স্তরের এমপিওভুক্ত পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য এনটিআরসি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেয়। যিনি যে বিষয়ের শিক্ষক হতে চান এবং যোগ্য, তিনি সেই বিষয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হলে নিবন্ধন সনদ পান। এখন প্রশ্ন হলো, স্নাতক (সম্মান) স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠদানকারী শিক্ষক নিয়োগের জন্য এনটিআরসি কি কোনো নিবন্ধন পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি কখনো দিয়েছে? যদি না দিয়ে থাকে, তাহলে স্নাতক (সম্মান) স্তরের শিক্ষক হওয়ার জন্য আগ্রহী একজন প্রার্থী এই নিবন্ধন সনদ কোথায় পাবেন? আসলে স্নাতক (সম্মান) স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠাদানকারী একজন শিক্ষকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া উচিত, সেই বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রকাশনা থাকা দরকার। সারা দেশে নতুন ও পুরোনো সরকারি কলেজগুলোতে বিজ্ঞানের যে শিক্ষকেরা স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পাঠদান করছেন, তাদের স্কলারশিপ ও শিক্ষা ছুটি দিয়ে পিএইচডি ও পোস্ট ডক করার সুযোগ দেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষকের যোগ্যতা বেশি না হলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিকই পিএইচডি গবেষকদের অনেক গুরুত্ব দিচ্ছেন। পিএইচডি গবেষকদের উৎসাহিত করার জন্য এবং গবেষণায় আকৃষ্ট করার জন্য পূর্বে যে পরিমাণ বৃত্তি দেওয়া হতো, সেটা তিনি স্বেচ্ছায় বাড়িয়ে দিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও কয়েক বছর আগে একটি প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে তাকে একসঙ্গে তিনটি ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হবে। পৃথিবীর অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক হওয়াই যায় না। ঐ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের গবেষণা, প্রকাশনা ও পিএইচডি পোস্ট ডক অভিজ্ঞতাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করা হয়। জ্ঞান পরিমাপের আসলে নির্ভরযোগ্য কোনো মাপকাটি নেই। শিক্ষকতা করার যোগ্যতা মাপা আসলেই কঠিন বিষয়। একজন আদর্শ শিক্ষক হতে হলে অনেক গুণাবলি থাকা প্রয়োজন। তবু প্রযুক্তিগত শিক্ষা দিতে গেলে একজন শিক্ষকের অন্তত উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা বাঞ্ছনীয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার পথ মসৃণ করতে প্রযুক্তিবান্ধব এই সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চয় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। অভিজ্ঞ ও যোগ্য শিক্ষকদের অবশ্যই মূল্যায়ন করবে এটাই প্রত্যাশা করি। লেখক : গবেষক ও শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো-২০২০




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com