সমাবেশের আগের রাতে নেতা-কর্মীদের ঘরে ঘরে পুলিশি অভিযানের অভিযোগ
বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলেন, গতকাল বুধবার বেলা দুইটায় চট্টগ্রাম নগরের পলোগ্রাউন্ড মাঠে দলটির বিভাগীয় সমাবেশ রয়েছে। এ সমাবেশে নেতা-কর্মীরা যাতে অংশ না নেন, সে জন্য তাঁদের ভয়ভীতি দেখাতে গত রাতে বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায়। তবে নেতা-কর্মীদের বেশির ভাগ গত রাতে ঘরে না থাকায় গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছেন। জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দলীয় কর্মসূচিতে গুলি করে নেতা-কর্মীদের হত্যার প্রতিবাদ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিভাগীয় (দলের সাংগঠনিক বিভাগ) পর্যায়ে সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। এদিকে গতকাল বুধবার সকালে নোয়াখালী থেকে সমাবেশে আসার পথে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া গত রাতে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা থেকে আসার সময়ও দলটির নেতা-কর্মীরা হামলা শিকার হন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান গতকাল বুধবার সকালে বলেন, ‘বিএনপি ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ঘরে ঘরে গতকাল রাতে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। কিন্তু আমাদের নেতা-কর্মীরা বিষয়টি আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই অনেকেই গত রাতে ঘরে ছিলেন না। মূলত সমাবেশে অংশ না নেওয়ার জন্য পুলিশ অভিযানের মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখিয়েছে।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, নগরের আশপাশের উপজেলা থেকে আসার জন্য আগেই বাস ভাড়া করা হয়েছিল। কিন্তু গতকাল বুধবার সকালে অনেক বাসচালক বিএনপির নেতা-কর্মীদের নিয়ে আসতে অপারগতা জানান। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা ভয়ভীতি দেখানোয় বাসচালকেরা আসতে চাইছেন না। মোহাম্মদ শাহজাহান আরও বলেন, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সমাবেশে আসার সময় হামলার শিকার হয়েছেন।
বিএনপির নেতারা বলছেন, নোয়াখালীর কবিরহাট থেকে আসার সময় মিরসরাইয়ের নিজামপুর কলেজের সামনে একটি মাইক্রোবাসে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালানো হয়। এতে কবিরহাট পৌর বিএনপির আহ্বায়ক মুস্তাফিজুর রহমানসহ ১০ থেকে ১২ জন নেতা-কর্মী আহত হন। হামলাকারীরা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা। নগর যুবদলের সহসভাপতি দিদারুল ফেরদৌসের বাসা নগরের পাহাড়তলী সিডিএ মার্কেট এলাকায়। তিনি আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে তাঁর বাসায় সাদাপোশাকধারী পুলিশ যায়। এ সময় মায়ের কাছে দিদারুলের অবস্থান জানতে চাওয়া হয়। তিনি বাসায় নেই জানানোর পর পুলিশ চলে যায়। একই এলাকার ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান চৌধুরী ও ওয়ার্ড যুবদলের সহসভাপতি আজিজ চৌধুরীর বাসায় গত রাতে পুলিশ গিয়েছিল বলে তাঁরা অভিযোগ করেন। তাঁরা বাসায় না থাকায় গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছেন বলে জানান।
চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহেদ আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, বাসাবাড়িসহ নগরের বিভিন্ন হোটেলে গতকাল রাতে সাদাপোশাকধারী পুলিশের অভিযান ও নজরদারি ছিল। এ জন্য গত রাতে নেতা-কর্মীরা বাড়ির বাইরে ছিলেন। তাঁরা অবস্থানস্থান পাল্টে রাতটা কাটিয়ে দিয়েছেন। যত বাধাবিপত্তিই আসুক, বিএনপির নেতা-কর্মীরা সমাবেশে অংশ নেবেন।
নগরের মতো জেলার বিভিন্ন স্থানে গত রাতে পুলিশ অভিযান চালায় বলে অভিযোগ করেন বিএনপির নেতারা। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক শাহনেওয়াজ মুন্না, হাটহাজারী উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মিনহাজ মাসুম ও নগরের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড ছাত্রদলের সহসভাপতি নিজামুদ্দিনের বাসায় গতকাল রাতে পুলিশ গিয়েছিল বলে তাঁরা অভিযোগ করেন।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি ইলিয়াস আলী বলেন, তাঁর গ্রামের বাড়ি হাটহাজারীসহ বিভিন্ন উপজেলায় নেতা-কর্মীদের বাড়িতে গত রাতে অভিযান চালায় পুলিশ। তবে তাঁরা কেউ বাসায় না থাকায় তাঁদের ধরতে পারেনি পুলিশ।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) পঙ্কজ দত্ত গত বুধবার সকালে বলেন, বিএনপির সমাবেশ যাতে সুষ্ঠুভাবে হয়, সে জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। গত রাতে পুলিশ কারও বাসায় অভিযান চালায়নি। পুলিশ কাউকে ভয়ভীতি দেখাতেও যায়নি। কারও বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলে সে ক্ষেত্রে হয়তো পুলিশ অভিযানে যেতে পারে। কিন্তু গত রাতে গণহারে গ্রেপ্তারের কোনো তথ্য পুলিশের কাছে নেই।
লড়াই করতেই হবে, মরবো না হয় জিতবো: চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণসমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গিয়েও আমরা স্বাধীন হতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম স্বাধীনতার জন্য। এবার গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, আবার সেই লড়াই করতে হবে। আমাদেরকে লড়াই করতেই হবে, এ লড়াইয়ে জিততেই হবে। এ লড়াইয়ে মরবো না হয় জিতবো।
বুধবার (১২ অক্টোবর) বিকেলে কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণসমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও নেতাকর্মীদের হত্যার প্রতিবাদ এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিভাগীয় গণসমাবেশের আয়োজন করে চট্টগ্রাম বিএনপি।
গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্র রক্ষা করার জন্য আমাদের অনেক ভাই শহীদ হয়েছেন। এ বছরে শহীদ হন ছাত্রদলের নুর আলমসহ আরও অনেক। তারা সবাই তরুণ। এরা সাধারণ মানুষ, এরা বিত্তের অধিকারী নয়, বড় ধন সম্পদের মালিক না। এ দেশকে মুক্ত করতে গিয়ে হানাদারের হাতে তাদেরকে জীবন দিতে হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জে নিহত যুবদলকর্মী সাওনের বাবার বক্তৃতার উদ্ধৃতি দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, সাওনের বাবা বলেছেন- ‘আমি আর কিছু চাই না। আমি এদেশের গণতন্ত্র ফিরে চাই’। মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম স্বাধীনতার জন্য। আবার সেই লড়াই করতে হবে। আমরা যদি জয়লাভ করতে পারি তবে দেশের স্বাধীনতা থাকবে, আর যদি না পারি তাহলে স্বাধীনতা থাকবে না। আমরা মাথা নিচু করে না, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই। জাতিকে এখন অস্তিত্বের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে!
আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ২০১৪ সালে বিনা ভোটে ১৫১ জনকে এমপি করেছিলেন। আর ২০১৮ সালে রাতের আধারে সব ভোটের বাক্স ভর্তি করেছেন।
২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী এজেন্ডার কথা উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, কোথায় ১০ টাকার চাল? এখন তো ৭০ টাকা। সব নিত্যপণ্যের মূল্য এখন ৪-৫ গুণ বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আবার নাকি বিদুতের দাম বাড়ানো হবে। পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ সব কিছুর দাম বাড়ানো হয়েছে। এ দাম বাড়ানোর পেছনে কারণ কি? কারণ একটাই জনগণের পকেট থেকে তারা বিদেশে টাকা পাচার করে। তারা লন্ডনে বাড়ি করে, মালেশিয়ায় সেকেন্ড হোম তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগ বড় গলায় বলে, উন্নয়ন, উন্নয়ন। আমাদের দেশের মা-মেয়েদের কোনো সম্ভ্রম রক্ষা করা যায় না। দিনে দুপুরে মানুষকে হত্যা করে এরা (আওয়ামী লীগ)।
নির্বাচন কমিশনারের কথা ডিসি-এসপিরা শোনেন না উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, তিনি নাকি নির্বাচন কমিশনার!
দেশে বেকারত্ব দূর করার কথা জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা সব সমস্যার সমাধান করে দেশকে উন্নতির দিকে পৌঁছে দেবো। আমাদের পরিষ্কার দাবি। যত মিথ্যা মামলা আছে সব প্রত্যাহার করতে হবে। অবিলম্বে তাদেরকে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে হবে। চট্টগ্রামের প্রলোগ্রাউন্ড ময়দান থেকে যে আন্দোলন শুরু হলো, এখান থেকে সারাদেশব্যাপী তা ছড়িয়ে পড়বে।
সমাবেশ শুরু হবার আগেই পুরো মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। একই সঙ্গে অনেকেই আশেপাশের সড়ক ও বাসাবাড়ির ছাদেও জমায়েত হয়েছেন।
রাজধানী ঢাকার ১৬টি জোনে সমাবেশের পর আজ থেকে চট্টগ্রামের মধ্যদিয়ে বিএনপির চলমান আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপের কর্মসূচি শুরু হলো। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম মহানগরের পলোগ্রাউন্ড মাঠে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় সমাবেশে নেতাকর্মীদের ঢল নামে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিএনপি দেশের নয় এলাকায় গণসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে। যার প্রথমটি হলো আজ। আর শেষ সমাবেশটি হবে আগামী ১০ ডিসেম্বর। ঢাকার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এই সমাবেশ হওয়ার কথা রয়েছে। যেটিকে ‘মহাসমাবেশ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে দলটি।
ঘোষিত এই কর্মসূচির অন্য সমাবেশগুলোর মধ্যে আগামী ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহে, ২২ অক্টোবর খুলনায়, ২৯ অক্টোবর রংপুরে, ৫ নভেম্বর বরিশালে, ১২ নভেম্বর ফরিদপুরে, ১৯ নভেম্বর সিলেটে, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায়, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে ও ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ।