পশ্চিমা দুনিয়া ও মুসলিম বিশ্বের সম্পর্কের মধ্যবিন্দুতে সমন্বয়ী নানা স্মারক রয়েছে প্রতীচ্যের সঞ্চয়ে। যা তার ক্লান্তিহীন শত্রুতার মধ্যে একটু বিরতি এবং বাধাহীন হিংসার মধ্যে খানিক সৌহার্দ্যের পটভূমি রচনা করে। ইসলামকে ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে বিচার করা এবং মুসলিমদের হীন ও হেয় হিসেবে দেখা ও দেখানোর মধ্যেও ভিন্নতা আছে তাতে। এই ভিন্নতা উচ্চারিত হয়েছে পশ্চিমা সভ্যতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নানা কণ্ঠস্বরে, যাদের একজন হচ্ছেন ভিক্টর হুগো। ফরাসি সাহিত্যে ভিক্টর হুগো অগ্রগণ্য একজন। উনিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী রোমান্টিক লেখক বলা হয় তাকে। ইসলামের প্রতি তার আগ্রহ ও অভিপ্রকাশকে বিশেষ নজরে দেখে প্রতীচ্যবাদ। প্রাচ্যকে পাঠ করার আহ্বান তিনি জানিয়েছিলেন সবলে। লেস ওরিয়েন্টাল এর ভূমিকায় লেখেন- ‘চতুর্দশ লুইয়ের সময় সবাই ছিল গ্রিস-বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে প্রাচ্য-বিশেষজ্ঞ হওয়া উচিত এবং এশিয়ার জনগণের সংস্কৃতি ও সাহিত্য থেকে হতে হবে উপকৃত। অতীতে আর কখনো এত বেশি চিন্তাবিদ এশিয়ার সুবিশাল অঞ্চল সম্পর্কে গবেষণায় আত্মনিয়োগের সাহস দেখাননি। এখন তা হচ্ছে আর এর ফলে প্রাচ্যের রঙগুলো আমার সমস্ত ভাবনা-চিন্তা ও কল্পনাকে ছেয়ে ফেলেছে।’ ইউরোপে অনেকেই তাকে ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতির সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছেন। যার নজির আছে ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত Rapport sur le progrès des lettres এ যেমন, ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত quoted in Paul Berret, La Légende des siècles, Mellotée, এ তেমনি। কিন্তু আমরা কি হুগোর কাজকে সেই উচ্ছ্বাসে দেখতে পারি- যখন পাঠ করি তার বিখ্যাত লেস ওরিয়েন্টালস। ১৮২৯ সালে প্রকাশিত এই কাব্য সঙ্কলনে মুসলিমরা কি মধ্যযুগে বহিরাগত আক্রমণকারী হিসেবে চিত্রিত নয়? প্রাচ্যের বহিরাগত সংস্কৃতি দ্বারা পাশ্চাত্যের রোমান্টিকতার প্রতিস্থাপনের বয়ান আছে সেখানে। আছে বিলাসিতা ও নিষ্ঠুরতার চিত্রায়ণ। উসমানী পাশাদের যখন তিনি দেখেন, দেখেন গর্ব-দম্ভ আর তাদের হারেমের সুন্দরী। এ সঙ্কলনের কেন্দ্রে আছে ওসমানীদের বিরুদ্ধে গ্রিকদের বিদ্রোহের প্রতি অভিনন্দন। গ্রিকদের বীরত্বের প্রশংসা। ১৮২১ থেকে ১৮২৯ অবধি ওসমানী-গ্রিক যুদ্ধের পটভূমিতে নিহিত ঘটনা, রঙ, ধ্বনি হুগোর অবিশ্বাস্য প্রভাবক রূপায়ণে বাঙময় হয়েছে। হুগোর এমন বয়ান পশ্চিমে নতুন ছিল না। ইসলামের প্রতি ইউরোপে প-িতি আগ্রহের জন্য বিখ্যাত সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের প্রাচ্যবাদী কাজগুলো হুগোর পূর্ববর্তী-পটভূমিতে ছিল। কিন্তু এর মধ্যেও হুগো স্বাতন্ত্র্য রচনা করেছিলেন মহানবী সা:-এর প্রতি আপন শ্রদ্ধায়, ইসলামের উদার ঐতিহ্যের প্রতি আপন প্রজ্ঞায়। ১৮০২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের বেসানকনে তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন, ফ্রান্স তখন প্রাচ্যতাত্ত্বিক অধ্যয়নে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে ব্রিটেনের সাথে। হুগোর বাবা জোসেফ লিওপল্ড সিগিসবার্ট হুগো ছিলেন সম্রাট নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর একজন মেজর। মা সোফি ট্রেবাচেট এর সাথে হুগোর শৈশব কাটে বিভিন্ন অঞ্চলে। সেনা অফিসার বাবাকে নেপোলিয়নের সেই পলিসি অধ্যয়ন করতে হয়, যা তিনি মুসলিমদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন মিসর জয় ও মিসর শাসনের ক্ষেত্রে।
মা-ও ছিলেন দর্শন সংক্রমিত, জাহাজী পরিবারের কন্যা। শৈশবের পরিবেশ ও বিচিত্র বিহার হুগোর সাহিত্যিক জীবনকে দেয় পুষ্টি। মা এবং ভাইদের সাথে তিনি ঘুরেছেন ফ্রান্সে, ইতালিতে, ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে, স্পেনের রাস্তায়, প্রাচীন গলিতে। আন্দালুস; মুসলিম স্পেনের পুরনো মোহন মায়া সঙ্গীতের মতো তার মনে তুলেছিল ঝংকার। পরবর্তীতে ফ্রান্সের রাজনীতিতে তিনি হন গুরুত্বপূর্ণ একজন। সেনা অফিসার হন, পালন করেন কিং মেকারের ভূমিকা। সংসদ সদস্য হন একাধিকবার, আবার যেতে হয় নির্বাসনেও। প্রভাবশালী বক্তা ছিলেন তিনি। কৈশোর থেকেই ছিল প্রভাবক ভাষা, বিশ্লেষণী মেজাজ। তার সৃষ্টিশীল মনে পড়েছিল রোমান্টিক সাহিত্যের অগ্রপথিক ফ্রাঁসোয়া চ্যাটুব্রায়েন্ডের বিশেষ প্রভাব। শুরু থেকেই তিনি হতে চেয়েছিলেন চ্যাটুব্রায়েন্ডের মতো লেখক।
কিন্তু তাকে তিনি অতিক্রম করলেন অচিরেই। ১৮২২ সালে, ২০ বছর বয়সে প্রকাশিত হলো তার প্রথম কাব্য ‘ওডেস এট পয়েসিস ডাইভারসেস’। রাজা অষ্টম লুই এ জন্য তার নামে জারি করলেন ভাতা। এক বছর পরেই প্রকাশিত হলো তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য হ্যান্ড আইল্যান্ড’। এরপর কাব্যে ও কথাশিল্পে তার বিহার হতে থাকে ক্রমশ বর্ণিল। যদিও দীর্ঘসময় ধরে কবিতাই ছিল তার মনের প্রধান খাবার। ১৮২৯ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যেই তার পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘লা অরিয়েন্টালিস’ ও ‘লা ভক্স ইন্টেরিয়রস’ তৎকালীন ইউরোপের কাব্যজগতে আলোড়ন তোলে। ১৮২৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘ওড টু ব্যালাডস’ নামের কাব্যগ্রন্থ। ১৮২৯ সালে রচনা করেন উপন্যাস ‘দি লাস্ট ডে অব এ কন্ডেমড ম্যান’। ১৮৩০ সালে লিখেন সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘হাঞ্চব্যাক অব নটর ডেম’। এরপর লিখেন বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম ক্ল্যাসিক উপন্যাস ‘লা মিজারেবল’। পুরো উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে জাঁ ভালজাঁর জীবন কাহিনীকে ঘিরে। ১৮৬২ সালে বেলজিয়াম থেকে এক যোগে ৯টি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘লা মিজারেবল’। এর প্রথম প্যারিস সংস্করণ মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ফুরিয়ে গিয়েছিল। সমালোচকদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল অভূতপূর্ব সাড়া। জর্জ মেরেডিথ বইটিকে শতাব্দীর সেরা উপন্যাস বলে দাবি করেন। মিল্টন একে তুলনা করেন পবিত্র বাইবেলের সাথে। ভিক্টর হুগো জানতেন না বইটি বিক্রি হচ্ছে কেমন। প্রকাশককে তিনি চিঠি পাঠালেন শুধু ‘?’ লিখে। প্রকাশক বুঝতে পারলেন প্রশ্নচিহ্নের মানে। অর্থাৎ বিক্রি কেমন হচ্ছে? তিনি জবাবে লিখলেন ‘!’। এর মানে হলো বিক্রি হচ্ছে বিস্ময়করভাবে। এটাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট চিঠি আর তার ক্ষুদ্রতম উত্তর। ১৮৫৮ সাল হুগোর জীবনে বিশেষ মাত্রা নিয়ে আসে। তখন তার বয়স ৫৬ বছর। ইতোপূর্বে আধ্যাত্মিকতা ও রহস্যবাদ সংক্রমিত কয়েকটি বছর তিনি পার করেছেন। ১৮৫৩ থেকে নিয়ে ১৮৫৬ সাল ছিল মনোজাগতিক তোলপাড়ে বিশেষভাবে কম্পমান। তার সেই মনোযাপনের ফসল হিসেবে রচিত হলো এক মহাকাব্য; খধ খবমবহফব ফবং ংরèপষবং (ঞযব খবমবহফ ড়ভ ঃযব ঈবহঃঁৎরবং) বা যুগের কিংবদন্তি। এ সময়ে তিনি লেখেন ÔL’an IX de l’Hégire,Õ যা মুহাম্মদ সা:-এর বর্ণনায় উদ্বেল। লা লেজেন্ডে ডেস সিক্লেস ছায়ার মধ্য দিয়ে মানুষের দিকে তাকায়। এর বিষয় মানবজাতি কিংবা স্বয়ং মানবতা। মুহাম্মদ সা:কে চিত্রিত করার জন্য, তিনি নিজেকে আল কুরআনে এমন এক পর্যায়ে নিমজ্জিত করেন, যেখানে কেউ কেউ তাকে একজন মুসলমান ভেবেছেন। তিনি শেষ জীবনে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন বলে যে জল্পনা রয়েছে, এর মূলে নিহিত আছে এই নিমজ্জন। লা লেজেন্ডে-এর তৃতীয় অধ্যায়ে দীর্ঘ কবিতায় তিনি বয়ান করেন ‘হিজরতের নবম বছর’কে। কবিতাটি শুরু হয়েছে হজরত নুহ নবীর সাথে মহানবী সা:-এর তুলনার মধ্য দিয়ে। কবিতাটি পড়লে মনে হবে হুগো তর্ক করছেন পশ্চিমের সেই সব কবি ও লেখকের সাথে, যারা মহানবী সা:-এর আধ্যাত্মিক ও আসমানি প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ ও বিদ্বেষী। তাদের অসত্য প্রচারকে তিনি করছেন প্রত্যাখ্যান। মহামানবের পবিত্র বৈশিষ্ট্যগুলোর বয়ানে তিনি আন্তরিক।
ভিক্টর হুগো লিখেছেন :
যেন তিনি নিজেই সেই নুহ নবী। তিনি জানতেন মহাপ্লাবনের বৃষ্টিকে।
তিনি ছিলেন সহিষ্ণু বিচারক যখন লোকেরা আসত বিবাদের স্তূপ নিয়ে।
তিনি সুযোগ দিতেন বিচার মানার কিংবা না মানার।
দেখো, অস্বীকারকারী উঠে যাচ্ছে উপহাস করে করে। কিন্তু তিনি সদয়।
তার খাবার ছিল খুব সামান্য এবং কখনো ক্ষুধার কষ্টে পেটে বেঁধেছেন পাথর
নিজেই দোহন করতেন নিজ ভেড়ার দুধ
বি¤œ মানুষের মতো বসতেন মাটির বিছানায়
নিজের পোশাকে তালি লাগাতেন স্বহস্তে তিনি, যখন তিনি যুবক নন, তখনো রোজা থাকতেন দিনের পর দিন,
যেভাবে রোজা রাখতেন পবিত্র রমজানে।
হুগোর কবিতায় বিম্বিত হয় নবুয়তের আগের চিত্র, আল্লাহর নিদর্শন নিয়ে ভাবনা, হেরাগুহা, নির্জন ধ্যান, রহস্যের অনুধ্যান, সৃষ্টিজগতের সত্য চিন্তা।
মহানবীর সা: বৈশিষ্ট্যকে ব্যক্ত করছেন কবি-
মুহাম্মাদ সা: যেন বেহেশত দেখেছেন, দেখেছেন প্রেম, ভবিষ্যৎ ও অতীত
তিনি নীরব থাকতেন আর শুনতেন মূলত
কথা বলতেন সবার শেষে
সকল সময়ে থাকতেন ডুবন্ত প্রার্থনায়।
হুগো বিস্ময়ের সাথে উল্লেখ করেন মহানবীর মহত্ত্ব ও বিনয়। মানুষের উপর এর প্রভাব। তাঁর দয়াস্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব কীভাবে মোহিত করত মদিনার বাতাস! তার ব্যক্তিত্বের বিভা ছিল অবর্ণনীয়। হুগো লেখেন-
ছিলেন প্রশান্ত তিনি
কিন্তু তাঁর দৃষ্টি ছিল সুনীল গগনছোয়া ঈগলের মতো
বাধ্য হয়ে যে নেমেছে মাটির ঠিকানায়।
মহানবীর সত্যস্বরূপ কী? তিনি কিসের উন্মোচক? কার বিঘোষক? কিসের পূর্ণতা বিধানকারী? কী রহস্য তাঁর নবুওতের? হুগো জানাচ্ছেন কাব্যভাষায়। নবীজীর জবানীতে –
আমি তো মহান প্রভুর বাণীর এক কথাশিখা
আমি ছাই, মানুষের রুটির মতন, আমি আগুন নবীদের মতো
আমি জ্যোতির বিকীরণ, আলোকবিস্তার
ঈসা মসীহ ছিলেন আমার ভূমিকা;
ভোরের নূরের মতো, যে বহন করে সূর্যের সুসংবাদ!
মরিয়ম তনয় ছিলেন প্রশান্ত ও অমীয় উক্তিধারী শিশুদের উপমা
নবীজী তেলাওয়াত করতেন আল কুরআন। শুনাতেন সকলকে। জীবনের শেষ লগ্নে যখন অসুখ বেড়ে গেল, মসজিদে এসে বললেন- আমার কাছে যারই কোনো কিছু পাওনা রয়েছে বা অধিকার রয়েছে সে তা এখন আদায় করুক! জনতার হৃদয় কেঁদে উঠল। তারা বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার ওপর আমাদের পাওনা বা অধিকার থাকতে পারে! তিনি বললেন : আল্লাহর কাছে কলঙ্কিত হওয়া তোমাদের কাছে কলঙ্কিত হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন! আমার কাছ থেকে তোমাদের কিছু পাওনা থাকলে তা এখনই আদায় করে নাও, তা যেন শেষ বিচারের দিন বা কিয়ামত পর্যন্ত না গড়ায়।
এক ব্যক্তি দাবি করলেন যে মহানবীর লাঠি একবার তার পেটে লেগেছিল এবং এখন তিনি চান এর প্রতিশোধ! মহানবী তাঁর জামা উপরে তুলে ধরলেন! লোকজন অভিযোগকারীর ব্যাপারে বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তিনি মহানবীর পায়ে পড়লেন ও মহানবীর পেটে চুমো খেয়ে বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার বদন ছুঁয়ে আমি নিজেকে দোজখের আগুন থেকে মুক্ত করছি! হুগো তার কবিতায় এ বিবরণ উল্লেখ করেন সম্মোহক আবেগে। নবীজীবনের শেষ কিছু দিনকে তিনি উল্লেখের ভাষা অনুসন্ধান করেছেন পরম নৈকট্যবোধে। অঙ্কন করতে চেয়েছেন প্রগাঢ় ছবি। কিন্তু বর্ণনার যথার্থতাকে যথাসম্ভব উপেক্ষা না করে। হুগো লেখেন-
নামাজের সময় হলো যেই-
তার মন মসজিদে যেতে চায়।
যদিও তখন রোগে কাবু ছিলেন তিনি,
দাঁড়ালেন তবু আলীর শরীরে ভর করে।
জনতা উদগ্রীব তার অনুকরণের লাগি!
যখন মসজিদে তিনি গেলেন
বাতাসে পতপত করছে পবিত্র পতাকা।
দেহ তাঁর কাঁপছিল, যেন নিখোঁজ ছিল গাত্ররঙ।
মহিমার মুখ তিনি ফেরালেন আর বললেন :
হে মানুষেরা! দিনের যেমন অবসান ঘটে রাতের আঁধারে
মানুষের জীবনও যায় মৃত্যুর সলিলে
আমরা সবাই নশ্বর মাটিরও অধম
কেবল মহান আল্লাহই অবিনশ্বর এবং অদ্বিতীয় একজন
হে জনগণ! বস্তুত মানুষ আল্লাহর পথে চলা ছাড়া
অপদস্থ ও ঘৃণ্য প্রাণী-বিশেষ!
জনতার মধ্য থেকে অন্যতম একজন দাঁড়ান। বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার সত্যবাণীকে পৃথিবী গ্রহণ করেছে। শুনেছে শুধু কান দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে। আপনার সত্যালোকে স্থাপন করেছে প্রগাঢ় প্রতীতি। আপনার মহিমার বিপুল ঔজ্জ্বল্য আপনার জন্ম থেকেই ভাস্বর। যেদিন আপনার জন্ম হয়েছিল, একটি তারকা আকাশে জ্বলে উঠল নতুন আর ধসে পড়ল খসরুর রাজভবনের তিনটি মিনার!
মহানবী সা:-এর ভাবান্তর হলো না তাতেও। হুগোর ভাষায়-
কিছুক্ষণ নবীজী থাকলেন অমেয় নীরবে
নিঃশ্বাসের শক্তি যেন হলো নবায়ন
এরপর বাঙময় হলো ফের মোহন জবান :
বলেন- তবুও বন্ধুরা, সময় হয়েছে বিদায় নেয়ার।
যেতে হবে পরমের পানে।
মহানবী সা:-এর জীবনাবসানের চিত্র হুগোর কবিতায় ফুটে উঠেছে এভাবে :
তখন নেমেছে সন্ধ্যাঘন
দরোজায় দাঁড়ালেন মরণের দূত
প্রবেশের অনুমতি চান তিনি।
নবীজীর সম্মতি পেয়ে ঘরে ঢুকলেন খোদার কর্মী
তারপর-
সবাই দেখলেন
মহানবীর চোখে যেন খেলে গেল
উজ্জ্বল এক বিস্ময়কর বিদ্যুতের ঢেউ
ঠিক সেই জ্যোতির মতো, যা জ্বলজ্বল করছিল তার জন্মের প্রহরে!
এভাবে মুহাম্মাদের (সা:) প্রাণ জীবনের স্রষ্টার কাছে ফিরে গেল।
১৮৫৮ সালের ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর এর মধ্যে তিনি লেখেন ‘খব ঈèফৎব’ কাব্য। এটি লেখেন ওসমানীদের অধীন জেদ্দা শহরে দাঙ্গায় ১৫ জন ফরাসি ও ব্রিটিশ কনসালসহ ২৩ জন ইউরোপীয় নিহত হবার পরে। যখন ফরাসি ও ব্রিটিশ মিডিয়া এর জন্য দায়ী করছিল ইসলামকে। পত্রিকাসমূহ অগ্নিগর্ভ সম্পাদকীয় ও কলাম প্রকাশ করছিল। সংবাদসমূহ পরিবেশিত হচ্ছিল ঘৃণার ভাষায়। বলা হচ্ছিল, মুসলিমমাত্রই খ্রিষ্টানের প্রতিপক্ষ। কিন্তু এই দাঙ্গায় বহু খ্রিষ্টানকে মুসলমানরা রক্ষা করেন। আর দাঙ্গাটি ছিল ব্রিটিশদের সাজানো, এর নায়িকা ছিলেন এলিস এভিলার্ড। সেই এলিস ও তার ভবিষ্যৎ স্বামী মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান কিছু মুসলমানের কল্যাণে। হুগো দেখান, মিডিয়া অন্যায় করছে এবং সেই ধর্মকে নিষ্ঠুরভাবে চিত্রিত করছে, যে ধর্ম সার্বজনীন মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে অবস্থান করে।
হুগো তার Le Cèdre কাব্যে খলিফা ওমর রা:কে চিত্রিত করেন সেই মানবতার প্রতীক হিসেবে। তাঁর এবং সেন্ট জন দ্য ইভাঞ্জেলিস্টের সৌহার্দ্যরে মধ্যে ইসলাম ও খ্রিষ্টবিশ্বের সম্পর্কের স্বরূপ দেখার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে আদম-হাওয়ার আগমন ও জেদ্দা শহরের সাথে এর সম্পর্ক এবং ইউরোপীয় সভ্যতার কাল্পনিক উৎস গ্রিসের মধ্যে একটি রহস্যময় সংলাপ স্থাপন করেন। কবির জেদ্দা হলো ঈভের শহর, যিনি আদিকাল থেকে সব মানুষের জননী। এই শহরে ১৯২৮ সালে ধ্বংস হয় এক সমাধি, পৌরাণিক কাহিনী মতে যা ছিল ঈভের কবর! এসব নিয়েই হুগোর আরব, যেখানে ঈশ্বর স্বপ্নের গভীরে জ্বলজ্বল করেন। আরব ভূমিতে বিচরণ করে কবির মন, যেখানে একদা হেঁটেছে প্রাচীন পয়গাম্বরের কদম। তিনি বলেন,
পবিত্র জেদ্দার কাছে, সমুদ্র সৈকতে ঘুরেছি
লোহিত সাগর থেকে, যেখানে ঈশ্বর স্বপ্নের গভীরে জ্বলজ্বল করেন,
আকাশের ছায়ার একসময়ের কালো মরুভূমিতে,
যেখানে মুসা (আ:) পাড়ি দিয়েছিলেন রহস্যময় পথ!
এভাবে চলতে চলতে সময় একটা
প্রখর ভাবনায় হয় অন্তঃসত্ত্বা।
এই যে ঐতিহ্যের ওপর দিয়ে চলতে চলতে সময়কে অন্তঃসত্ত্বা করতে পারা, এটি ছিল ভিক্টর হুগোর সহজাত সক্ষমতা। যা দিয়ে তিনি রচনা করেন মজলুম এক আবদুল কাদিরের ছবি। পশ্চিম আপন দখলদারি দিয়ে যাকে রক্তাক্ত করেছে! অল্প বয়সেই এই ঐতিহ্যের প্রেমে পড়েন হুগো, যেভাবে অল্প বয়সে ডুব দেন এডেলি ফাউচারের ভালোবাসায়। এডেলির সাথে প্রেমে হুগোর মা ছিলেন নারাজ। যেভাবে মহানবীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে নারাজ ছিল তার প্রতিবেশ। ভিক্টর এডেলিকে বিয়ে করেন এবং ঘর গড়েন গোপনে। ১৮২৩ সালে তাদের প্রথম সন্তান লিওপল্ডের জন্ম হয় এবং পরপরই মারা যায়। এরপর তারা হন আরো চার সন্তানের বাবা-মা। ভিক্টরের প্রাচ্য ও ইসলামলগ্নতার সংসার নানা সীমাবদ্ধতা নিয়েও আজীবন টিকেছিল। ১৮৮৫ সালের ২২ মে প্যারিসে মৃত্যুর আগ অবধি মনোজাগতিক এই আত্মীয়তার অনুশীলন করেছেন হুগো, সাধ্যমতো। একটি কঠোর দৈনিক রুটিন ছিল তার : ভোরবেলা উঠবেন, নিজেকে বরফ-ঠা-া পানিতে ডুবাবেন, কালো কফি পান করবেন, সূর্যের আলোতে একটি গ্লাস গেজেবোতে পা-ুলিপির কাজ করবেন, দুপুরে নাস্তা করবেন, তারপর দ্বীপের চার পাশে ঘুরবেন। তারপর আবার কাজ করবেন সন্ধ্যা পর্যন্ত। পরিবার এবং অতিথিদের সাথে খাবেন, রাত ১০টায় সোজা বিছানায় গিয়ে নিদ্রায় ডুবে যাবেন। প্রতি সোমবার স্থানীয় দরিদ্র পরিবারের চল্লিশজন শিশুকে নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করতেন তিনি। হুগো বলতেন মহাপুরুষদের শিক্ষা তাকে এ কাজে প্রণোদিত করে!
হুগোর মহাপুরুষদের মধ্যে সবার উপরে ছিলেন হজরত মুহাম্মদ সা:।
লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com