সোমবার, ২৭ মে ২০২৪, ০৬:১৬ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
ধনবাড়ীতে নতুন উদ্ভাবন ডায়াবেটিক ধানের পরীক্ষামূল চাষ ঘোড়াঘাটে মাদক বিরোধী অভিযানে ১০ জন গ্রেফতার ফরিদপুরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী পালিত ডিমলায় জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে র‌্যালি ও আলোচনা সভা তীব্র তাপদাহ হাকিমপুরে ৪০০ শিক্ষার্থী পেলো ছাতা সফিউদ্দিন একাডেমিতে কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা ও প্রাক্তন গুণীজন ছাত্রদের সম্মাননা বয়সভিত্তিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ পদক পেলেন গজারিয়ার মাইশা তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে আসা জননেতা মতিয়ার রহমান কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহাদাত হোসেনের সংবাদ সম্মেলন চাটখিলে দাখিল কৃতি শিক্ষার্থীদের সংর্বধনা

দুর্ভিক্ষ আসছে এটা সত্য: সিপিডি

‍ইকবাল হোসেন:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০২২

সারাবিশ্বে ঘটতে যাওয়া খাদ্য সংকটের গতি-প্রকৃতি নির্ভর করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর। চলমান এ যুদ্ধ কেবল খাদ্য ও পণ্য সরবরাহকেই সংকটে ফেলেনি, কৃষি উৎপাদনকে ব্যাহত করেছে। এ দুর্যোগের সমাপ্তি নির্ভর করছে যুদ্ধের সমাধানের ওপর। গতকাল বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) কার্যালয়ে ‘বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আভাস ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ উত্তরণ কোন পথে?’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ অভিমত তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাকিত খাদ্য সংস্থা ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন বলছে, দুর্ভিক্ষ আসছে এবং বিষয়টি সত্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি আবহাওয়া ভিন্ন রূপ হিসেবে বন্যা, খরা বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, কৃষি উৎপাদনে জ্বালানি ও সার ব্যবহার করা হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে শুধু পণ্য সরবরাহে সমস্যা হয়নি, কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। খাদ্য সংকট মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ সাত ধরনের সংকটে পড়েছে বলে মনে করে সিপিডি। সেগুলো হলো ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি, খাদ্য সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট, কোভিড ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সংকটগুলোর মধ্যে ডলার, জ্বালানি, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য সংকটের কারণে অন্য সংকটগুলো আরও ঘনীভূত হচ্ছে। সার্বিকভাবে ওই সাতটি সংকট আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সংকট সমাধানে সুপারিশও দিয়েছে সংস্থাটি। মূল্যস্ফীতির সমাধানে দেওয়া সুপারিশগুলো হলো নতুন ভোগ বাস্কেট করা, প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করা, নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক ও কর কমানো, বাজারে মনোপলি নিয়ন্ত্রণ করা।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, মূল্যস্ফীতির সমাধানে সব শিল্পে ন্যূনতম বেতন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। এছাড়া ব্যক্তিখাতেও যারা কাজ করছেন, তাদের জীবনমানে এত ধস নেমেছে যে, এ আয় দিয়ে তারা চলতে পারছেন না। তাদের বেতনও পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
‘সরকার ওএমএস সহ যেসব পণ্য দিয়েছে, তা সারাদেশে সহজলভ্য করতে হবে। এখানে দুর্নীতি যেন না হয়, সেটাও দেখতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, একেবারেই দরিদ্রদের আর্থিক সহায়তার পরিমাণ কমপক্ষে ১ হাজার টাকা করতে হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।

জ্বালানি সংকট সমাধানে সিপিডি বিভিন্ন কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলনে মনোযোগী হওয়া, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো ও দাতা সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার সুপারিশ করেছে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশে এখন বহুমুখী সংকট রয়েছে ,তাই বহুমুখী নীতিমালাও প্রয়োজন। সব মন্ত্রণালয় এ বিষয়টির সঙ্গে জড়িত। সবার সমন্বয়ে একটি কমিটি থাকা প্রয়োজন। বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারি চাকরীজী বা অন্য পেশার লোকজনকেও এ কমিটিতে রাখা উচিত।
সিপিডির প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় যারা বসবাস করছেন, তাদের খাদ্যপণ্যের তালিকার ১৯টি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য রয়েছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় চার সদস্যের একটি পরিবারের অত্যাবশ্যকীয় সব খাদ্যপণ্যসহ সার্বিক খরচ ছিল ১৭ হাজার ৫৩০ টাকা। ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবরের খাদ্যপণ্যের মূল্য বিবেচনায় এ খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাসিক ২২ হাজার ৪২১ টাকা। অন্যদিকে, যদি মাছ-মাংস বাদ দিয়ে কমপ্রোমাইজড ডায়েটের হিসাবে চার সদস্যের পরিবারের ন্যূনতম খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৯ টাকায়। যা ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি ছিল ৬ হাজার ৫৪১ টাকা।
খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ওপর আমদানি শুল্কের হার কমানো ও বেসরকারি খাতে মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বেতন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, পাঁচ শতাংশ বেতন বৃদ্ধিও যথেষ্ট নয়। ওএমএস কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে। দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষদের নগদ অর্থসহায়তা দিতে হবে। জ্বালানির দাম কমানো, অর্থের জন্য কর, জিডিপি বাড়ানোসহ আরও কিছু পরামর্শ দিয়েছে সিডিপি। বিফ্রিংয়ে উপস্থিত ছিলেন- সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।
সহযোগী জাতীয় দৈনিক বণিক বার্তা গতকাল বৃহস্পতিবার ‘অর্থনৈতিক ভিত্তির বৈচিত্র্য কমেছে: প্রবৃদ্ধির প্রধান প্রভাবক এখন অবকাঠামোগত বিনিয়োগ’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে দেশের অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরছে। প্রদিবেদনটি দৈনিক খবরপত্রের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো,“দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নীতি সংস্কার হয় নব্বইয়ের দশকে। এসব সংস্কারের মধ্য দিয়ে অর্থনীতির ভিত্তিগুলোও হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যপূর্ণ। সংস্কারগুলোর মাধ্যমে দেশের বেসরকারি খাতেরও বড় ধরনের বিকাশ ঘটেছিল। এর পরের সময়টিতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ। বর্তমানে এ অবকাঠামোগত বিনিয়োগকেই দেখা হচ্ছে প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে। এতে আপাতত উচ্চপ্রবৃদ্ধি মিললেও বৈচিত্র্য হারিয়ে অনেকটাই এককেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে অর্থনৈতিক অগ্রগতি।
বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নব্বইয়ের দশকে নানামুখী সংস্কারের মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধির যে বৈচিত্র্যপূর্ণ ভিত্তি দাঁড়িয়েছিল, সেটি এখন অনেকটাই অনুপস্থিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বড় প্রবৃদ্ধির দেখা মিললেও অর্থনীতি হয়ে পড়েছে অনেকটা এককেন্দ্রিক। কর্মসংস্থান তৈরিতে এর কোনো প্রভাবও দেখা যাচ্ছে না। মানবসম্পদ উন্নয়ন বা প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর দিক থেকেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে সামনের দিনগুলোয় দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির টেকসই ধারা ধরে রাখা যাবে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। গত চার দশকে দেশে কোন ধরনের নীতি সংস্কার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ রবার্ট সিএম বেয়ার এবং ইউনিভার্সিটি অব গ্রোনিংগেনের সহকারী অধ্যাপক ও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক কনস্ট্যান্টিন এম ওয়াকার। তাদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, বিভিন্ন খাতে পরিচালনাগত দুর্বলতা বা সুশাসনের ঘাটতি এবং দক্ষ মানবসম্পদের অভাব সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনেক উচ্চপ্রবৃদ্ধির দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ। এ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তি এখন অনেকটাই এককেন্দ্রিক। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মূলত অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ওপর ভর করেই এগিয়ে চলেছে অর্থনীতি। আর্থিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এ প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখলেও তা একেবারেই যৎসামান্য। এ সময় বেসরকারি খাতের অগ্রগতিও হয়েছে মূলত সরকারের অবকাঠামো বিনিয়োগে ভর করে। বাণিজ্য ও বিদেশী বিনিয়োগের মতো অন্যান্য প্রভাবকের অবদানের মাত্রাও এখন আগের চেয়ে নেতিবাচক পর্যায়ে এসে নেমেছে। ‘গুড এনাফ ফর আউটস্ট্যান্ডিং গ্রোথ: দি এক্সপেরিয়েন্স অব বাংলাদেশ ইন কম্প্যারেটিভ পার্সপেক্টিভ’ শিরোনামে তাদের এ পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হয়েছে।
দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রভাবকগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছে নব্বইয়ের দশকে। বাণিজ্য ও বিদেশী বিনিয়োগ সে সময়কার প্রবৃদ্ধিতে বড় অবদানও রেখেছে। বাণিজ্য খাতে উদার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের কারণে তৈরি পোশাক খাতের রফতানিতেও বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা যায়। এর ধারাবাহিকতায় মোট জিডিপিতে রফতানির অবদানও বাড়তে থাকে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি দেশের মোট জিডিপিতে রফতানির অবদান ছিল ১০ শতাংশ। ওই সময়কার ব্যাপক সংস্কারের ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের মধ্যে এ হার দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় ২০ শতাংশে। আবার আগের দুই দশকের দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করে নব্বইয়ের দশকে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকেও মনোযোগী হয়ে ওঠে সরকার। এজন্য নীতিগত সংস্কারের পাশাপাশি প্রণোদনামূলক নানা উদ্যোগও নেয়া হতে থাকে। এর ফল হিসেবে জিডিপিতে বিদেশী বিনিয়োগের অবদানও বাড়তে থাকে।
দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিগুলোকে কেন্দ্র করে সে সময় যে বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কার কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই অনুপস্থিত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, গত এক-দেড় দশকে প্রবৃদ্ধির দারিদ্র্য স্থিতিস্থাপকতা (পভার্টি ইলাস্টিসিটি অব গ্রোথ) কমেছে। দারিদ্র্য কমিয়ে নিয়ে আসার হার শ্লথ হয়েছে। প্রবৃদ্ধির কর্মসংস্থান স্থিতিস্থাপকতাও (এমপ্লয়মেন্ট ইলাস্টিসিটি অব গ্রোথ) শ্লথ হয়েছে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য সেগুলো অর্জন হচ্ছে না। এটা বেশ পরিষ্কার যে উন্নয়নের লক্ষ্য একমুখী। তা টেকসই হওয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। বলা হতে পারে যে প্রভাবগুলোর বহিঃপ্রকাশ বিলম্বিত হবে, কিন্তু সেটা খুব পরিষ্কার নয়। আবার অবকাঠামোর মাধ্যমে কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধি কেন হচ্ছে না, সে প্রশ্নও রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নের সময় এক ধরনের কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু ব্যবহারের সুশাসনে কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ঢাকা-চট্টগ্রামে অবকাঠামো বাড়ালাম, কিন্তু সুশাসনে উন্নতি করলাম না। সুশাসনের উন্নতি না হওয়ার কারণে অবকাঠামোর যে রিটার্ন সেটাও কম। আরেকটি বিষয় হলো অবকাঠামো করা হচ্ছে, কিন্তু সেটিও পরিকল্পিত নয়। এমন চিত্র বিদ্যুতেও দেখা যাচ্ছে, আবার সড়ক অবকাঠামোর ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বিষয়গুলো নিয়ে পুনরায় ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। কিছু কিছু নতুন খাত এসেছে, কিন্তু সেগুলো প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তির জায়গায় এখনো যায়নি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তিগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ হচ্ছিল। কিন্তু গত এক দশকে মনোযোগ ছিল অবকাঠামো ঘিরে। অর্থাৎ মনোযোগ ছিল একমাত্রিক। অন্যদিকে প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির বাস্তবতা থেকে আমরা পিছু হটেছি। এখানে মনোপলিস্টিক অথবা অলিগোপলিস্টিক কন্ট্রোল অব ক্রিটিক্যাল স্ট্রাকচার প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। ফলে নতুন প্রবৃদ্ধির ভিত্তি বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়নি।
আশির দশকের শেষ দিকে প্রায় দেউলিয়াত্বের পথে ছিল দেশের ব্যাংকসহ সার্বিক আর্থিক খাত। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে কাঠামোগত সংস্কারের কারণে এ পরিস্থিতি থেকে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়ায় আর্থিক খাত। আবার ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা তৈরি পোশাক রফতানি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে। এছাড়া এ সময় সুদহার, ব্যাংক খাতের কার্যপদ্ধতি, মূলধন পর্যাপ্ততার নীতির প্রয়োগসহ সার্বিক আর্থিক খাতের নানামুখী সংস্কারও গ্রহণ করা হয়। এছাড়া নিয়ন্ত্রিত সরকারি ভোগ ব্যয় ও মূল্যস্ফীতিও প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে বড় ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী এক দশক ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার যুগ। এরপর আশির দশকের শুরুতে ব্যাপক বিরাষ্ট্রীয়করণের মধ্য দিয়ে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমের সূচনা ঘটে। মূলত ১৯৮৫ সালের পরই এর ফলাফল দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করে। আবার এ আশির দশকেই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়।
মূলত এ ভারসাম্যহীনতাই নব্বইয়ের দশকে নীতিগত সংস্কারের মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষাকে সরকারের মনোযোগে নিয়ে আসে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, দেশের মূল্যস্ফীতি, বাজেট ঘাটতি ও বৈদেশিক ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রবণতাটি ওই সময়েই তৈরি হয়। আবার মাঝামাঝি সময়ে কিছুদিনের হরতাল-অবরোধ ছাড়া ওই দশকটি রাজনৈতিকভাবেও ছিল মোটামুটি স্থিতিশীল। বৈচিত্র্যপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে নব্বইয়ের দশকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার যে ভিত্তি তৈরি হয়েছিল, অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে সে বৈচিত্র্য এখন আর নেই। অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগই এখন প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, অবকাঠামো উৎপাদনের উপকরণ হলে খুবই ভালো। কিন্তু উৎপাদনের উপকরণ না হয়ে বসে থাকলে এটিকে অর্থনীতিতে বলা হয় ডেডওয়েট লস ইজ ভেরি হাই (বাজার অদক্ষতাসৃষ্ট সামাজিক ক্ষতি অনেক বেশি)। যেমন বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বলা যায় উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু জ্বালানি ও স ালন সক্ষমতা বাড়েনি। এতে ডেডওয়েট লস বেড়েছে এবং সামাজিক কল্যাণ কমেছে। এ অর্থ অপরচুনিটি কস্ট (সুযোগ ব্যয়) হিসেবে অন্য খাতে ব্যয় করা যেত। আবার পরিবহন খাতে ব্যয় না কমলেও বিনিয়োগ অনেক হয়েছে। কিন্তু যানজট কমেনি। তার মানে কর্মঘণ্টা উৎপাদনশীল হয়নি। তৃতীয় উদাহরণ হলো রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফা) সংক্রান্ত। যেহেতু বাস্তবায়ন সক্ষমতা অনেক কম, ফলে কস্ট ওভাররান (অপ্রত্যাশিত বা অতিরিক্ত ব্যয়) হচ্ছে। এখানে আমরা তিনটি বড় ঝুঁকি দেখলাম, যা প্রলম্বিত হচ্ছে। একই সঙ্গে সামাজিক কল্যাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেয়া যাচ্ছে না বিনিয়োগের প্রকৃতির কারণে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল উন্নয়নের ‘বাস্কেট কেস’ হিসেবে। সেখান থেকে যাত্রার পর বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পথে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পরিচালনাগত বা সুশাসনের ঘাটতি ও দক্ষ মানবসম্পদের অভাবকে সঙ্গে করেই মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ যে উচ্চপ্রবৃদ্ধির হার অর্জন করেছে, সেটি এখন পর্যন্ত অনেকটাই ব্যাখ্যাতীত এবং এ নিয়ে আরো গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন।
এ বিষয়ে তাদের ভাষ্য হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যকে কোনোভাবেই সামষ্টিক অর্থনীতির একক একটি তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। দেশটির শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার বড় একটি সময় পার হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে। প্রাতিষ্ঠানিক পারফরম্যান্স এখনো অনেক দুর্বল। একটি দেশের আয়ের মাত্রা ও উন্নতি অনেকাংশে নির্ভর করে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বা মানের ওপর। বিষয়টির সপক্ষে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। যদিও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এর বিপরীত। উচ্চপ্রবৃদ্ধির আরেকটি বড় উৎস হলো দক্ষ মানবসম্পদ। যদিও এ দক্ষ মানবসম্পদের অভাবকে সঙ্গে করেই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার পুরো সময় এগিয়েছে বাংলাদেশ। একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি রফতানির বৈচিত্র্য ও বহুমুখিতার ওপরেও অনেকাংশেই নির্ভরশীল। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রফতানিনির্ভরতা থাকলেও তা পুরোপুরি তৈরি পোশাককেন্দ্রিক, যেটি আবার মূল্য সংযোজনের দিক থেকে একেবারেই পিছিয়ে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, শুধু অবকাঠামো দিয়ে টেকসই প্রবৃদ্ধি হবে না। এক্ষেত্রে দেখার প্রয়োজন হলো প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তিগুলো কী? আশির দশকের প্রবৃদ্ধিতে স্থবিরতা বিরাজ করছিল। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকঅফ করতে শুরু করেছে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। এ সময় অবকাঠামো উন্নয়ন অবশ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখেছে, কিন্তু তা মূল চালিকাশক্তি ছিল না। গত এক দশকে অনেক ধরনের সরকারি বিনিয়োগ হয়েছে। এগুলোর সুফল পাওয়ার সময় এখনো আসেনি। আবার অনেক সরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিকে টেকসই না করে বরং ক্ষতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখনো নিজের সম্ভাবনাগুলোর সবটুকু কাজে লাগাতে পারেনি। এখনো দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণের হার সমজাতীয় দেশগুলোর চেয়ে অনেক শ্লথ। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশের মাথাপিছু জিডিপির আকার বেড়েছে চার গুণ। যদিও একই সময়ে প্রতিবেশী ভারতে তা পাঁচ গুণ বেড়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও চীনে এ বৃদ্ধির পরিমাণ যথাক্রমে ছয় ও ৩০ গুণ। ১৯৮৪ সালের পর থেকে ভিয়েতনামে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ বেড়েছে পাঁচ গুণ, যেখানে বাংলাদেশে এর পরিমাণ ৩ দশমিক ৪ গুণ। এছাড়া দক্ষ মানবসম্পদের অভাব ও পরিচালনাগত দুর্বলতা ছাড়াও আর্থসামাজিক অনেক দিকেই এখনো অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ, যা সামনের দিনগুলোয় গত কয়েক বছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাকে রুদ্ধ করে দিতে পারে। বাণিজ্য খাতেও এখনো অনেক জটিলতা রয়ে গিয়েছে। এ প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে হলে বাংলাদেশকে নিজস্ব সম্ভাবনার পুরোটাকেই কাজে লাগাতে হবে।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, আমাদের দ্রুত প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো আমাদের সড়ক জনপথের ব্যাপক উন্নয়ন। উপজেলা, জেলাসহ সারা দেশে শহর-বন্দর, গ্রাম সড়ক জনপথের আওতায় এসে যাওয়ায় বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। এটি শুধু জনচলাচল এবং পণ্য চলাচলকে ত্বরান্বিত করেছে তা নয়; প্রচুর কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলো অবকাঠামো সৃষ্টি হওয়ার ফলেই হয়েছে। আমাদের উন্নয়নে গতি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো সড়ক জনপথের সংযুক্তি এবং গ্রামা ল পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। ফলে সব পণ্যের উপকরণের বাজার ব্যবস্থা সমন্বিত হয়েছে। সমন্বিত হওয়ার ফলে বাজারের পরিবহন ব্যয় কমে তুলনামূলকভাবে সস্তায় পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। যে পণ্য ঢাকায় পাওয়া যায়, গ্রামা লেও একই পণ্য পাওয়া যায়। সেটা ভোগের পণ্য হোক বা ব্যবহার্য পণ্য হোক। প্রবৃদ্ধির উল্লম্ফনের কারণের মধ্যে আরো আছে আমাদের বিদ্যুতের ব্যাপক বিস্তৃতি। শহর থেকে গ্রামের সব ক্ষেত্র বিদ্যুতের মাধ্যমেও সমন্বিত হয়েছে। দুটো ব্যাপক সাফল্য ও বিস্তৃতি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের হারকে ত্বরান্বিত করেছে। সড়ক ও বিদ্যুতের মতো ভৌত অবকাঠামোর পাশাপাশি আমরা যেটা করেছি সেটা হলো কারিগরি শিক্ষা ও প্রযুক্তিশিক্ষারও ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে গত দেড় দশকে। ফলে জনসম্পদ সৃষ্টি, বিদ্যুৎ, শিক্ষা অবকাঠামো হলো আমাদের প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। প্রবৃদ্ধিটা এ কারণেই অনেক টেকসই হয়েছে। তা না হলে কভিড ও বর্তমান যুদ্ধাবস্থায় আমাদের পরিস্থিতি আরো বিপর্যস্ত হতে পারত। মানোন্নয়নের অনেক দিক রয়ে গিয়েছে। কিন্তু সংখ্যাগতভাবে যে বিস্তৃতি হয়েছে, সেটাও বিশাল অর্জন। অর্থনীতি অনেক ডাইভার্স হয়েছে, কয়েক মিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করতাম। সেই পোশাক রফতানি থেকেই ৪২ বিলিয়ন ডলার অর্জন করেছি। আরো বিস্তৃতি হতে পারত, কিন্তু যতটুকু হয়েছে, বৈচিত্র্যায়নের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।”




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com