আন্তর্জাতিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থা গঠনের ধারণাটি প্রথম আসে মার্কিন কৃষিবিদ ডেভিড লুবিনের মাথায়। ১৯৪৫ সালের ১৬ অক্টোবর কানাডার কুইবেক শহরে ‘আন্তর্জাতিক কৃষি ইনস্টিটিউট’ গঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আনুষ্ঠানিকভাবে এ সংগঠনের ইতি ঘটে। পরে এটি খাদ্য ও কৃষি সংস্থা নামে আত্মপ্রকাশ করে। কৃষিকে কেন্দ্র করে বিশ্বের মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান, দরিদ্র ও পুষ্টিহীনতা দূর করে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৪৫ সালের ১৬ অক্টোবর জন্ম নেয় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএও। লাতিন ভাষায় এর স্লোগান ‘ফিয়াত পানিস’ অর্থাৎ-‘সবার জন্য রুটি’। বর্তমানে ১৯৭টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে পরিচালিত এফএওর মূল সদস্য সংগঠন হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মূলত সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থের বিনিময়েই এফএও পরিচালিত হয়। ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০তম সাধারণ সভায় হাঙ্গেরির তৎকালীন খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. প্যাল বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি পালনের প্রস্তাব করেন ও তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে সারা বিশ্বের ক্ষুধা, স্থূলতা এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতি বছর আনুষ্ঠানিক প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ পালন করা হয়। বিশ্ব খাদ্য দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো-ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা, কৃষির উন্নতিতে মনোযোগ দেওয়া, কৃষিভিত্তিক উৎপাদনে উৎসাহ দান করা, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহায়তা গ্রহণে উৎসাহ প্রদান, গ্রামীণ মানুষ, মূলত নারী ও কম উন্নত মানুষদের অবদানে উৎসাহ দান ও প্রযুক্তির সমৃদ্ধিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া। এফএও এর-৭৭তম জন্মবার্ষিকীতে বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২২ সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবে ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কেননা, এ বছর বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারি থেকে যখনই বিশ্ব উত্তরণের পথে, ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যের অপ্রতুলতা ও সরবরাহ বিঘœতা ভিন্নভাবে উপলব্ধি করছে সারা বিশ্ব। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালন করা হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ও বালাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় সেমিনার, কারিগরি সেশন ও জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রকার কর্মসূচি নিয়ে দিনটি পালন করে থাকে। বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২২ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে-Leave no one behind. Better production, better nutrition, a better environment and a better life; যার অর্থ হলো-‘কাউকে পেছনে রেখে নয়। উত্তম উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, একটি উত্তম পরিবেশ ও উন্নত জীবন’। বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় সরাসরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে জড়িত। কাউকে পেছনে রেখে নয়, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা, যার মাধ্যমে ভালো পুষ্টি, ভালো পরিবেশ ও ভালো জীবন নিশ্চিত করা যাবে। উত্তম কৃষিচর্চার মাধ্যমে উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, পরিবহণের মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও পুষ্টি বজায় থাকবে। ফসলের নিবিড়তা বাড়িয়ে কিংবা নতুন নতুন কলাকৌশল ব্যবহার করে জনবহুল বাংলাদেশে ক্রমহ্রাসমান জমি ব্যবহার করে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে। ইতোমধ্যে বসতবাড়িতে সবজি চাষ, কৃষিপণ্যের রপ্তানি রোডম্যাপ, হাইব্রিড ধান রোডম্যাপ, উত্তম কৃষি চর্চা ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
এফএও বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দুই ধরনের দেশেই আধুনিক ও উন্নত কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য চাষে সহায়তার মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। তাই বিভিন্ন দেশে কৃষি ও কৃষির সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে এ সংস্থাটি বিশ্বের বহু আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে মিলে নানা প্রকল্প হাতে নেয় এবং কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে যেন সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তার সুযোগ তৈরি হয়। সংস্থাটির নিরলস প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী যে সাফল্যগুলো অর্জিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-৩০টিরও বেশি দেশের সাংবিধানিক কাঠামোতে জনগণের জন্য খাদ্য লাভের অধিকারকে প্রধান মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি ও নিশ্চিতকরণ, সবার জন্য নিরাপদ ও ভালো খাদ্য নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মানদ- কোডেক্স অ্যালিমেন্টারিয়াস তৈরি, অবৈধ মাছ ধরার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রণয়ন, গবাদিপশুর মারাত্মক ভাইরাল রোগ রেন্ডারপেস্ট নির্মূলকরণ, লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা, খাদ্য ও কৃষিতে বিশ্বের বৃহত্তম এবং সর্বাধিক বিস্তৃত পরিসংখ্যানীয় ডাটাবেজ বজায় রাখা প্রভৃতি। এ ছাড়া ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত ‘সহস্রাবদ্ধ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ বাস্তবায়নে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ বাস্তবায়নে সংস্থাটি ফলপ্রসূ সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য অন্যতম। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা অধ্যুষিত বিশ্বের সাড়ে ৭শ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১৩.৫ কোটি এখনো খাদ্যের অভাবে ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে ধুঁকে মরছে। তাই গত কয়েক দশকে পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চাষযোগ্য জমি সংরক্ষণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, কৃত্রিম বনায়ন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কর্মকা-ের মাধ্যমে পৃথিবীর সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ, বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকটি বিষয়ের পাশাপাশি সবার জন্য ‘খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ’ এখন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যের মধ্যে একটি। করোনা মহামারির কারণে শহর ও গ্রামাঞ্চলে লাখ লাখ মানুষের খাদ্য সুরক্ষা ব্যাহত হয়েছিল। লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারানোতে খাদ্য সমস্যাটি দ্বিগুণ কঠিন হয়ে উঠছিল বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও। কিন্তু তীব্র সংকটময় এ পরিস্থিতেও বাংলাদেশের অবস্থা ছিল স্বাভাবিক। বিগত ৪০ বছরে কৃষিক্ষেত্রে ও খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বিশেষত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আবাদযোগ্য জমি হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাপ বাড়ার চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বাংলাদেশ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছে। বাংলাদেশের এ অর্জন অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর জন্য রোল মডেল ও উদাহরণ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে এবং স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বছরের প্রাক্কালে একটি অর্জন হলো, ২০২২ সালে এফএওর ৩৬তম এশিয়া-প্যাসিফিক আঞ্চলিক সম্মেলন আয়োজন করা।
১৯৭৩ সালে খাদ্য ও কৃষি সংস্থাতে যোগদানের পর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ এ আঞ্চলিক সম্মেলন আয়োজন করতে পেরেছে। ঢাকায় ৩৬তম অধিবেশনে এ অঞ্চলের দেশগুলোর অর্জন, সাফল্য, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন বিষয়ে মতবিনিময় ও পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে বলে আমার বিশ্বাস। বর্তমান বিশ্বের প্রতি নয়জনে একজন অপুষ্টির শিকার। এ হিসাবে অপুষ্টির শিকার মোট জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৭৯ কোটি ৫০ লাখ। এ জনগোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশের বসবাস এশিয়া মহাদেশে। সারা বিশ্বে প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করে এমন ৬ কোটি ৬০ লাখ শিশু পেটে ক্ষুধা নিয়ে স্কুলে যায়। আবার বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের কর্মসংস্থান আসে কৃষি থেকে। কৃষিকাজে নারীর অংশগ্রহণের তাৎপর্য হচ্ছে-কৃষিতে নারীরা যদি পুরুষের সমানভাবে অংশ নেন, তা হলে বিশ্বে ক্ষুধার্ত লোকের সংখ্যা ১৫ কোটি পর্যন্ত কমতে পারে। করোনা মহামারির প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা দূর করে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করে কৃষিতে টেকসই উন্নয়নের জন্য এফএওর সুপারিশক্রমে প্রণীত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার’ আটটি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বিশ্বের সব দেশকে একে অপরকে সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে কাজ করে যেতে হবে। তন্মধ্যে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু থেকে শুরু করে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা সবার ক্ষুধা দূর করা, অপুষ্টির শিকার ৫ বছরের কম বয়সি শিশু, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে, গর্ভবতী ও বুকের দুধ দানকারী নারী এবং বয়স্ক ব্যক্তিসহ সব মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কৃষি উৎপাদন ও কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা, টেকসই কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কৃষি উৎপাদনে পরিবেশের ভারসাম্য নিশ্চিত করে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রতিকূল আবহাওয়া, বন্যা, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাতে ফসল টিকে থাকতে পারে তা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ অবকাঠামো, কৃষিভিত্তিক গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করা, বিশ্ব কৃষি বাজারে অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ ও কৃষিপণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অহেতুক নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা এবং বিশ্ব খাদ্যপণ্যের বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখতে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে বিশ্ব খাদ্য দিবস পালন যথার্থতা লাভ করবে।
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিশ্বব্যাপী কৃষিক্ষেত্রে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। যদিও চাহিদার দিক বিবেচনা করলে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন যথেষ্ট, তবুও সার্বিক খাদ্যব্যবস্থায় রয়ে গেছে অসমাঞ্জস্যতা। খাদ্যব্যবস্থার সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে ক্ষুধা, অস্বাভাবিক স্থূলতা, পরিবেশগত অবক্ষয়, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, খাদ্য ও বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা, খাদ্যশৃঙ্খল কর্মীদের সুরক্ষার অভাব ইত্যাদি। এসব নানা সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন কোভিড-১৯-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রয়োগের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তখনই শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ কারণে সৃষ্টি হয়েছে এক ভিন্ন চিত্র। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ার চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন রূপ নিয়েছে কোভিড-পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি, সার ও খাদ্যের দামের ভারসাম্যহীনতার কারণে। প্রধান কারণগুলো হলো রাশিয়ার ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, ইউক্রেনের উৎপাদিত কৃষি ও খাদ্যপণ্য পরিবহণ করতে না পারা এবং চীনের শূন্য কোভিড পলিসি। এতে তৈরি হয়েছে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বিশ্বজুড়ে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বাড়তে পারে; সেই সঙ্গে ২০২৩ সালে দেখা দিতে পারে বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ।
কোভিড-১৯-পরবর্তী মূল্যস্ফীতি আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা, দারিদ্র্য, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ফেলতে পারে বিরূপ প্রভাব। তৈরি করতে পারে সামাজিক অস্থিরতা, বাধাগ্রস্ত করতে পারে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি হয়েছে মূলত সরবরাহে বিঘœ ঘটার কারণে। তাই ‘কাউকে পেছনে রেখে নয়, উত্তম উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, একটি উত্তম পরিবেশ ও উন্নত জীবন’-এ লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়কে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করার মাধ্যমে এ লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে, সে বিষয়ের ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে হবে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব নীতি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের মাটি উর্বর, ফলে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি সহনশীল সীমার ভেতরে রাখা যাবে, অর্জন করা যাবে উত্তম উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, একটি উত্তম পরিবেশ ও উন্নত জীবন। সামনে বোরো মৌসুম; তাই সার, সেচসহ সব ধরনের গুণগত উপকরণের সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করা প্রয়োজন। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে কৃষি জমির মালিকানা সংস্কারের মাধ্যমে কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে আমাদের সে বিষয়েও নজর দিতে হবে, যাতে করে প্রধান প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনা যায়। মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশি কষ্টের সম্মুখীন হতে হয় নিুআয়ের মানুষদের। তাদের রক্ষার জন্য আমাদের নিশ্চিত করতে হবে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগপণ্যের সরবরাহ। তার জন্য উৎপাদনের পাশাপাশি সরবরাহ চেইনে বিদ্যমান সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। বাড়াতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী। কমানো যেতে পারে আমদানিকৃত পণ্যের ভ্যাট ও শুল্ক, যাতে করে খাদ্যপণ্যের দাম নিুআয়ের মানুষদের জন্য থাকে সহনশীল। চলমান প্রতিকূলতার মাঝেও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ ক্ষুধামুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমেই অর্জিত হবে চূড়ান্ত সফলতা-বিশ্ব খাদ্য দিবসে রইল এ প্রত্যাশা। ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : প্রফেসর, কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
mjahangir.alam@bau.edu.bd