১৮৪৯ সালের ২৯ মার্চ, শিখ ইতিহাসের একমাত্র রাজ্যের অন্তিমক্ষণ। মসনদ ছাড়েন ১১ বছর বয়সী মহারাজা দিলীপ সিং, যা আর কখনো উদ্ধার করা যায়নি। এদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয় পাঞ্জাব। যার ফলশ্রুতিতে ভূবন-বিখ্যাত কোহিনুর হীরা রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে হস্তান্তর হয়। সেদিন গ্লানি ও ক্ষোভ নিয়ে অস্ত্র জমা দেন মহারাজার অনুসারীরা। শিখ ঐতিহ্য অনুসারে ‘খালসা’ নামে পরিচিত সেনারা এতদিন পর দিলীপের বাবা রণজিৎ সিংয়ের অভাব বুঝতে পারলেন। খালসারা বরাবরই প্রয়াত রণজিতের ছায়া দেখতে পেতেন তার ছেলের মাঝে। কিন্তু তা ছিল নিতান্তই অতি প্রত্যাশা। ১৭৯৯ সালে রণজিৎ সিং পাঞ্জাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিখ রাজ্য। পিতা ও ভাইয়ের মৃত্যুর পর ১৮৪৩ সালে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই মসনদে আরোহন করেন দিলীপ। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ বুঝে ওঠার আগে ছেড়েও দিতে হলো, তখন তার বয়স ১১ বছর। ব্রিটিশ আধিপত্য তখন পুরো ভারতকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরেছে। নামমাত্র ক্ষমতায় ছিলেন দিল্লির শেষ মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ।
১৮৪৯ সালে পাঞ্জাব সার্বভৌম পরিচিতি হারায়। মা জিন্দ কৌরকে কারারুদ্ধ রাখা হলেও মহারাজা দিলীপকে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনে। পাঞ্জাবে যেন আর বিদ্রোহ মাথা চাড়া না দেয়, সেই জন্য এ ব্যবস্থা। ১৫ বছর বয়স থেকে জীবনের বাকিটা সময় পরবাসেই কাটিয়েছেন দিলীপ। স্যার জন স্পেন্সার ও লেডি লগিন দম্পতির তত্ত্বাবধানে বড় হন তিনি। ইংরেজি ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ জীবনাচরণ রপ্ত করেন। এক পর্যায়ে খ্রিষ্টধর্মও গ্রহণ করেন। রাজ পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকে। পার্টিতে উপস্থিতি ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। ছুটির দিনে তাকে দেখা যেত যুবরাজ অ্যালবার্ট ও রানী ভিক্টোরিয়ার আড্ডার আসরে।
এদিকে বৃদ্ধা জিন্দ কৌর অসুস্থ হয়ে পড়লে ব্রিটিশ সরকার মনে করে, তিনি আর ক্ষতিকর নন। ফলে ১৩ বছর পর মা-ছেলের দেখা করার অনুমতি মেলে। জিন্দ কৌর ছেলের পরিবর্তনে বিস্মিত হন। বারবার স্মরণ করিয়ে দেন শিখ পরিচয় ও হারানো সাম্রাজ্যের কথা। ১৮৬৪ সালে বাম্বা মুলারকে দিলীপ সিং বিয়ে করেন। বাম্বা ছিলেন জার্মান ব্যাংকারের মেয়ে, খ্রিষ্টধর্মে একনিষ্ঠ বিশ্বাসী। তাদের ঘরে জন্মায় ছয় সন্তান। দুই কন্যা বাম্বা ও সোফিয়া পরবর্তীতে নারী অধিকারকর্মী হিসেবে নাম করেন। দ্বিতীয় পুত্র প্রিন্স ফ্রেডরিখ দিলীপ সিং ছিলেন সেনা কর্মকর্তা।
এক সময় আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করলেও ১৮৭০ এর দশকে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েন মহারাজা দিলীপ। বিপুল ধার-দেনার সঙ্গে ছিল আত্মপরিচয়ের সংকট। এ পরিস্থিতিতে ক্রমশ বিদ্রোহী হয়ে উঠেন তিনি। হারানো সম্পদ ফেরত চেয়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বারবার চিঠি লেখেন। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হন। অবশেষে ১৮৮৬ সালে দিলীপ সিং কঠিন সিদ্ধান্ত নেন; সপরিবারে ভারত ফিরে গিয়ে শিখ ধর্ম পুনরায় গ্রহণ করবেন। ধর্ম ও হারানো সম্পদ উদ্ধারের আশায় ব্রিটেন ত্যাগ করেন মহারাজা। কিন্তু কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি ব্রিটিশ সরকার। অস্ট্রেলিয়ার এডেন বন্দর থেকে গ্রেফতার করে তাকে গৃহবন্দি রাখা হয়। ব্রিটিশদের নজরবন্দি হয়েই ১৮৯৩ সালে প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন দিলীপ সিং। দিলীপের অন্তত একটা ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল। শেষ জীবনে খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে শিখ ধর্মে ফেরেন তিনি। তবে ভারতের মাটিতে মৃত্যুবরণের ইচ্ছা পূরণ হয়নি। ব্রিটেনে দিলীপ সিংয়ের শেষকৃত্য হয় খ্রিষ্টীয় রীতিতে।