শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১০:৪২ অপরাহ্ন

হকার্স মার্কেট : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২২

বিভিন্ন মহানগরীর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য তার স্ট্রিট ফুড ও হকার্স মার্কেট। ঢাকা মহানগরীও এর ব্যতিক্রম নয়। এর বাহারি স্ট্রিট ফুডের জন্য যেমন অনেক সময় লাইন ধরতে হয়; তেমনি এর হকার্স মার্কেটগুলোতে সময়ে সময়ে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। ব্যতিক্রম হচ্ছে বিভিন্ন দেশের মহানগরীর স্ট্রিট ফুড ও হকার্স মার্কেট যেভাবে সুবিন্যস্ত, স্বাস্থ্যসচেতন ও গ্রাহকবান্ধব; এখানে তেমনটি নয়। হকার্স সমিতির সভাপতির ভাষ্য অনুযায়ী, ঢাকায় হকারের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ। কোভিডপূর্বকালে এর সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় লাখ। কোভিডের সময় বেশির ভাগ হকারের ব্যবসায় ভাটা পড়ে, দেখা দেয় মন্দা। তখন বেশির ভাগ হকার ব্যবসায় গুটিয়ে ফিরে যান নিজ নিজ এলাকায়। কোভিড-পরবর্তী সময়ে তারা এখন আবার নগরমুখী হচ্ছেন। কিন্তু ব্যবসায় শুরু করতে পারছেন না প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে। কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য তাদের জন্য নেই কোনো সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে আর্থিক সহায়তা বা প্রণোদনা। বড় বড় ব্যবসায়ী বা শিল্পগোষ্ঠী প্রণোদনা পেয়েছে; কিন্তু এসব হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা মানুষ এ ক্ষেত্রে রয়ে গেছেন উপেক্ষিত। স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানিংয়ের হিসাবে, ঢাকা মহানগরীর ৩৮৮ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে পথচারীদের জন্য। এর ভেতর ১৫৫ কিলোমিটার রাস্তা হকারদের দখলে। এই এলাকাগুলো হচ্ছে শহরের ব্যস্ততম জায়গা। দিনের ব্যস্ততম সময়ে এসব এলাকায় তৈরি হয় অসহনীয় যানজট। মাঝে মধ্যেই চলার গতিপ্রবাহ প্রায় থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়। অফিসে দেরি, হাসপাতালে, স্কুলে সময়মতো না পৌঁছানো নৈমিত্তিক ব্যাপার। এ জন্য অনেকে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হলেও হকার্স মার্কেটের অবদান অস্বীকার করা যায় না। নি¤œ ও মধ্যবিত্তদের জন্য এরা অনেকটাই আশার আলোকবাতি। সীমিত আয়ে জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহের ভরসারস্থল।
ঢাকা মহানগরীতে দিন দিন বাড়ছে নগর অভিবাসী জনস্রোত। বাড়ছে হকারের সংখ্যা। সরকারি কোনো সহায়তা ছাড়াই নিজ প্রচেষ্টায় একটি অর্থনৈতিক স্রোতধারা তৈরি করছেন হকাররা। যদিও এতে নগরীর স্বাভাবিক জীবনধারা ব্যাহত হয় তবুও এটিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এটিকে একটি পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কর্মকা-ের রূপ দেয়া গেলে এক দিকে যেমন বাড়বে হকারদের নিরাপত্তাবোধ; তেমনি বাড়বে সরকারি কোষাগারে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ। বর্তমানে দুই থেকে চার ফুট জায়গার জন্য মাসে ভাড়া দিতে হয় চার হাজার টাকা। অবস্থা ও সময়ভেদে এটি আরো বেড়ে যায়। বিশেষ করে ঈদ বা পূজার সময়। একটি বাল্বের জন্য দৈনিক ভাড়া দিতে হয় ২৫ টাকা। ভাড়ার অর্থ কোনো বৈধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে যায় না। জায়গার ভাড়া ছাড়াও প্রতিটি হকারকে দিনপ্রতি দোকানভেদে ২০০ থেকে এক হাজার টাকা চাঁদা হিসেবে দিতে হয়। এভাবেই হকারদের কাছ থেকে প্রতি বছর তিন হাজার ৭৮০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সুবিধাবাদী চক্র। কোনো লগ্নি ছাড়াই বিশাল এই অঙ্কের আয়ের জন্য মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন সুবিধাভোগী চক্রের মধ্যে ঘটে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।
মাঝে মধ্যেই দেখা যায়, রাস্তা পুনরুদ্ধারের নামে, যানজট এড়ানোর নামে হকার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু অবস্থা যথা পূর্বং তথা পরং। উচ্ছেদ হওয়ার পরক্ষণেই আবার হকাররা আগের মতো ব্যবসায় জাঁকিয়ে বসেন। এর কারণ যারা তাদের তাড়িয়ে বেড়ান তারাই এদের কাছ থেকে আর্থিক ফায়দা লোটেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক চক্র, স্থানীয় মাস্তান, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, সিটি করপোরেশনের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মচারী হকারদের কাছ থেকে নিয়মিত বখরা তোলেন বলে জনশ্রুতি আছে। এ জন্যই হকার উচ্ছেদের ইঁদুর-বিড়াল খেলা মঞ্চস্থ হতেই থাকে। বস্তুত পরিকল্পিত উপায়ে হকারদের নিরাপত্তাসহ ব্যবসায়ের সুযোগ করা না হলে হকাররা সারাক্ষণ সুবিধাভোগীদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকবেন। স্বাভাবিক অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর বাইরে এটি একটি সমান্তরাল অর্থনীতি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটিকে সরকারিভাবে পরিকল্পিত উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয় বৈধ কর্তৃপক্ষের ছত্রছায়ায়। ফলে এসব মার্কেট গ্রাহকবান্ধব-পরিবেশবান্ধব হয়ে থাকে। হকাররা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন না, চাঁদাবাজি ও মাস্তানির শিকার হতে হয় না। সরকারি ব্যবস্থাপনায় বৈধ তদারকির ফলে সরকারি কোষাগারে রাজস্ব আহরিত হয়। বিভিন্ন সুবিধাভোগী তা খেয়ে ফেলতে পারে না।
ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে হকার্স পয়েন্ট তৈরি করে, সান্ধ্য বাজারের ব্যবস্থা করে, বিশেষ বিশেষ জায়গায় সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে মূল সড়কে ছয় ঘণ্টার জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় হকার্স মার্কেটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শহরের বাইরে নির্দিষ্ট জায়গায় স্থায়ী হকার্স মার্কেট তৈরি করে সেখানে যাওয়া-আসার সুব্যবস্থা করা গেলে শহরের ভেতরের রাস্তাগুলোকে হকারমুক্ত করা যেতে পারে। এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে অযাচিত যানজট, ফিরিয়ে আনা যেতে পারে স্বাভাবিক নাগরিক জীবনপ্রবাহ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ, Email : shah.b.islam@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com