শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫২ পূর্বাহ্ন

৬নিরাপদ খাদ্য নাকি স্লো পয়জন

তানজিদা আক্তার লিন্থা
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৪ নভেম্বর, ২০২২

মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য একটি। তবে তা হতে হবে অবশ্যই নিরাপদ খাদ্য। কিন্তু জুরাসিক যুগের ডাইনোসরদের মতো নিরাপদ খাদ্যও আমাদের দেশে আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। নামিদামি ব্র্যান্ডেড শোরুম থেকে শুরু করে অলিগলির ফুটপাতের দোকানের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার লোভে যেন ভেজাল পণ্য বিক্রির এক মহা প্রতিযোগিতায় নেমেছে। মানবসভ্যতার সার্বিক অর্জনই এসব কর্মকা-ে বিফল মনে হয় এবং প্রশ্ন থেকেই যায়Íসভ্যতার সঙ্গে সংগতি রেখে আমরা কি আদৌ সভ্য হতে পেরেছি? সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যেসব ক্ষতিকর বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ খাদ্যদ্রব্যে মেশানো হচ্ছে তার মধ্যে ফরমালিন নামক বর্ণহীন তীব্র ঝাঁজালো পদার্থটি অন্যতম। এছাড়াও রয়েছে ক্যালসিয়াম কারবাইড, সোডিয়াম সাইক্লেমেড, হেপ্টাক্লোর, মেলামিন, কালারিং এজেন্টস, ইঞ্জিনের পোড়া তেল, হরমোন ও সালফিউরিক অ্যাসিড। ফরমালিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে মূলত মানুষের মৃতদেহ সংরক্ষণসহ নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সহজ মুনাফার পদ্ধতি হিসেবে খাদ্যদ্রব্যের পচন রোধ করছে ফরমালিন বিষ! গবেষণা বলছে, ৭০ কেজি ওজনের একজন মানুষের ৩১৭-৪৭৫ মিলিগ্রাম বা কেজি ফরমালিন মৃত্যু ঘটাতে পারে। এছাড়া ২৫-৩০ মিগ্রা ফরমালিন শ্বাসনালির মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া এসব বিষাক্ত রাসায়নিকের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে কিডনি, ফুসফুস, যকৃত নষ্ট, ও স্মরণশক্তি হ্রাস, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, বন্ধ্যত্ব, কিডনিতে পাথর ও ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ফুড রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও ইউএস এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশনের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত একটি গবেষণায় বাজারের প্রায় প্রতিটি খাবারে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই তালিকায় বাদ পড়েনি শিশুখাদ্যও। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শিশুখাদ্যের শতকরা ৯৫ ভাগই ভেজাল। দেশে প্রতিবছর যত শিশু মারা যায়, তার ১০ শতাংশের কারণ ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্য। কাপড়ে ব্যবহৃত রং, স্যাকারিনের দ্রবণ ও কৃত্রিম ফ্লেভার মিশিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন ধরনের জেলি ও জুসসহ ভেজাল খাদ্যপণ্য, যার প্রধান ভোক্তা হচ্ছে দেড় থেকে ছয় বছর বয়সি শিশু। কী সাংঘাতিক!
পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের খাদ্য পরীক্ষাগারের তথ্যানুযায়ী, দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল এবং তা দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মাছ তরতাজা রাখতে ব্যবহার করা হয় ফরমালিন। শুঁটকিতে কীটনাশক, মুরগির খাবারে মেশানো হয় আর্সেনিক, কলায় ব্যবহার করা হয় বিষাক্ত রাসায়নিক আলড্রিন, আপেল সংরক্ষণ করতে মেশানো হয় মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক ‘আলফা ক্লোরড্যান’, টম্যাটো ও আনারসে ইথিওন, দুধে আলড্রিন এবং ফরমালিন, পাউরুটি এবং কেক জাতীয় শুকনো খাবারে ব্যবহার করা হয় বিষাক্ত রাসায়নিক ‘সাব-স্ট্যান্ডার্ড ইয়েস্ট, গুঁড়া হলুদে মিলেছে সিসা ও ক্রোমিয়াম নামে মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক অস্তিত্ব। এগুলোর প্রভাবে খিঁচুনি, ধীরে ধীরে মানুষের চেতনা শক্তি হ্রাস, হাঁপানি, স্নায়ুতন্ত্র বিনষ্টসহ ব্রংকাইটিস ও ক্যানসারের মতো মরণব্যাধির ঝুঁকি রয়েছে।
ক্ষতিকর দ্রব্য মিশিয়ে খাদ্যকে বিষাক্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের এখনই থামাতে না পারলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে দেশের মানুষ। মুনাফালোভী গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে ভুক্তভোগী আমরা সবাই। ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের অনৈতিক ব্যবসা রুখতে দেশের প্রচলিত আইনের প্রয়োগ জরুরি হয়েছে অনেক আগেই। আজকের দিনে যে হারে ভেজাল খাদ্যে বাজার সয়লাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে করে অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য থামাতে না পারলে সমস্যা প্রকটতর হবে। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশেই স্বাস্থ্যসম্মত উপায়েই উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে শাকসবজি বা ফলমূল দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ, টাটকা রাখা ও পচনরোধের ব্যবস্থাও আছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে উৎপাদনকারী এলাকায় চাষিদের, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এবং পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোকে এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের আওতায় আনতে হবে এবং জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এছাড়া সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আমাদেরও হতে হবে সচেতন। কেবল সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই ‘নিরাপাদ-খাদ্য’ নিশ্চিত করা সম্ভব। লেখক :শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com