১৯১৩ সালের ১২ নভেম্বর অর্থাৎ আজকের এই দিনে নোবেল পুরস্কারের জন্য রবীন্দ্রনাথের নাম ঘোষণা করা হয়ে। ১৯০১ সাল থেকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার চল শুরু হয়। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবির নোবেল পুরস্কার লাভের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, পুরস্কার লাভের পথে ঘটেছিল একাধিক ঐতিহাসিক ঘটনা। সাহিত্যের আঙ্গিকে এই ঘটনাগুলোর কয়েকটিকে বিরল থেকে বিরলতম ঘটনাও বলা যেতে পারে। বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী উইলিয়াম রোটেনস্টাইন ১৯১০ সালে কলকাতায় আসেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবি দেখতে তিনি উপস্থিত হন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। সেখানেই তার সঙ্গে দেখা হয় কবিগুরুর। উইলিয়াম রোটেনস্টাইন কবির একটি ছবি আঁকেন। সেই সময় থেকেই এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। ১৯১২ সালে ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা সিস্টার নিবেদিতার ইংরেজিতে অনুবাদ করা ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্প। উইলিয়াম রোটেনস্টাইন সেই লেখা পড়ে অবাক হয়ে যান। এর আগে পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন সাহিত্য কর্ম সম্পর্কে পরিচিত ছিলেন না। এরপর উইলিয়াম রোটেনস্টাইনের অনুরোধে বিখ্যাত শিক্ষক অজিত চক্রবর্তী মহাশয় কবির কিছু লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করে তার কাছে পাঠান। আরো অবাক হন উইলিয়াম রোটেনস্টাইন। তাকে কবিগুরু সাহিত্য চর্চা সম্পর্কে লন্ডনে বিশদে জানান প্রমথলাল সেন ও ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। এরপরই উইলিয়াম রোটেনস্টাইনের আমন্ত্রণে লন্ডন পাড়ি দেন কবি। জাহাজে তিনি গীতাঞ্জলি-এর কিছু কবিতা অনুবাদ করেন। সঙ্গে অনুবাদ করেন শিলাইদহে বসে তার লেখা আরও কিছু কবিতা। সেই কবিতা পড়ে অভিভূত হন উইলিয়াম রোটেনস্টাইন। তিনি কবির খাতাটি পাঠান আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসসহ একাধিক সাহিত্য সমালোচককে। তিনি জর্জ বার্নডশ’কে চিঠি লিখে কবিগুরুর কবিতা পড়ার অনুরোধ জানান।
লন্ডনে এক সাহিত্য সভায় মিলিত হন কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসসহ বেশ কিছু কবি সাহিত্যিক ও লেখক। কবিগুরুর অনুবাদ করা কবিতাগুলি শুনে তারা একের পর এক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাঠাতে থাকেন। এক দিনেই লন্ডনের সাহিত্য মহলে ছড়িয়ে পরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নাম। নোবেল কমিটির নিয়ম অনুসারে নোবেল পুরস্কারের জন্য নাম সুপারিশ করতে পারেন বিভিন্ন দেশের স্বীকৃত সংস্থার সভ্যরা অথবা কোন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যক্তি। কবিগুরুর কবিতা পড়ে মুগ্ধ হওয়া স্টার্জমুর মহাশয় ছিলেন রয়েল সোয়াইটি অব লিটারেচার অব ইউ কে-এর সদস্য। তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য কবিগুরুর নাম সুপারিশ করেন। কিন্তু এ কথা কবিগুরুও জানতেন না। সম্পূর্ণ গোপনে কবির নাম সুপারিশ করেন স্টার্জমুর।
বিভিন্ন দেশ থেকে আরও ২৮ জনের নামে সেই বছর সুপারিশ এসেছিল। সুইডিশ একাডেমির সদস্য হলেও স্টার্জমুর-এর হাতে ছিল একমাত্র গীতাঞ্জলি-এর অনুবাদ করা বইটি। তৎকালীন নোবেল কমিটির সভাপতি হোয়ানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামের বিরোধিত করে বলেন, একটি মাত্র বই দেখে বিচার করা সম্ভব নয়। নোবেল কমিটিতে ছিলেন প্রাচ্যবিদ এসাইস টেঙ্গার। তিনি বাঙলা ভাষা জানতেন। তিনি কমিটির সদস্যদের প্রভাবিত করেন। সুইডিশ কবি হাইডেস্টাম গীতাঞ্জলি-এর সুইডিশ অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে নোবেল কমিটিকে চিঠি লেখেন। অবশেষে ১৯১৩ সালে নোবেল কমিটির বিচারে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ঘোষিত হয়।