আমানত বাংলাতে অতি পরিচিত একটি শব্দ। মূলত এটি আরবি শব্দ। আরবি আমনুন থেকে এর উৎপত্তি। যার শাব্দিক অর্থ হলো- বিশ্বস্ততা, আস্থা, নিরাপত্তা, তত্ত্বাবধান, আশ্রয় ইত্যাদি। আল্লামা কাফাবি রহ: বলেন, আল্লাহ বান্দার ওপর যেসব বিষয় ফরজ করে দিয়েছেন সেগুলোই আমানত। যেমন- নামাজ, রোজা, জাকাত ইত্যাদি।
আবার কোনো সম্পদের কিছু বা পুরো অংশ অন্যের কাছে গোপনে বা প্রকাশ্যে গচ্ছিত রাখার নামও আমানত। (নাদরাতুন নাইম, তৃতীয় খ-) ইসলাম বিশারদদের মতে, আমানত দুই প্রকার- এক. হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক-সম্পর্কিত আমানত। বান্দার প্রতি মহান আল্লাহ প্রদত্ত যাবতীয় ফরজ ও ওয়াজিব এবং যাবতীয় হারাম বর্জনের আদেশ হলো আল্লাহর হক-সম্পর্কিত আমানত। দুুই. হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক-সম্পর্কিত আমানত। এর মধ্যে আর্থিক আমানত অন্যতম। কেউ যদি কারো কাছে কোনো সম্পদ বা টাকা-পয়সা গচ্ছিত রাখে তাহলে এটি আর্থিক আমানত। এটি রক্ষা করা এবং প্রত্যর্পণ করাও ফরজ।
অনুরূপভাবে কারো গোপন কথা শরিয়তসম্মত ওজর ছাড়া ফাঁস করে দেয়া হারাম। কেননা, সে কথাও একটি আমানত। হাদিসে বলা হয়েছে- ‘যদি কোনো ব্যক্তি কথা বলে এদিক ওদিক তাকায়, তবে তার কথা আমানত।’
তদ্রুপ, মজুর ও কর্মচারীর ওপর নির্ধারিত দায়িত্বও আমানত। অতএব কাজ চুরি বা সময় চুরিও এক প্রকার বিশ্বাসঘাতকতা। হাদিস শরিফে আছে- ‘যার আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান নেই’। (শোয়াবুল ঈমান)
আমানতের কিছু ক্ষেত্র : আমাদের গোটা জীবনে আমানতের অসংখ্য ক্ষেত্র রয়েছে, তন্মধ্যে নি¤েœ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করা হলো-
দ্বীনের ক্ষেত্রে আমানত : বান্দার প্রতি মহান আল্লাহপ্রদত্ত আমানতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় আমানত হলো তার দ্বীনের আমানত। আর তা হলো বান্দার দ্বীন পালন এবং দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব পালন। আসমানগুলো ও জমিন এই বিরাট বোঝা বহন করতে অস্বীকার করেছিল। কেননা, তারা আশঙ্কা করেছিল, তারা এ বিরাট বোঝা বহন করতে সক্ষম হবে না। যেমন মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, ‘অবশ্য আমি এ (দ্বীনের) আমানতকে আসমানসমূহ, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে পেশ করেছিলাম। তারা একে বহন করতে অস্বীকার করল, সবাই এতে ভীত হয়ে গেল, অবশেষে মানুষই তা বহন করে নিলো, নিঃসন্দেহে সে (মানুষ) একান্ত জালেম ও (আমানত বহন না করার পরিণাম সম্পর্কে) একান্ত অজ্ঞ।’ (সূরা আল-আহজাব-৭২) মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে আরা বলেন, ‘আমি যদি (দ্বীনের বাণী) এ কুরআনকে কোনো পাহাড়ের ওপর নাজিল করতাম তাহলে তুমি দেখতে, কিভাবে তা বিনীত হয়ে আল্লাহর ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে পড়েছে। আমি এসব উদাহরণ মানুষের জন্য এ কারণে বর্ণনা করেছি যেন তারা (কুরআনের মর্যাদা নিয়ে) চিন্তা ভাবনা করতে পারে।’ (সূরা হাশর-২১) এ দ্বীন প্রচারের পদ্ধতি নিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী) তুমি তোমার মালিকের পথে (মানুষের) প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশ দিয়ে আহ্বান করো। আর (যদি তর্ক করা লাগে তাহলে) তুমি তাদের সাথে তর্ক করো সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পন্থায়।’ (সূরা আন নাহল-১২৫)
কেউ কেউ শুধু সওয়াব বা পুণ্যের বয়ান করে থাকে। মহান আল্লাহ বয়ানের রূপরেখা বর্ণনা করে বলেন, ‘তোমরা সর্বোত্তম জাতি, মানব জাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।’ এখান থেকে স্পষ্ট হয় দ্বীন হলো আদেশ ও নিষেধের সমন্বিত রূপ।
নবী-রাসূলরা সব সময় তটস্থ থাকতেন এই ভেবে যে, তাদের দ্বীন প্রচারে এ আমানতদারির দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন হচ্ছে কি না? এ জন্য মহানবী সা: বিদায় হজের ভাষণের শেষ দিকে এসে লাখ লাখ সাহাবির উদ্দেশে বলেন, ‘কিয়ামতের ময়দানে তোমাদের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হবে তখন তোমরা (উপস্থিত থেকে এর উত্তরে) কী বলবে? তারা সমস্বরে বলেন, (আমরা বলব) আপনি আপনার রিসালাত পৌঁছে দিয়েছেন, আপনার আমানত পূর্ণ করেছেন এবং আপনার উম্মতকে আপনি নসিহত করেছেন। এর পর রাসূল সা: ঊর্ধ্বাকাশে সাহাদাৎ আঙুল উঁচু করে তিনবার বলেন, আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাকো। (বুখারি) মহানবী সা: আরো বলেন, ‘তোমরা আমার থেকে একটি কথা হলেও তা মানুষের কাছে পৌঁছে দাও।’ (বুখারি-৩২৭৪)
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, কেউ যদি দ্বীন পালন করে আর তার আশপাশে সুদখোর, ঘুষখোর, মদখোর, নেশাখোর, ব্যভিচারী, নারী উত্ত্যক্তকারী, অর্থ আত্মসাৎকারী, মা-বাবার কষ্ট দানকারী, যৌতুকের দাবিতে স্ত্রী নির্যাতনকারী, বেনামাজি, বেরোজদার, হজ-জাকাতকে অবহেলাকারী, মানবরচিত মতাদর্শের লালনকারী, ব্যবসায় প্রতারণাকারী ইত্যাদি দ্বীনবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত ব্যক্তিদের কাছে ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছে না দেয় তাহলে অবশ্যই তাকে মহান আল্লাহর দরবারে এ আমানতের বিশ্বাসঘাতকতা মামলায় আসামি হতে হবে। এ বিষয়টি প্রত্যেক মুসলমানকে ভাবতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আমানত : মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদিগকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন আমানতগুলো তার প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও।’ (সূরা নিসা-৫৮) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মা’রিফুল কুরআনে বলা হয়েছে- এ আয়াতের হুকুমের লক্ষ্য সাধারণ মুসলমানরাও হতে পারে আবার ক্ষমতাসীন শাসকও হতে পারে। তবে স্পষ্ট বিষয় হলো- এ উভয় শ্রেণীই এ হুকুমের অন্তর্ভুক্ত।
রাসূল সা: আমানত প্রত্যর্পণের ব্যাপারে সর্বদা জোর তাকিদ দিতেন। হজরত আনাস রা: বলেন, এমন খুব কম হয়েছে যে, রাসূলে করিম সা: কোনো ভাষণ দিয়েছেন অথচ তাতে এ কথা বলেননি- ‘যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার মধ্যে ঈমান নেই, যার মধ্যে প্রতিশ্রুতি পালন নেই, তার ধর্ম নেই।’ (শোয়াবুল ঈমান) এর থেকে অনুমিত মুমিন জীবনে আমানতের গুরুত্ব কত! আর রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিদের আমানতদারির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- রাষ্ট্রীয় যত পদ ও পদমর্যাদা রয়েছে, সে সবই আল্লাহ তায়ালার আমানত। যাদের হাতে নিয়োগ ও বরখাস্তের অধিকার রয়েছে সেসব কর্মকর্তা সেসব পদের আমানতদার। কাজেই তাদের পক্ষে কোনো পদ এমন কাউকে অর্পণ করা জায়েজ নয়, যে লোক তার যোগ্য নয়; বরং প্রতিটি পদের জন্য নিজের ক্ষমতা ও সাধ্যানুযায়ী যোগ্য ব্যক্তির অনুসন্ধান করা কর্তব্য। এসব পদে নিয়োগদানে কোনো প্রকার স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়তার সম্পর্ক কিংবা কোনো সুপারিশ অথবা ঘুষের প্রশ্রয় দেয়া হয় তাহলে আমানতের মর্যাদা রক্ষিত হবে না (বরং বিশ্বাসঘাতকতা হবে)। (মা’রিফুল কুরআন, পৃষ্ঠা-২৫৮-২৫৯) মহানবী সা: বলেন, ‘যখন আমানত নষ্ট করা হবে, তুমি কিয়ামতের অপেক্ষা করো।’ সাহাবিরা আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কিভাবে আমানত নষ্ট হবে? রাসূল সা: বলেন, ‘যখন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কোনো অযোগ্য ব্যক্তিকে দেয়া হবে, তখন তুমি কিয়ামতের অপেক্ষা করো।’ (বুখারি)
শারীরিক আমানত : মহান আল্লাহ তায়ালা মানবের যে হাত, পা, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা দান করেছেন তা সবই তাঁর পক্ষ থেকে আমানত। এগুলো যদি সত্য-সুন্দর তথা দ্বীনের পথে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তাঁর সে আমানত রক্ষা হবে এবং পরকালে এর জন্য তিনি পুরস্কৃত হবেন।
পক্ষান্তরে চোখ দিয়ে পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দিয়ে স্বাদ উপভোগ করা, অশ্লীল ছবি দেখা, দ্বীনবিরোধী জ্ঞান অধ্যয়ন করা, কান দিয়ে অশ্লীল গান-বাজনা, যৌন উদ্দীপক নাটক, সিনেমার কাহিনী শোনা, হাত-পা দ্বীনবিরোধী কাজে সঞ্চালন করা, অন্তর দিয়ে কুচিন্তা করা ইত্যাদি এসব ওই আমানতবিরোধী কাজ এবং এর জন্য মহান আল্লাহর দরবারে কঠিন জবাবদিহি করতে হবে। যেমন- মহান আল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, ‘(কেয়ামতের দিন) তোমাদের কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর এদের প্রত্যেককে (এদের ব্যবহার) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। (সূরা বনি ইসরাইল-৩৬)
বাকশক্তি, জ্ঞান, যোগ্যতা আমানত : মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষ ছাড়াও অনেক প্রাণীর ঈর্ষণীয় বুদ্ধি, জ্ঞান, যোগ্যতা দান করেছেন। কিন্তু সমাজে তা প্রকাশ করার মতো বোধগম্য বাকশক্তি দান করেননি। এ জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান জগতে তারা স্বেচ্ছায় কোনো অবদান রাখতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা মানবকে বুদ্ধি-জ্ঞান প্রকাশোপযোগী বাকশক্তি দান করেছেন। যেমন তিনি বলেন- ‘তিনি মানুষ বানিয়েছেন। (ভাব প্রকাশের জন্য) তিনি তাকে কথা বলা শিখিয়েছেন।’ (সূরা আর-রাহমান : ৩-৪)
অনুরূপভাবে তিনি মানবকে মেধা-বুদ্ধি, জ্ঞান-যোগ্যতা দান করেছেন, এ সবই তার পক্ষ থেকে বান্দার কাছে আমানত। সুতরাং মানুষ যদি এসব আমানতকে সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার উন্নয়নে, অশ্লীল নাচ-গান, ছবি, মুখাভিনয় তথা ইসলামী চেতনাবিরোধী সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে, জাহেলি রসম-রেওয়াজের সমাদরে, মানবরচিত মতবাদ প্রচারে, মিথ্যা গলাবাজিতে তথা সর্বোপরি সার্বিক জীবনে মহান আল্লাহর দ্বীনবিরোধী আদর্শ প্রচারে প্রয়োগ করে তাহলে অবশ্যই তাকে মহানের দরবারে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে কঠিন জবাবদিহি করতে হবে। যেমন- মহান আল্লাহ বলেন, ‘সে দিন (কিয়ামতের ময়দানে) তোমাদের (আল্লাহপ্রদত্ত নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে)। (সূরা তাকাছুর-৮) এ নিয়ামতের অন্যতম হলো জ্ঞান-যোগ্যতা। মহানবী সা: আরো বলেন, ‘কিয়ামতের দিন চারটি প্রশ্নের জিজ্ঞাসাবাদ না হওয়া পর্যন্ত কোনো বান্দা (বিন্দু পরিমাণ) আপন কদম সরাতে পারবে না। এক. তার জীবন কোন কাজে ব্যয় করেছে; দুই. তার যৌবনকাল কোন পথে ব্যয় করেছে; তিন. সে তার সম্পদ কোন পথে আয় করেছে এবং কোন পথে তা ব্যয় করেছে; চার. সে জ্ঞান (ইলম) অনুযায়ী কী আমল করেছে? (অর্থাৎ এলেম কোন পথে ব্যয় করেছে?) (বায়হাকি)
তাই মানুষ যদি মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্য সায়্যেদ কুতুব, জালালুদ্দিনের মতো তাফসির শাস্ত্রে, ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিমের মতো হাদিস শাস্ত্রে, আল্লামা গাজালি, আল কিন্দি, আল ফারাবির মতো দর্শনশাস্ত্রে, ইবনে সিনা, আল রাজির মতো চিকিৎসা বিজ্ঞানে, কবি নজরুল, ফররুখ, শেখ সাদীর মতো সাহিত্যে (অনুরূপ হাজার হাজার ইসলামী প্রাণপুরুষের উদাহরণ আছে) জ্ঞান যোগ্যতা বিলিয়ে দিয়ে যায় তাহলে পরকালে সাদকায়ে জারিয়া হিসেবে তার সাওয়াব পাবে। এটি হাদিস থেকে প্রমাণিত। ( অসমাপ্ত) লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক