মেজর এম এ জলিল। বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িত একটি নাম, একটি ইতিহাস। শোষন, বঞ্চনা, নিপীড়ন থেকে বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে যিনি অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন তদানীন্তন পাক হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী এবং তাদের প্রতিবেশী দোসরদের নানা অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠ ছিলেন মেজর জলিল। দেশ ও জনমানুষের মুক্তির জন্য নোঙ্গর ফেলেছেন তিনি নানান ঘাটে। এবং প্রচুর অধ্যাবসায়, অধ্যয়ন, পর্যবেক্ষন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রায় এক যুগের সাধনান্তে শেষ পর্যন্ত তিনি অনুধাবন করতে সক্ষম হন মানুষের মুক্তির জন্য কোন বাদই (ওংস) নুন্যতম ভুমিকা রাখতে সক্ষম নয়, মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে ইসলাম।
ব্যক্তিগত জীবন: মেজর জলিল ১৯৪২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী বরিশাল জেলার উজিরপুর থানায় নানার বাড়িতে জন্মগ্রহন করেন। জন্মের তিন মাস আগে তার পিতার মৃত্য হয়। মেজর জলিলের পিতার নাম আলী মিয়া এবং মাতার নাম রাবেয়া খাতুন। ১৯৬০ সালে তিনি উজিরপুর ডব্লিউ বি ইউনিয়ন ইনস্টিটউট থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬১ সালে মেজর জলিল রাওয়াল পিন্ডির মারি ইয়াং ক্যাডেট ইনস্টিটউশন ভর্তি হন এবং সেখান থেকে আইএ সম্পন্ন করেন এবং ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে শিক্ষানবীশ অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। অত্যন্ত মেধাবী এবং চৌকস সেনা কর্মকর্তা মেজর জলিল ১৯৬৫ সালে ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় পদোন্নতি লাভ করেন। একই বছর পাক-ভারত যুদ্ধে ১২ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের অধিনে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হন। পড়ালেখার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী মেজর জলিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় ব্যাচেলর এবং ইতিহাসে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। ব্যাক্তি জীবনে তিনি বিবাহিত এবং দুজন কন্যা সন্তানের জনক। ১৯৮২ সালে তিনি টাঙ্গাইলে সায়মা আক্তারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং সারাহ জলিল এবং ফারাহ জলিল নামে তাদের দুজন কন্যা সন্তান রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে মেজর জলিল;১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১৪ তারিখে অসুস্থ মাকে দেখতে মেজর জলিল তার কর্মস্থল পাকিস্তানের মুলতান থেকে ছুটি কাটাতে বরিশলে নিজ বাড়িতে আসেন। ছুটি শেষ হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে তখন তিনি নিজ কর্মস্থলে যোগদান করা থেকে বিরত থাকেন। মার্চের শেষ দিকে জিয়াউর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মেজর জলিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি আনুগত্য ছিন্ন করে মহান মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহন করেন। বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের নিপীড়িত মানুষদের পরাধিনতা থেকে মুক্তির পণ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা সংগ্রামে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত ১১ টি সেক্টরের মধ্যে সাহসী সেনা মেজর জলিলকে বরিশাল,ভোলা, পটুয়াখলী, ফরিদপুর এবং খুলনার কিছু এলাকা নিয়ে গঠিত ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দ্বায?িত্ব দেওয়া হয়। দীর্ঘ নয় মাস তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করেন যার মধ্যে ৭ এপ্রিল খুলনা রেডিও সেন্টার মুক্ত করার অপারেশন উল্লেখযোগ্য। অত্যন্ত দক্ষতা, সাহসিকতা এবং বীরত্বপূর্ন অবদানের মাধ্যমে তিনি যুদ্ধের শেষ দিন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত জীবন পণ যুদ্ধ করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী মেজর জলিল: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মেজর জলিলের অংশগ্রহের অদ্বিতীয় কারন ছিল তৎকালীন পাকিস্তানী শোষকদের হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগনকে মুক্ত করা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি যেমনি ছিলেন আপোশীন তেমনি স্বাধীনতা উত্তর ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন বজ্রকন্ঠ। মুক্তিবাহিনীকে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগীতার নেপথ্যের কারন জানতে পেরে মেজর জলিলের মধ্যে ক্ষোভের তীব্র আগুন জ্বলতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জে: ওসমানীর পরিবর্তে লে: জে: জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পন করানো হয় জেনারেল নিয়াজীকে। অনুরুপভাবে ১৭ ডিসেম্বর খুলনার সার্কিট হাউস ময়দানে ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে পাকিস্তানী বাহিনীকে সেক্টর প্রধান হিসেবে মেজর জলিলের কাছে আত্মসমর্পন না করিয়ে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল দানবীর সিং এর কাছে আত্মসমর্পন করানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় বাহিনীর নানা ঘটনাসহ এই দুটি ঘটনা এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বাংলাদেশীদের সম্পদ লুন্ঠনে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাধা দেওয়ায়ই তখনকার সরকার মেজর জলিলের উপর ক্ষিপ্ত হয়। মেজর জলিল ভারতীয় বাহিনীর লুন্ঠনের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী এবং ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের সর্বাধিনায়ক জেনারেল অরোরার নিকট পত্র লিখেন যা ১৭ ডিসেম্বর তাদেরকে পৌছানো হয়। ভারতীয় বাহিনীর বেপরোয়া লুটতরাজের বিরুদ্ধে ক্রমেই ক্রোধে অগ্নিরূপ ধারন করেন মেজর জলিল। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল দানবির সিংকে বলতে বাধ্যে হন, “দেখা মাত্র গুলির হুকুম দিয়েছি আমি, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে লুটতরাজ করা হতে বিরত রাখুন।” মেজর জলিল পরবর্তী কয়েক দিন জাহাজে চড়ে বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর এবং ভোলার বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করে জনসাধারনকে ভারতীয় বাহিনীর লুটতরাজ সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। এভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক লুন্ঠনের প্রতিবাদ করায় ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী হিসেবে মেজর জলিলকে বন্দী করে যশোর সেনা ছাউনির একটি নির্জন কক্ষে রাখা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের অবদানের স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত মেজর জলিল: মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ন অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ সাতজনকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা ছাড়াও বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মানসূচক বীর উত্তম, বীর বিক্রম এবং বীর প্রতীক উপাধি দেওয়া। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করা সবাইকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা হলেও মেজর জলিলকে বঞ্চিত করা হয়। মূলত ভারতীয়দের আগ্রাসন, লুন্ঠন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কারনেই মেজর জলিলকে তার প্রাপ্য উপাধি থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়।
রাজনীতিতে মেজর জলিল: অনেক সাধনার বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী মেজর জলিল দীর্ঘ সাত মাস বন্দী থাকার পর ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই মুক্তি লাভ করেন। মুক্তির পরপরই তখনকার শাসকদের দস্যুপনার বিরুদ্ধে জনগনকে জাগিয়ে তুলতে রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন আর এ লক্ষ্যে জাতীয় সমাজতান্তিক দল (জাসদ) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর তিনি জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক জীবনে মেজর জলিল ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে শুরু করে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের কারনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হন। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু পূর্ববর্তী রাজনীতিতে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালন করেন মেজর জলিল। সরকারের ব্যর্থতা এবং কুশাসনের প্রতিবাদে ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ স্বরাস্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচীতে দ্বিতীয়বারের মত গ্রেফতার হন তিনি। উল্লেখ্য ঐ কর্মসূচীতে অংশ নেওয়া কয়েকশ জাসদ নেতাকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর মুক্তি পেলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তের প্রেক্ষিতে ২৩ নভেম্বর আবারও গ্রেফতার হন জলিল। সামরিক আদালতে কোন একটি মামলায় জলিলের ফাসির হুকুম হলে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য দন্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়। ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ তিনি মুক্তি লাভ করেন। জেলে থাকাকালীন মানব রচিত বিভিন্ন মতবাদ এবং ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করায় ক্রমে ইসলামী আন্দোলনের দিকে ধাবিত হন মেজর জলিল এবং ১৯৮৪ সালের ৩ নভেম্বর জাসদ থেকে পদত্যাগ করে বাম রাজনীতির যাবনিকা টানেন। জাসদ থেকে পদত্যাগ করার মাত্র ১৬ দিন পর তিনি “জাতীয় মুক্তি আন্দোলন” নামে একটি ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তিনি হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে ইসলামী দলগুলোর সমন্ময়ে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং লেবানন, যুক্তরাজ্য, লিবিয়া, পাকিস্তান ও ইরানে বেশ কয়েকটি ইসলামী অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এরশদ সরকারের শোষন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় ১৯৮৫ সালের জানুয়ারী মাসে তাকে একমাসের জন্য গৃহবন্দী করে একবার এবং ১৯৮৭ সালের শেষ দিকে দ্বিতীয়বার প্রায় তিনমাস কেন্দ্রীয় কারাগারের আটক রাখা হয়।
লেখক মেজর জলিল: প্রতিটি ক্ষেত্রে অসাধারন মেধার সাক্ষর রাখা মেজর জলিলের তরুন বয়সেই লেখালেখির জগতে হাতেখড়ি ঘটেছিল। স্কুল জীবন থেকেই তিনি লেখালেখির সাথে নিজেকে জড়িত করেন। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি “পথের কাঙ্গাল” এবং “রীতি” নামক দুটি উপন্যাস রচনা করেন। পরবর্তীতে উপন্যস দুটির পান্ডুলিপি হারিয়ে যায়। পরবর্তী বছরগুলোতে সামরিক বাহিনীতে চাকুরি, মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বপরি স্বাধীন বাংলাদেশের নানা প্রতিকুলতার সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত রাখায় লেখালেখি হয়ে ওঠে নি। তবে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক চিন্তাধারা, প্রতিপক্ষ কর্তৃক জেল জুলুমের স্বীকার হওয়া, ইসলামী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া ইত্যাদি ব্যাপার মেজর জলিলকে আবারও কলম ধরতে বাধ্য করে। আর এসব কিছু নিয়েই মেজর জলিল রচনা করেছেন আটটি গ্রন্থ। তার লেখা গ্রন্থগুলো হচ্ছে- ১) সীমাহীন সময় (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ডায়েরী) ২) মার্কসবাদ (প্রবন্ধ) ৩) সূর্য্যেদয় (রাজনৈতিক উপন্যাস) ৪) কৈফিয়ত ও কিছু কথা (প্রবন্ধ) ৫) দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবন দর্শন ( প্রবন্ধ) ৬) দাবী আন্দোলন দ্বায়িত্ব (প্রবন্ধ) ৭) অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা (প্রবন্ধ) ৮) A search for identity (Essays)
বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল তার লেখা অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা” বইটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর দলন-নিপীড়ন, লুটপাট ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বেশ খোলামেলা আলোচনা করেছেন। সত্য ইতিহাস জানতে আগ্রহী প্রতিটি জাগরিকেরই উচিত বইটি অধ্যয়ন করা। উপরে ৭ নম্বরে লেখা বইটির নামে ক্লিক করে সরাসরি মূল বই পঠন করা যাবে।
ইসলামী আন্দোলন ও মেজর জলিল: ন্যায়ের পথে সদা তৎপর মেজর জলিল স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতিতে তৎকালীন শাসকদের কুনজরে পড়ে বার বার জেল জুলুমের স্বীকার হন। পুরো সত্তরের দশক জুড়ে দীর্ঘ সময় জেলে থাকার কারনে মার্কসবাদ এবং ইসলাম নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করেন তিনি। অনেক চিন্তা-গবেষনা, বাছ-বিচার করে মেজর জলিল মার্কসবাদ ছুড়ে ফেলে ইসলামী আন্দোলনের দিকে ধাবিত হন। এ প্রসঙ্গে তিনি তার লেখা কৈফিয়ত ও কিছু কথা” গন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেন। সেখান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অংশ তুলে ধরা হল।
জাসদ ছেড়ে আসার পরে আমি ইসলামী বিপ্লবের দিকে ধাবিত হলাম কেন? এ প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর উত্তর ইতিপূর্বে আমি দিয়েছি, তবু আরো কিছু বলার রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি সহায়-সম্বলহীন এবং মায়ের গর্ভে থেকেই পিতৃহীন। আশৈশব আমি আল্লাহ বা স্রষ্টা নির্ভরশীল এবং একজন আশাবাদী মানুষ। নিজের শক্তি-সাহসেও চরম আস্থাশীল, আমি কখনো অন্যায়ের সংগে আপোষ করতে শিখিনি। নীতি-আদর্শ এবং সমষ্টির স্বার্থে আমি বিনা সংকোচে ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করার মহান শিক্ষা লাভ করেছি আমারই এক আপন আধ্যাত্মিক পুরুষের কাছে।তাই আমি ১৯৭১ সানের ২৬ মাচর্ তারিখে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ব্যতিরেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছি মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ছুটিতে আসা একজন অফিসার হিসেবে আমি নিরাপদেই পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারতাম এবং ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার পথও বেছে নিতে সক্ষম হতাম। মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দাযত্বি পালনের মধ্য দিয়ে আমার যে ব্যক্তি সুনাম অর্জিত হয়েছিল, তা দিয়েও আমি সেনাবাহিনীর একজন প্রতিষ্ঠিত অফিসার হিসেবে আজীবন ভোগ-বিলাসের মধ্যেই কালাতিপাত করতে সক্ষম হতাম। সেই ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার পথে পা না বাড়িয়ে আমি একটি নিশ্চিত, নিরাপদ এবং উজ্জ্বল জীবন ছুঁড়ে ফেলে মেহনতী জনগণের কাতারে দাঁড়ালাম জাসদ সভাপতি হিসেবে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হওয়া সত্ত্বেও আমি জাসদের সভাপতির পদ বেহায়ার মত আঁকড়ে থাকার সুযোগ গ্রহণ করতে পারতাম। জাসদ সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পরে আমি বিনা কষ্টে সরকারী পদমর্যাদা লাভ করে আরাম-আয়েশের পথ বেছে নিতে সক্ষম হতাম। যে দেশে আপোস করলেই অর্থ, পদ-মর্যাদা লাভ এবং ভোগ-লালসা চরিতার্থ করার সূবর্ণ সুযোগ বিদ্যমান, সেক্ষেত্রে এ সহজ পথে অগ্রসর না হয়ে আমি বেছে নিলাম ইসলামী বিপ্লব সংগঠন করার কঠিন পথ। লোভ, মোহ আমাকে আদর্শচ্যূত করতে পারে না বলেই আমার পথ সর্বদা কণ্টকাকীর্ণ এবং দুর্গম থেকে যায়। আমি একজন তৌহীদবাদী সৈনিক।
ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আমার জ্ঞান উল্লেখযোগ্য ছিল না বলে ১৯৭৬ সনের শেষ পর্যায়ে আমি রাজশাহী কারাগারের লাইব্রেরী থেকে প্রচুর ইসলামী বই নিয়ে কারাজীবন কাটাতে শুরু করি। তখন আমি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত একজন কয়েদী মাত্র। এ সময় ইসলাম-এর জ্ঞান অর্জনে আমি প্রচন্ডভাবে আকৃষ্ট হয়ে উঠি। জেলখানার বই ছাড়াও প্রচুর ইসলামী বই-পুস্তক বাইর থেকে বন্ধু বান্ধব এবং শুভাকাঙ্খীদের তরফ থেকে পেতাম। ১৯৭৯ সনের সংগঠিত ইরানের ইসলামী বিপ্লব আমাকে প্রভূতভাবে অনুপ্রাণিত করে তোলে। তখন থেকেই ইসলাম সম্পর্কে আমি অধিকতর জ্ঞান অর্জনের সাধনায় আত্মনিয়োগ করি। কারাগারের নির্জন সেল জীবনে জ্ঞান সাধনার সুযোগ অতুলনীয়। আমি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়িনি। এই ক্ষেত্রে আমাকে লোভী বলা চলে। এর পূর্বে ১৯৭৪-৭৫ সনে কারাগারে বসেই আমি মার্কসবাদ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে ব্রতী হই এবং কারার নির্জনতার সুযোগে “মার্কসবাদ মুক্তির পথ” “সূর্যোদয়”, “গুড বাঈ গার্ডিয়ানস”সহ ১০ খানা ছোট-বড় গ্রন্থ রচনা করি, যার মধ্যে প্রথম ২ খানা প্রকাশিত হয়েছে। এই জ্ঞান চর্চার একমাত্র লক্ষ্যই ছিল নির্যাতিত মানুষের সত্যিকারের মুক্তির পথ অনুসরণ করা। তাই আমার জাসদ ছেড়ে ‘ইসলামী বিপ্লবে’র পথে আসার ঘটনাটিকে যারা আকস্মিক ঘটনা, কিংবা কোন সুবিধাবাদী পদক্ষেপ বলে মনে করেন, তাদের সে ধারণা মোটেও সঠিক নয়। তাদের সে ধারণা স্বার্থবাদী চক্রান্তের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা-আক্রান্ত, বাস্তবতার জ্ঞানে সমৃদ্ধ নয়। আদর্শ এবং নীতির কারণেই আমি ইসলামী বিপ্লবের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক। আমার এই আদর্শগত সমর্থনকে যদি কেউ অপরাধ বলে মনে করেন, তাতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি বা পরিতাপ নেই, কারণ আমার রাজনীতি আদর্শ ভিত্তিক, স্বার্থভিত্তিক নয়।
সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার তা’য়ে গড়ে ওঠা ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’ (state capitalism) এবং বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির আচার-আচরণ এক ও প্রায় অভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। এই দুই বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থার ধারক দু’টি পরাশক্তি নিজ নিজ ক্ষমতা-বলয় বৃদ্ধির বেপরোয়া প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানবতাকে অসহায় এবং সুষ্ঠু বিকাশের অনুপযোগী করে তুলেছে বলেই পুনরায় যুগ চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে একটি নতুন সমাজ ব্যবন্থার, যা বিশ্ব মানবতার সুখ, শান্তি, শৃংঙ্খলা, কল্যাণ, নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি মানবতার সংরক্ষণ এবং ভারসাম্যজনক বিকাশের জন্য হবে সহায়ক। ইসলামী বিপ্লব সেই শূণ্যতাই কেবল পূরণ করে। ইসলামী বিপ্লব বিশ্ব মানবতার জন্য বয়ে আসে সেই নতুন সমাজ ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থা বিশ্বে বসবাসরত মানুষের ক্রমবর্ধমান আর্থিক এবং আধ্যাত্মিক চাহিদার মধ্যে সমন্বয় সাধন করার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে উপহার দিবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা।
পবিত্র কোরআন এই ঐশী অঙ্গীকার নিয়েই বিশ্বের সমগ্র মানবতার জন্য শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মাধ্যমে প্রেরিত হয়েছিলেন। অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশ্ব সেই সূর্যের কিরণে উদ্ভাসিত হবেই হবে ইনশাআল্লাহ। তাই ইসলামী বিপ্লব তৌহিদবাদী জনগনের ইচ্ছায়ই কেবল ঘটেনি, ইসলামী বিপ্লব হচ্ছে বর্তমান বিশ্ব চাহিদার অনিবার্য ফলশ্রুতি। পবিত্র কোরআন ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থাকে আল্লাহ বিশ্ব মানবতার জন্য বিশেষ রহমত এবং নিয়ামত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। কোরআন ভিত্তিক জীবন কেবল মুসলমানের জন্য মনোনীত হয়নি, বরং সমগ্র মানব গোষ্ঠীর জন্য মনোনীত করেছেন আল্লাহ। সুতরাং আমি তো ছার, বাংলাদেশ তো ছার সারা বিশ্বের সমগ্র মানব গোষ্ঠীকেই কোরআন ভিত্তিক জীবন গড়ে তোলার বিষয়টি নিয়ে সুস্থ মস্তিষ্কে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। আধ্যাত্মিকতাবিহীন বুদ্ধি ভিত্তিক নেতৃত্ব মানবতা সংরক্ষণে শোচনীয়ভাবেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। নিছক বস্তবাদী সভ্যতা ভারসাম্যহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তির কল্যাণমুখী বিকাশের স্বার্থেই আধ্যাত্মিকতার সাথে সমন্বয় সাধন করা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। ইসলাম ধর্মের সুষ্ঠু বিকাশ এই যুগ চাহিদা মেটাবার সামর্থ রাখে।”
শেষ জীবন: ১৯৮৪ সালে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে মেজর জলিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের জন্য কাজ করে গেছেন। দেশ বিদেশে তিনি মানুষের কাছে ইসলামের সঠিক বার্তা পৌছে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। মেজর জলিল ১৯৮৮ সালে ১১ নভেম্বর পাকিস্তান যাওয়ার পর হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৬ নভেম্বর পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তৎক্ষনাৎ তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৯৮৮ সালের ১৯ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০ টায় দুনিয়া থেকে চির বিদায় নেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন মেজর এম এ জলিল। সেই সাথে ইতিহাস হয়ে যায় বাংলাদেশের আরও একটি প্রতিবাদী কন্ঠ। ২২ নভেম্বর মেজর জলিলের মৃতদেহ ঢাকায় আনা হয় এবং যথাযথ সামরিক মর্যাদায় বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে দাফন করা হয়। মেজর জলিল প্রথম ব্যক্তি যার মৃত দেহ কবরস্থ করার মাধ্যমে মিরপুরের বুদ্ধিজীবি কবরস্থানের যাত্রা শুরু হয়। মহান আল্লাহ মেজর জলিলকে কবুল করুন। আমীন। সূত্র: ১) কৈফিয়ত ও কিছু কথা ২) অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা