মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প ম দিন আজ। একাত্তরের এই দিনে বিধ্বস্ত হয় পাকিস্তানী বাহিনীর অধিকাংশ বিমান। ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলো সারাদিন অবাধে আকাশে উড়ে, পাকিস্তানী সামরিক ঘাটিগুলোতে প্রচ- আক্রমণ চালায়। অকেজো করে দেয় বিমানবন্দরগুলো। ভারতীয় বিমান বাহিনীর হিসাব মতে- ১২ ঘন্টায় ২৩২ বার তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমান ঘাটিতে ৫০ টনের মত বোমা ফেলা হয়। পাকিস্তানী কনভয়ের ওপর ভারতীয় জঙ্গী বিমান আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তানী বাহিনীর ৯০ টি গাড়ি ধ্বংস হয়। এছাড়া পাকিস্তানী বাহিনীর সৈন্য বোঝাই কয়েকটি ল ধবংস হয়। বঙ্গোপসাগরে নৌ-বাহিনীর যৌথ কমান্ডের সফল আক্রমণে ধবংস হয় পাকিস্তানী সাব মেরিন ‘গাজী’।
এদিন নৌ-বাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে থাকা সব নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে বন্দর ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। তারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতেও অপরাগতা প্রকাশ করে। প্রধান হুঁশিয়ারি ছিল চট্টগ্রাম বন্দর সম্পর্কে। বলা হয়, আপনার সবাই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে চলে যান। এ সতর্কবাণী দু’টির একটা মর্মার্থ দাঁড়ায়-এক. বাংলাদেশের বন্দরগুলোর রক্ষা করার ক্ষমতা নেই পাকিস্তানী বাহিনীর। দুই. ভারতীয় নৌ-বাহিনীর জাহাজ ও বিমানগুলো সব বন্দর ঘায়েল করার সুযোগ পায়।
এদিন ভারতীয় বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সড়কগুলো অবরোধ করার ফলে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং রংপুরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রাজশাহীসহ অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও। ডিসেম্বরের ৫ তারিখে ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষা সচিব শ্রী কে বি লাল বাংলাদেশকে একটি বাস্তবতা বলে উল্লেখ করে ‘স্বীকৃতি দেয়া সময়ের ব্যাপার’ বলে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন। রাজনৈতিক এ পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধারা যাতে মনোবল দুর্বল না হয়; সেজন্য মিত্রবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী সেদিন জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দেন।
১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনও উত্তপ্ত ছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল লড়াইটা ছিল পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আর যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে বিশ্ব শিবির দুইভাবে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। এইদিনে জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি বলেন, কোনো শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চউ.এন লাই ভারতীয় হামলার মাঝেও পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়ার কথা বলেন।
কবি আসাদ চৌধুরী এ দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, “দেশ থেকে এবার বিদেশে। খোদ জাতিসংঘে। নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়, তাকে সমর্থন জানায় গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। ফ্রান্স এবং বৃটেন ভোট দানে বিরত থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিয়ে সে যাত্রা সামাল দিলো। পাকিস্তান যখন হেরে যাচ্ছে সে সময় যুদ্ধবিরতি মানা হলে মিত্রবাহিনী যে সাফল্য অর্জন করেছিল তাও হারাতে হতো।”
আরেক লেখক আহমাদ মাযহার তার ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “সর্বক্ষেত্রে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় পাকিস্তানী সেনাপতি জেনারেল নিয়াজী সমস্ত পাকিস্তানী বাহিনীকে ৫ ডিসেম্বর ঢাকার কাছাকাছি পদ্মা-মেঘনার নিকটবর্তী অ লে চলে আসতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় এবং ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ প্রচ- আক্রমণের কারণে তা কার্যকর করতে পারেনি পাকিস্তানী বাহিনী।”
এদিনে মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল এবং বিভিন্ন অ লে সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি অ ল দখল করে নেয়। বাংলাদেশের বিমানবাহিনী সিলেট সেক্টরে সাফল্যের সাথে বোমাবর্ষণ করে শত্রুর পাঁচটি বাংকার উড়িয়ে দেয় ও একডজন যানবাহন ধ্বংস করে। সম্মিলিত মিত্রবাহিনী ১৫টি ফ্রণ্টে তাদের অগ্রগতি অব্যাহত রাখে। যশোর সেক্টরে কোটচাঁদপুর দখল করে তারা ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হয়। এ পথে মুক্তিবাহিনী খালিসপুর সেতুটি দখল করে এবং কুষ্টিয়ার কাজীপুরের পতন ঘটে। মিত্রবাহিনী তিতাস সেতু দখল করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে চলে। তারা সাফল্যের সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়। ( গ্রন্থনা: ইবরাহীম খলিল )