হজরত উমর ফারুক ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। একজন সুদক্ষ, বিচক্ষণ, সাহসী ও প্রজাবৎসল শাসক হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ২৩ আগস্ট ৬৩৪ থেকে ৩ নভেম্বর ৬৪৪ পর্যন্ত ১০ বছর খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। হজরত হামজা রা:-এর ইসলাম গ্রহণের তিন দিন পর নবুয়তের ষষ্ঠ বছরের জিলহজ মাসে হজরত উমর রা: ইসলাম গ্রহণ করেন। হজরত হামজা রা: ও হজরত উমর রা:-এর ইসলাম গ্রহণ ছিল দ্বীনের আলো প্রজ্বলিত ইঙ্গিত হওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত এবং কুরাইশদের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা।
হজরত উমর রা:-এর ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং তাদের ওপর পাইকারি নির্যাতন বন্ধ হয়ে যায়। হজরত উমর রা: ইসলাম গ্রহণের পর মহানবী সা:-কে প্রশ্ন করেন হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি হকের ওপর নেই? রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহর শপথ অবশ্যই হকের ওপর আছি।’ আপনি কি সত্য নবী নন? রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘অবশ্যই সত্য নবী?’ ইসলাম কি সত্য দ্বীন নয়? রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘অবশ্যই সত্য দ্বীন’। তাহলে গোপনীয়তা কেন? আমরা কেন পালিয়ে বেড়াব? সেই সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, অবশ্যই আমরা বাইরে বের হবো। অতঃপর দুই কাতারে বিভক্ত হয়ে মিছিল করে আল্লাহর রাসূলকে সাথে নিয়ে বাইরে বের হলেন। এক কাতারের সামনে ছিলেন হজরত হামজা রা: অন্য কাতারে উমর রা:। হজরত উমর রা:-এর সেই দিনের বীরত্বে খুশি হয়ে মহানবী সা: ফারুক উপাধি দেন। হজরত উমর রা:-এর ইসলাম গ্রহণের আগে সাহাবিরা কাবাঘরের কাছে এসে নামাজ আদায়ে সক্ষম ছিলেন না।
হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা:-এর ওফাতের পর হজরত উমর রা: খলিফা নির্বাচিত হন। তিনি প্রায় অর্ধ পৃথিবী ইসলাম দখলে নিয়ে আসেন। অতঃপর বিভিন্ন এলাকায় তিনি শাসক নিয়োগ করেন। তাদেরকে তিনি যে নির্দেশ দেন তা হলো- তোমরা তুর্কি ঘোড়ায় চড়বে না। তুর্কি ঘোড়া ছিল তখন উন্নত ও সেরা বাহন। হজরত উমর রা: শাসকদেরকে দামি বাহন ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। কারণ ইসলামী শাসকের জন্য সরকারি অর্থের অপব্যবহার বৈধ নয়। উৎকৃষ্ট খেজুর ভক্ষণ করবে না। প্রজারা যে ধরনের খাদ্য ভক্ষণ করে তা ভক্ষণ করবে। কারণ, ইসলামে রাজা-প্রজার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মিহি তথা দামি পোশাক পরিধান করবে না; বরং সাধারণ পোশাক পরিধান করবে। তোমাদের গৃহ বন্ধ করবে না; বরং সদা খোলা রাখবে। যাতে কোনো বিচারপ্রার্থী বা কোনো প্রয়োজনে আগত ব্যক্তির ফিরে যেতে না হয়। অতঃপর তিনি বলেন, যদি আমার এ নির্দেশের পরিপন্থী কাজ করো, তবে তোমাদের জন্য শাস্তি অবধারিত হয়ে যাবে। (বায়হাকি, মিশকাত হাদিস নং-৩৭৩০) হজরত উমর রা: যেমন ছিলেন, তিনি তার গভর্নরদের সেভাবে কাজ করতে নির্দেশ জারি করেন। হজরত উমর ফারুক ও অন্যান্য খোলাফায়ে রাশেদিনের জীবনী থেকে বর্তমানের মুসলিম শাসক শিক্ষা গ্রহণ করলে পৃথিবী স্বর্গে পরিণত হতো। তার অধীনস্থ হিমসের শাসক ছিলেন হজরত সাঈদ ইবন আমের আল জুমাহি রা:। গভর্নর হয়েও তিনি সাদামাটা দারিদ্র্য জীবন যাপন করতেন। তিনি রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডার থেকে গভর্নরের দায়িত্ব পালনের জন্য কোনো ভাতা গ্রহণ করতেন না। একদা হিমস থেকে একদল লোক মদিনায় হজরত উমর রা:-এর সাথে দেখা করতে আসে, তিনি তাদেরকে হিমসের দরিদ্রদের তালিকা করতে বলেন। তারা হিমসের দরিদ্রদের একটি তালিকা তৈরি করে হজরত উমর রা:-এর কাছে দেন। হজরত ওমর রা: দেখেন দরিদ্রদের তালিকায় এক নম্বরে সাঈদ তথা তাদের গভর্নরের নাম। এতে হজরত উমর রা: মর্মাহত হন এবং পৃথকভাবে গভর্নরের জন্য এক হাজার দিনারের একটি থলে দেন। তিনি দিনারের থলে দেখে এত জোরে ‘ইন্না লিল্লাহ’ পড়েন, যার ফলে তার স্ত্রী জানতে চান কী হয়েছে, খলিফা কি ইন্তেকাল করেছেন? সাঈদ বলেন, না বরং তার চেয়ে মারাত্মক অবস্থা হয়েছে আমার ঘরে দুনিয়া প্রবেশ করেছে। খলিফা আমার জন্য এক হাজার দিনার পাঠিয়েছেন। স্ত্রী বলেন, সমস্যা নেই, আপনি তা দান করে দেন। সাঈদ সাথে সাথে গরিব মিসকিনদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। হজরত উমর রা: হিমস সফরে গেলে প্রজারা তার বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ করে-
প্রজারা অভিযোগ করে, তিনি খানিকটা বেলা গড়িয়ে না পড়লে আমাদের দেখা দেন না। কারণ জিজ্ঞেস করলে সাঈদ বলেন, আমার ঘরে কোনো চাকর নেই, তাই নিজেই সকালের খাবার প্রস্তুত করে খাবার গ্রহণপূর্বক জনগণের সাথে দেখা করি। প্রজারা দ্বিতীয় অভিযোগে বলে- তিনি রাতে আমাদের সাক্ষাৎ দান করেন না। হজরত উমর রা:-এর করণ জিজ্ঞেস করলে সাইদ বলেন, আমি রাতকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করেছি। তাই রাতে কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে পারি না।
প্রজারা আরেকটি অভিযোগ করল- তিনি সপ্তাহে একটি দিন কারো সাথে সাক্ষাৎ করেন না। উমর রা:-এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, আমার কোনো চাকর বাকর এবং অতিরিক্ত জামা নেই। সপ্তাহে এক দিন জামা কাপড় ধৌত করি, তাই সাক্ষাৎ করতে পারি না। সর্বশেষ অভিযোগ করেন, আমাদের গভর্নর হঠাৎ করে মজলিসে বেহুঁশ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। হজরত উমর রা:-এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, মুসলমান হওয়ার আগে আমার সামনে হজরত খুবাইব ইবন আদিকে শহীদ করা হয়। এ দৃশ্য যখন আমার সামনে ভেসে উঠে তখন আমি স্থির থাকতে পারি না। হজরত উমর রা: সমস্ত অভিযোগ শুনে খুবই দুঃখিত ও মর্মাহত হন এবং তিনি তার জন্য আবার এক লাখ দিনার প্রেরণ করেন। তিনি তাও গরিব-দুঃখীদের মধ্যে দান করে দেন। হজরত ওমর রা: তাকে একবার মদিনায় ডেকে পাঠান তখন তার হাতে ছিল একটি লাঠি ও একটি পেয়ালা। তাই ছিল তার সম্পদ। তিনি হিজরি ২০ মতান্তরে ২১ সনে মোতাবেক ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে হিমসের গভর্নর থাকাবস্থায় ইন্তেকাল করেন। মহানবী সা: বলেন- ‘উত্তম শাসক হলো তারা যাদেরকে প্রজারা ভালোবাসে, তারাও প্রজাদেরকে ভালোবাসে এবং প্রজারা তাদের জন্য দোয়া করে, তারাও প্রজাদের জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম) লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী