কোনো জাতির মধ্যে আল্লাহর অবাধ্যতা বেড়ে গেলে, জুলুম-অত্যাচার বেড়ে গেলে, শাসনের বদলে শোষণ হলে ও অবাধে সবাই পাপাচারে লিপ্ত হলে আল্লাহ নানানভাবে শাস্তি দেন। ভূমিকম্প, ঝড়-তুফান, জলোচ্ছ্বাস, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী ইত্যাদি শাস্তি নেমে আসে। জুলুম একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো নির্যাতন বা অবিচার। সাধারণ অর্থে কাউকে অন্যায়ভাবে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক বা যেকোনো পন্থায় অবিচার বা নির্যাতন করাকে জুলুম বলে। তবে জুলুমের সবচেয়ে উত্তম সংজ্ঞা হলো, কোনো কিছু নিজ স্থান বাদ দিয়ে অন্য কোনো স্থানে প্রয়োগ করা বা রাখা। এই সংজ্ঞাটি ব্যাপক অর্থবহ। সব ধরনের জুলুম এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। মানুষ মানুষের হক বা অধিকার নষ্ট করার অর্থই হলো তার জানমাল ও ইজ্জতের ওপর আক্রমণ করা। আর এরও নাম জুলুম। জুলুম যে কত বড় অপরাধ এ প্রসঙ্গে হজরত সুফিয়ান সাওরি রহ: বর্ণনা করেন, একসময় বনি ইসরাইলের মধ্যে এমন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল যে, তারা তখন নিরুপায় হয়ে পথের মৃত জানোয়ার খেতে শুরু করল। ক্রমে পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটল যে, মানুষ মানুষকে ধরে খাওয়ার উপক্রম হয়ে গেল। তখন সাধারণ মানুষ পেরেশান হয়ে মাঠে ময়দানে, পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিতে শুরু করল এবং আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। তখন আল্লাহ পাক সে যুগের নবীকে ওহির মাধ্যমে জানিয়ে দেন, আপনি তাদেরকে সতর্ক করে দিন যে, আমার কাছে দোয়া করতে করতে যদি তাদের মুখের ও চোখের পানি শুকিয়েও যায় এবং যদি তাদের প্রার্থনার হাত আকাশ পর্যন্ত উঠে যায় তবুও কারো ক্রন্দনে আমি আমার করুণা বর্ষণ করব না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা একে অপরের ওপর জুলুম করা থেকে বিরত না থাকবে। অতঃপর নবী তার জাতিকে এ কথা জানিয়ে দেন।
তা ছাড়া দুর্ভিক্ষ হলো কোনো এলাকার ব্যাপক খাদ্যঘাটতি। সাধারণত ফসলহানি, যুদ্ধ, সরকারের নীতিগত ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গবাদিপশুর মড়ক, পোকার আক্রমণ ইত্যাদি কারণেও দুর্ভিক্ষ হয়। অশ্লীলতা ও ব্যভিচারের কারণেও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আমর ইবনুল আস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূল সা:-কে বলতে শুনেছি, ‘যে জাতির মধ্যে ব্যভিচার বিস্তার লাভ করে, তাদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে পাকড়াও করা হয়।’ (মুসনাদে আহমদ-১৭৮১২; মিশকাত-৩৫৮২)
তবে চিরন্তন সত্য হচ্ছে, মজলুমের দোয়া আল্লাহর দরবারে সরাসরি কবুল হয়ে যায়। তাই মজলুমের দোয়াকে ভয় করতে বলা হয়েছে। সর্বশেষ নবী সা: হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা:-কে নসিহত করতে গিয়ে বলেন, তুমি মজলুমের বদদোয়াকে ভয় করো। কেননা, তার (বদদোয়া) মধ্যে এবং আল্লাহর মধ্যে কোনো পর্দা থাকে না। (সহিহ বুখারি-১৪৯৬) আরেক হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের শাসকরা যখন আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা না করে এবং আল্লাহর নাজিলকৃত বিধানকে গ্রহণ না করে, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন। আর যুদ্ধ দুর্ভিক্ষ নিয়ে আসে।’
সূরা বাকারার ৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর জালেমরা কথা পাল্টে দিয়েছে, যা কিছু তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল তা থেকে। তারপর আমি অবতীর্ণ করেছি জালেমদের ওপর আজাব, আসমান থেকে, নির্দেশ লঙ্ঘন করার কারণে।’
আজাব দ্বারা মহামারী হতে পারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগও হতে পারে এবং দুর্ভিক্ষও হতে পারে। জুলুম একটি সামাজিক ব্যাধি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র ব্যাপক আকার ধারণ করেছে এটি। অন্যের ওপর অন্যায় বা অবিচার করে নিজের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে জালিমরা। আপদ-বিপদ, দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগ-বিশৃঙ্খলায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো জুলুম। তাই আল্লাহ তায়ালা সবাইকে তা থেকে নিষেধ করেছেন। এমনকি আল্লাহ নিজের জন্যও এটিকে হারাম করেছেন। রাসূল সা: হাদিসে কুদসিতে আল্লাহর কথা বর্ণনা করে বলেন, ‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’ (মুসলিম-৬৭৩৭) আল্লহ তায়ালা এই জাতিকে জুলুম সম্পর্ক কতটুকু হুঁশিয়ারি করেছেন, তা হাদিসের ভাষা থেকে অনুমান করা যায়। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, যখন জমিনে জুলুম-অত্যাচার ও শোষণ শুরু হয়, তখনই দুর্ভিক্ষের আবির্ভাব ঘটে। লেখক : তরুণ আলেম ও সাংবাদিক