পৃথিবীর মালিক আল্লাহ তায়ালা চান পৃথিবীর সব সৃষ্টি তাঁর নির্দেশ মতো চলুক। এ লক্ষ্যে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন অগণিত নবী-রাসূল। তাঁরা দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন, আল্লাহর কথাগুলো মানুষকে বলেছেন। কিন্তু তারা সে দিকে কর্ণপাত করেনি; বরং নবী-রাসূলদের সাথে অমানবিক আচরণ করেছে। কাউকে প্রহার করেছে, কাউকে জাদুকর, পাগল ইত্যাদি বলেছে, কাউকে হত্যা করেছে। পরবর্তীতে আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট হয়ে সেসব জাতিকে ধ্বংস করে দেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেককেই তার অপরাধের কারণে পাকড়াও করেছি। তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড বাতাস, কাউকে পেয়েছে বজ্রপাত, কাউকে বিলিন করেছি ভূগর্ভে এবং কাউকে পরিণত করেছি সলিল সমাধিতে’ (সূরা আনকাবুত-৪০)। ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর মধ্যে সাতজন নবী-রাসূলের সাত জাতি সুপ্রসিদ্ধ।
মূসা আ:-এর জাতি : হজরত মূসা আ:-এর নাম কুরআন মাজিদের ৩৫টি সূরায় ১৩৭ বার এসেছে। এত বেশি কারো নাম আসেনি। তিনি ছিলেন বনি ইসরাইল বংশের। প্রেরিত হয়েছিলেন ফেরাউন সম্প্রদায়ের কাছে। সে ছিল একজন শক্তিশালী শাসক। দেশের সমস্ত প্রজাকে সে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিল এবং নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করত। হজরত মূসা আ: যখন তাকে দ্বীনের দাওয়াত দেন, তখন সে হজরত মূসা আ:-কে মাতাল, জাদুকর, ইত্যাদি বলতে থাকে। ফেরাউনের অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে আল্লাহ তায়ালা হজরত মূসা আ:-কে মিসর ত্যাগের নির্দেশ দেন। আল্লাহর বাণী- ‘আমার বান্দাদের নিয়ে রাতে বের হয়ে পড়ো’ (সূরা শুয়ারা-৫২)। আল্লাহ তায়ালা হজরত মূসা আ: ও তাঁর অনুসারীদের লোহিত সাগরের ভেতর দিয়ে রাস্তা করে দিয়ে রক্ষা করেন। আর ফেরাউন ও তার অনুসারীদের ডুবিয়ে মারেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘ফেরাউনের জাতিকে পানিতে ডুবিয়ে মারার মধ্যে রয়েছে আল্লাহ তায়ালার কুদরতের মহানিদর্শন; কিন্তু তাদের অনেকেই বিশ্বাস করে না’ (সূরা শুয়ারা-৬৭)। আল্লাহ তায়ালার কুদরত যে কত মহান তার দৃষ্টান্ত লোহিত সাগরে রাস্তা করে দিয়ে হজরত মূসা আ: ও তার বাহিনীকে রক্ষা করা।
ইবরাহিম আ:-এর জাতি : হজরত ইবরাহিম আ:-এর উপনাম হলো আবুল আম্বিয়া তথা নবীদের জনক। সাতজন নবী-রাসূল ছাড়া সব নবী-রাসূল তাঁর বংশ থেকে এসেছেন। কুরআন মাজিদেও ২৫টি সূরায় ৬৯ বার তাঁর নাম এসেছে। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে প্রেরণ করেছিলেন নমরুদের কাছে। সে ছিল সব দুনিয়ার শাসক। মূর্তিপূজায় ডুবেছিল তার সব প্রজা। তিনি প্রথমত তাঁর পিতা আজর ও তাঁর জাতিকে মূর্তিপূজা বর্জন করতে বলেন। তারা প্রত্যুত্তরে তাঁকে বলল- আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের যে কাজের ওপর পেয়েছি তোমার কথায় তো ছাড়তে পারি না। নির্দিষ্ট দিনে তারা মেলায় চলে গেলে তিনি মূর্তিগুলো ভেঙে চুরমার করে, বড়টির কাঁধে কুঠার দিয়ে মূর্তির অসারতা প্রমাণ করলেন। এতে রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে হজরত ইবরাহিম আ:-কে আগুনে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম আ:-কে রক্ষা করেন। আর নমরুদ ও তার বাহিনীকে মশা দিয়ে ধ্বংস করেন। আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে ক্ষুদ্র প্রাণী দিয়েও শক্তিশালী জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নমরুদের জাতি ধ্বংস হওয়া।
নূহ আ:-এর জাতি : তাঁর নাম আবদুল গাফফার। নূহ অর্থ অধিক ক্রন্দনকারী। স্বীয় জাতির চিন্তায় অধিক ক্রন্দন করতেন বলে নূহ উপাধিতে ভূষিত হন। তাকে আদমে সানি বা দ্বিতীয় আদম বলা হয়। কুরআন মাজিদের ৩১টি সূরায় ৪৩ বার তার নাম এসেছে। তিনি তাঁর জাতিকে ৯৫০ বছর দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। তারা তাঁর দাওয়াত তো গ্রহণ করেনি; বরং তাঁকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করার হুমকি দেয়। তিনি তখন আল্লাহ তায়ালার আশ্রয় কামনা করেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে একটি নৌকা তৈরি করার নির্দেশ দেন। তিনি ৩০০ হাত দৈর্ঘ্য, ৫০ হাত প্রস্থ ও ২০ হাত উঁচু একটি বিশাল নৌকা তৈরি করেন। আল্লাহ তায়ালা জোড়া জোড়া সব প্রাণী এবং তাঁর উম্মতকে নৌকায় আরোহণের নির্দেশ দেন। আল্লাহ তায়ালা হজরত নূহ আ: ও তাঁর জাতিকে নৌকার মাধ্যমে রক্ষা করেন, আর তাঁর জাতিকে পানিতে ডুবিয়ে মারেন। নবীর কথা না শুনলে কী অবস্থা হতে পারে- নূহ আ:-এর জাতি এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
হুদ আ:-এর জাতি : তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন আদ জাতির কাছে। তারা বিনা প্রয়োজনে প্রাসাদ নির্মাণ ও বড় বড় অট্টালিকা তৈরিতে ব্যস্ত ছিল। তারা বলত- পৃথিবীতে আমাদের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী কে আছে? তা ছাড়া তারা ছিল জালেম ও নিষ্ঠুর স্বভাবের। পার্থিব সুখ শান্তিকেই তারা প্রাধান্য দিত। পরকালের প্রতি তাদের বিশ্বাস ছিল না। হুদ আ: আল্লাহকে মান্য করার এবং তাঁর আনুগত্য করার কথা বললে তারা বলল- ‘(আল্লাহ তায়ালার বাণী) তুমি উপদেশ দাও বা নাই দাও, উভয়ই আমাদের জন্য সমান’ (সূরা-১৩৬)। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাদের শাস্তিস্বরূপ প্রেরণ করেন প্রবল ঘূর্ণিঝড়। সাত দিন ধরে অবিরাম ঝড়-তুফান চলতে থাকে। হজরত হুদ আ:-এর প্রতি তিন হাজার কয়েক শ’ ব্যক্তি ঈমান এনেছিল। তারা ছাড়া অন্যদেরকে আল্লাহ তায়ালা এ ঝড়-তুফানে ধ্বংস করে দেন।
সালেহ আ:-এর জাতি : তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন সামুদ জাতির কাছে। তারা পার্থিব ভোগ বিলাসে মত্ত ছিল। পাহাড়কে সহজেই গৃহে রূপান্তরিত করতে পারত। তা ছাড়া বিনা প্রয়োজনে তারা অট্টালিকা নির্মাণ করত। পরকালের ভয় তাদের অন্তরে মোটেও ছিল না। হজরত সালেহ আ: তাদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দিলে তারা মুজিজা প্রত্যাশা করল। তিনি পাথর থেকে গর্ভবতী উষ্ট্রী বের করেন। তাদের সামনে উষ্ট্রীটি বাচ্চা প্রসব করে। কিন্তু তারা জাদু বলে তা প্রত্যাখ্যান করে। তিনি তাদের বলেন, তারা যাতে এ উষ্ট্রী ও তার বাচ্চার কোনো ক্ষতি না করে এবং নির্দিষ্ট দিনে উভয়কে পানি পান করতে দেয়। কিন্তু তারা নির্দিষ্ট দিনে পানি পান করতে দেয়নি। এমনকি কেদার নামক এক ব্যক্তি উষ্ট্রীটিকে হত্যা করে তার গোশত বণ্টন করে নিয়ে যায়। হজরত সালেহ আ: তখন দাওয়াতি কাজে বাইরে ছিলেন। ফিরে এসে তাদের তিন দিনের মধ্যেই এ কর্মের জন্য তওবা করতে বলেন। কিন্তু তারা তওবা করেনি। ফলে চতুর্থ দিন আসমান থেকে এক প্রকট আওয়াজ হলো, এতে সামুদ জাতি সবাই মৃত্যুবরণ করল। শুধু মুমিনরা রক্ষা পেলেন। আওয়াজ দিয়ে যে একটি জাতিকে আল্লাহ তায়ালা ধ্বংস করে দিতে পারেন, তার দৃষ্টান্ত হজরত সালেহ আ:-এর জাতি।
লুত আ:-এর জাতি : তিনি ছিলেন হজরত ইবরাহিম আ:-এর ভাই হারানোর পুত্র। তিনি বর্তমান জর্দান ও তার আশপাশের এলাকায় নবী হয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন। তার গোত্রের প্রধান অপকর্ম ছিল তারা নারীদের পরিবর্তে অল্প বয়স্ক ছেলেদের সাথে ব্যভিচার করত। তিনি তাদেরকে এ অপকর্ম বর্জন করতে বললে, তারা তাঁকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে। অতঃপর তিনি আল্লাহ তায়ালার আশ্রয় কামনা করলে তিনি তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য পাথরের বৃষ্টি, ভূমিধস ও দেশকে উল্টিয়ে দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। জর্দানের মৃতসাগর কালের সাক্ষী হিসেবে এখনো বিদ্যমান।
শুয়াইব আ:-এর জাতি : তিনি দুই জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। প্রথমত আইকাবাসীর কাছে প্রেরিত হন। আইকা এমন একটি জনপদের নাম, যেখানে প্রচুর গাছগাছালি ছিল। তাদের প্রধান অপকর্ম ছিল- তারা ওজন ও পরিমাপে কম দিত। হজরত শুয়াইব আ: তাদের এ কাজ করতে বারণ করলে তারা তার কথা শুনেনি; বরং তাঁকে জাদুকরগ্রস্ত ও মিথ্যাবাদী বলে অপবাদ দেয়। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে শাস্তি দেন। সাত দিন ও সাত রাত তাদের মধ্যে বাতাস বন্ধ করে দেন। অতঃপর অক্সিজেনের অভাবে তাদের মৃত্যু হয়। তিনি দ্বিতীয়বার প্রেরিত হয়েছিলেন মাদায়েন জাতির কাছে। তারাও তার কথা শোনেনি। অতঃপর হজরত জিবরাইল আ: এক আওয়াজের মাধ্যমে সবাইকে ধ্বংস করে দেন। তাঁর উম্মত ছিল ২ হাজার ৯০০ জন। লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী