বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করছে। দেশে ১৯৯০ সালে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ৩০৬ দশমিক ২৭ মার্কিন ডলার। ২০১০ সালে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ৭৬১ দশমিক ১৫ মার্কিন ডলার। তবে ২০২১ সালে দেশের মাথাপিছু জিডিপি হয়েছে ২ হাজার ৫০৩ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির মূলে আছে পোশাকশিল্পের উন্নতি এবং প্রবাসীগণের মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্স বৃদ্ধি। আমাদের দেশে দরিদ্র পরিবার থেকে অতি কষ্টে স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর বেকার থাকা একটি বিরাট সমস্যা। বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত প্রায় ২ হাজার ৩০০টি কলেজের অধীনে প্রতি বছর প্রায় ৪ দশমিক ৫ লাখ ছাত্রছাত্রী স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ বেকার থাকছেন। বর্তমানে এটি ৩৩ শতাংশ। কয়েক বছরের গড় প্রায় ৪০ শতাংশ। বেকার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ বিদেশ চলে যাচ্ছেন। কেউ-বা মূলত ব্যবসা করছেন গ্রামে। অনেকে মৎস্য চাষ, হাঁসমুরগি অথবা গবাদি পশু পালনে নিয়োজিত রয়েছেন। অনেকেই ফ্রিল্যান্সিংয়ে জড়িত রয়েছেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে জানা গেল, স্নাতক সম্পন্ন করার পর বেকার যুবকদের প্রায় ২০ শতাংশ ফ্রিল্যান্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত এবং টিউশনির সঙ্গে জড়িত প্রায় ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ ধারণা করা যায়, শিক্ষিত বেকারদের প্রায় ৬৫ শতাংশ বিভিন্ন সম্মানজনক কাজের সঙ্গে জড়িত হচ্ছেন। বিগত কয়েক বছরে গড়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারীদের সংখ্যা প্রায় ৩ দশমিক ৭ লাখ। প্রতিবেদনের তথ্যগুলো সঠিক হলে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী বেকার জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন তথ্য এবং উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অনুমান করা যায়, দেশে স্নাতক ডিগ্রি অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। মোটামুটি সম্মানজনক কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রায় ৯ দশমিক ৭৫ লাখ বা প্রায় ১০ লাখ। বাকি রইলেন প্রায় ৫ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ নারী এবং বিবাহিতা এর প্রায় ৯৫ শতাংশ। বিবাহিতা নারী বাদ দিলে এই বেকারের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩ দশমিক ৬ লাখ। এই ৩ দশমিক ৬ লাখ স্নাতক ডিগ্রি অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে পারিবারিকভাবে কিছুটা আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারে ১০ শতাংশ। অর্থাৎ বাকি ৩ দশমিক ২৪ লাখ বা ৩ দশমিক ২৫ লাখ দরিদ্র পরিবারের স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী বেকারের অবস্থা সত্যিই করুণ। জীবনের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে তাদের ছোটখাটো কাজ করতে হচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যায়, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় এবং স্নাতক পর্যায় শেষ করতে তাদের পরিবারের এবং রাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে। যদিও সবাই জীবনের প্রয়োজনে সব কাজই করতে পারে এবং কোনো কাজই ছোট নয়, তবু এতদিন পড়াশোনা করে ছোট পরিসরে কাজ করা কষ্টকর এবং দুঃখজনক। উচ্চশিক্ষিত হয়ে ছোটখাটো কাজ করতে হলে প্রায়ই শুনতে হয় মানুষের কটু কথা। আমাদের অনেকেরই হয়তো ধারণা নেই, জীবনের প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষিত এসব তরুণ কী ধরনের কাজ করতে বাধ্য হন। কয়েক জন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কেউ কেউ সিএনজি অথবা ব্যাটারিচালিত টমটম চালান, কৃষিকাজ করেন, কেউ রঙের মিস্ত্রির কাজ করেন, হোটেলে কাজ করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, কঠিন বাস্তবতায় একজন অনার্স ও মাস্টার্সধারীকে রিকশা চালানোর কথাও শোনা গেল। অনেকে মনের দুঃখে কাউকে কিছু না জানিয়ে অন্য জেলায় চলে যান এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা গোপন রেখে ছোটখাটো কাজ করেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ বেকার। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। স্ব-উদ্যেগে কিছু করেন ৩ শতাংশের মতো। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারীকে একেবারে অযোগ্য বলার সুযোগ নেই। উচ্চশিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর সমস্যাগুলো গভীরভাবে অনুধাবন করা এবং এ সমস্যা সমাধানের উপায়গুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। কিছুদিন আগে সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি কর্তৃক আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামের অর্থনীতি সম্পর্কিত একটি বিষয়ে মালটিমিডিয়া প্রজেক্টের মাধ্যমে তথ্য ও উপাত্ত উপস্থাপনের সুযোগ হয়েছিল আমার। অনুষ্ঠানটিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। ১৯৯০ সালে ভিয়েতনামে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং মাথাপিছু জিডিপি ছিল মাত্র ৯৫ দশমিক ১৯ ডলার। ২০১০ সালে দেশটিতে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৬৭৩ ডলার। তবে ২০২১ সালে দেশটিতে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬৯৪ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, বৈদেশিক বিনিয়োগ ভিয়েতনামের মাথাপিছু আয়, কর্মসংস্থান, জীবনযাত্রার মান ইত্যাদিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত মি. পাম ভিয়েত চেন জানান, ভিয়েতনাম বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখে এবং যথাযথ সম্মান ও ‘লাল গালিচা’ সংবর্ধনা প্রদান করে। অনুরূপভাবে আমাদের দেশেও বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পেলে দেশের প্রায় ১৫ লাখ স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার যুবকদের চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ। এসব উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবকের প্রতি মাসে মাত্র ২০০ থেকে ৬০০ ডলার বেতনে বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরি প্রদানের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের শ্রমব্যয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিষয়টি আমাদের পজিটিভ দিক হতে পারে। আমাদের দেশে বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কলেজগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স অথবা ডিগ্রি কোর্স চালু হচ্ছে। দেশে এখনো কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবলের চাহিদা রয়েছে। ফিনল্যান্ডে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যে কোনো পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষা এবং আইটি-সংক্রান্ত শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনায় আনা একান্ত প্রয়োজন। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতির সঙ্গে কোনো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সঞ্চয় ইত্যাদির সম্পর্ক রয়েছে। বিনিয়োগবান্ধব রাজস্বনীতি অথবা মুদ্রানীতির বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন। বাজারে কাজের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সংগতিপূর্ণ নয়। মনে করি, বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে অটোমোবাইল শিল্পে বিনিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ করল। এক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন পড়বে। আমাদের দেশের যুবকদের জন্য টেকনিক্যাল এবং ভোকেশনাল শিক্ষা প্রয়োজন। দেশে টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভোকেশনাল বিশ্ববিদ্যালয় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন ট্রেনিং অথবা খ-কালীন চাকরির ব্যবস্থা করতে পারে। গ্রামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ফিশ প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি, ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি, ব্রেড-বিস্কুট ফ্যাক্টরি ইত্যাদি হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বৃহৎ আকারের মৎস্য খামার, হাঁস-মুরগির খামার, গবাদি পশুর খামার ইত্যাদি গড়ে ওঠা প্রয়োজন এবং এতে বিভিন্ন ধরনের সরকারি প্রণোদনা প্রয়োজন। লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট