সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫, ০৮:৩৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
পুঁইশাক চাষে সফল সুফিয়া, আগ্রহী হচ্ছে অন্য কৃষকরাও অতিরিক্ত টোল আদায় করলেই ইজারা বাতিল-ভোলায় উপদেষ্টা সাখাওয়াত কৃতি ফিরোজীকে বাঁচাতে সাভারে চ্যারিটি কনসার্ট আওয়ামী লীগের সাথে দ্বন্দ্ব নাই, যারা অন্যায় করেছে তাদের বিচার চাই-আব্দুল আউয়াল মিন্টু জলঢাকায় গণঅধিকার পরিষদের গণসমাবেশ সোনারগাঁওয়ে মাসব্যাপি লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব শুরু শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানে ৮৯তম জন্মদিন উপলক্ষে আগৈলঝাড়া বিএনপি’র উদ্যোগে আনন্দ র‌্যালি পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষতিগ্রস্তুদের অবস্থান কর্মসূচি জামালপুর পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড বিএনপির আয়োজনে দুস্থদের মাঝে কম্বল বিতরণ ভুট্টা চাষে দেশের শীর্ষে চুয়াডাঙ্গা: ৫৯,৬৫৬ হেক্টর জমিতে আবাদ

গ্রামীণ চিকিৎসা ও শিক্ষার পরিবেশ

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২

আজ থেকে ১৭১ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৫২ সালে বাংলার গ্রাম সম্পর্কে হাউজ অব লর্ডস সিলেকশন কমিটির কাছে ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকার সম্পাদক আলেকজান্ডার ডাফ বিবৃতিতে যা বলেছিলেন পল্লী বাংলার আর্থসামাজিক পরিবেশ পর্যালোচনায় আজো তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য প্রতীয়মান হয়। ভারতবর্ষে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের বয়স ৯৫ বছর।
সিলেকশন কমিটির কাছে তৎকালীন পল্লী বাংলার সার্বিক অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে ডাফ বলেছিলেন, ‘দূর থেকে গ্রামের দৃশ্য দেখে গ্রাম সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা ভ্রান্ত হবে। গ্রামের সুন্দর ছায়াঘেরা বাঁশবন, বেতবন, ঝাউগাছ, পিপুলগাছ, আম, জাম, কাঁঠাল, কলা প্রভৃতি ফলবাগান, মাঠে সবুজ ঘাস ও ফসল হচ্ছে তার বাহ্যিক রূপ; কিন্তু এর অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা বড়ই করুণ, বড়ই বেদনাদায়ক।’
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৮৫৯ পর্যন্ত) ভারতে ব্রিটিশ সরকার (১৯৪৭ পর্যন্ত) ও হুকুমতে পাকিস্তান (১৯৭১ পর্যন্ত) এবং পরবর্তীকালের স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর ব্যবধানে এসে পল্লী বাংলার স্বাস্থ্যব্যবস্থার সাম্প্রতিক অবস্থান নিয়ে লিখতে গিয়ে আলেকজান্ডার ডাফের পর্যবেক্ষণটি কেন জানি বড্ড মনে পড়ে গেল। মনে পড়ত না যদি সাম্প্রতিককালে এ ধরনের ঘটনার প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষিত হতো- দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এক অনগ্রসর গ্রামের কলেজ পড়ুয়া ছেলে দরিদ্র পিতা-মাতার ভবিষ্যতের একমাত্র স্বপ্ন। ফুটবল খেলতে গিয়ে তার হাঁটুতে চোট লাগে। হাঁটুর ভেতরে ক্ষতচিহ্নে ইন্টারনাল হ্যামারেজে জায়গাটি বেশ ফুলে ওঠে। ব্যথা হয়। কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিকের এ ব্যাপারে করার কিছু ছিল না, থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক শুধু ব্যথা কমানোর সাধারণ মানের ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেয়, কাজ হয় না। পাশের উপজেলায় ব্যক্তিবিশেষের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ট্রমা চিকিৎসার প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কোনো সদুপদেশ মেলে না। জেলা সদরের সরকারি হাসপাতালে প্রবেশ ও পরামর্শলাভ সুদূর পরাহত প্রতীয়মান হওয়ায় বেসরকারি ব্যবসায়ী ডাক্তার সাধারণ মানের এক্সরে করে হাঁটুর ভেতরে ফ্যাপসা অংশ দেখার পরও সাধারণ মান ও মাত্রার ওষুধ দেয় তেমন কোনো কার্যকর উপদেশ ও প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা ছাড়াই। দরিদ্র পিতা ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় সরকারি পঙ্গু হাসপাতালে যান। সেখানে দালাল ও বাটপাড়ের পাল্লায় পড়ে হাসপাতাল প্রশাসন পর্যন্ত পৌঁছানো তার ভাগ্যে জোটেনি। ফলে ‘সিট খালি নেই’ জাতীয় কথা শুনে বাড়িতে ফিরে আসেন।
একমাত্র সম্বল ১০ কাঠা জমি বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করে ছেলেকে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে পাঠানো হয় খুব কাছের মহানগর কলকাতায়। ছেলেটির পাসপোর্ট না থাকায় ভিন্ন এক নামে তাকে ভর্তি করা হয় সেখানকার ক্লিনিকে। ১০-১২ দিন চিকিৎসার পর ওই ক্লিনিকের অমনোযোগী ‘টেকনিশিয়ান’ ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন ‘মনে হয় ক্যান্সার হয়েছে’। তাকে সেখানকার এক ক্যান্সার হাসপাতালে পাঠানো হয়। তারা ইনডেপথ পরীক্ষা ও চিকিৎসার পথ না বাতলিয়ে অত্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ের একটা টেস্ট করে জানিয়ে দেয় ক্যান্সারের (সাইনোভিয়াল সারকোমা) সম্ভাবনা বিস্তারিত পরীক্ষা নিরীক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজন। টাকা পয়সা ফুরিয়ে আসায় ছেলেটি গ্রামে ফিরে আসে। সারা গ্রাম রটে যায় ছেলেটির ক্যান্সার হয়েছে। পা ফুলে একাকার এবং অসম্ভব বেদনার বিবরে সবাই হকচকিয়ে যায়। অবশেষে গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার ছুরি চালিয়ে ক্ষতস্থানে পুঞ্জীভূত পুঁজ অপসারণে ‘অপারেশন’ করে। এরপর রক্ত বন্ধ হয় না। এ পর্যায়ে গ্রামেরই একজন যিনি এই মুহূর্তে ঢাকায় একটি সমাজসেবাধর্মী বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত আছেন ঊর্ধ্বতন পদে চাকরি করেন তিনি ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে জানতে পারেন বিষয়টি। তিনি ছেলেটিকে অবিলম্বে ঢাকায় এনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসার পরামর্শ দেন। গোটা গ্রামের লোকেরা মুষ্টিভিক্ষার চাল তুলে কিছু অর্থ দিয়ে অবশেষে ছেলেটিকে পুনরায় ঢাকায় পাঠায় ওই সুহৃদ কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে। প্রথমে বারডেম হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের চিকিৎসকরা ছেলেটিকে দেখে শুধু বিস্মিত বিহ্বলই হন না, তারা প্রমাদ গোনেন। তারা অনতিবিলম্বে রোগীকে জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে রেফার করেন। বিশেষ অনুরোধে ও সুপারিশে জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকারা অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে ছেলেটির জরুরি চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গত সপ্তাহে ছেলেটার পা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে এবং নিবিড় পরীক্ষায় ধরা পড়েছে অবহেলায়, কুচিকিৎসায়, যথাসময়ে প্রযোজ্য শল্য চিকিৎসার ব্যবস্থা না হওয়ায় সত্যই তার ক্যান্সার হয়েছে! পা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে ক্যান্সারের অধিক বিস্তার থেকে আপাত নিষ্কৃতি পাওয়ার প্রয়াস হিসেবে। এরপর বেশ কিছু কাল চিকিৎসা (কেমো ও অন্যান্য) দেয়া হয় পায়ের ক্ষতে জন্মানো দুরারোগ্য ব্যাধির অন্যত্র সংক্রমণের সুনিয়ন্ত্রণের স্বার্থে। বেশ কিছু দিন পঙ্গুত্ব বরণ করে অবশেষে দরিদ্র পিতামাতার ভবিষ্যতের স্বপ্ন ছেলেটি শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সুদূর গ্রাম পর্যন্ত মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে যেতে গত পাঁচ দশকের কথাই যদি ধরি, গ্রামগঞ্জেও এখনো উপরে বর্ণিত অবস্থা দুঃখজনকভাবে বিরাজ করছে। এখনো দরিদ্র পিতা তার কলেজ পড়ুয়া ছেলের সাধারণ প্রকৃতির একটি দুর্ঘটনাপ্রসূত ক্ষতচিহ্নের চিকিৎসায় দিশাহীন হয়ে অবজ্ঞাত অবস্থায় ঘুরে ঘুরে প্রবঞ্চিত হচ্ছেন। এই সেদিন নোয়াখালীতে এক সম্পন্ন গ্রামে অশীতিপর ভদ্রমহিলা বয়োবৃদ্ধতায় হঠাৎ বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় আনতে হবে কিন্তু তার রক্তের ইলেকট্রোলাইটস ও লিপিড প্রোফাইলট টেস্ট করার তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও ধারে কাছে এমনকি জেলা সদরেও নির্ভরযোগ্যভাবে সে পরীক্ষা করানোর কোনো ব্যবস্থাদি খুঁজে পাওয়া গেল না। এই সে দিন শহর খুলনা থেকে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স খবর দিয়ে নিয়ে আসার আগে তিনি মারা যান। ঢাকার বাইরে হৃদরোগের চিকিৎসা তো দূরের কথা প্রাথমিক পরিচর্যার ব্যবস্থাটি পর্যন্ত এখনো গড়ে ওঠেনি। হাজার হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক, পাঁচ শ’য়ের মতো থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদরগুলোতে সরকারি হাসপাতাল, অলি-গলিতে গড়ে ওঠা প্রাইভেট ক্লিনিক ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সত্ত্বেও কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা সুদূরপরাহত থেকে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষা প্রদান ব্যবস্থাপনার পরিবীক্ষণ তথা দেখভাল করা শিক্ষার গুণগতমান বজায় রাখা বা প্রয়োগসংক্রান্ত অব্যবস্থার প্রেক্ষাপট করোনাকালে আরো প্রকট আকার ধারণ করে। শিক্ষায় সবসময় সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ মিলেছে ব্যয়ও চলছে; কিন্তু আমজনতার শিক্ষাব্যবস্থায় উপযুক্ত, প্রযোজ্য ও টেকসই শিক্ষা পরিবেশ গড়ে তোলাটা এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে যেমন রয়েছে তেমনি দেশের স্বাস্থ্য খাতেও অনুরূপ সীমাবদ্ধতার সঙ্গে সংগ্রামে রত সরকার, সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ এবং এর বিপরীতে স্বাস্থ্যসেবা প্রত্যাশীরা সুযোগ-সুবিধার নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে যেমনটি উপরের বাস্তব ঘটনায় ফুটে উঠেছে।
একজন শিক্ষকের পারিতোষিক ক্লাসে পড়ানোর পরিমাণ বা তার জ্ঞানচর্চার পারদর্শিতা অনুযায়ী না হয়ে কিংবা শিক্ষাদানের সফলতা ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব বিবেচনায় না এনে যদি দিতে হয় অর্থাৎ কাজ না করেও তিনি যদি বেতন পেতে পারেন, তাহলে দক্ষতা অর্জনের প্রত্যাশা আর দায়িত্ববোধের বিকাশভাবনা মাঠে মারা যাবে। কোনো পরিশ্রম কোনো বিনিয়োগ ছাড়া দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের পাহাড় জিডিপির হিসাবভুক্ত করলে পারক্যাপিটা আয় দেখানো হবে ঠিকই; লেখাপড়া না করে বা শিখে জিপিএ ফাইভ পেলে প্রকৃত অবস্থা তো তা বলবে না। এ ধরনের ব্যর্থতার বজরা ভারী হতে থাকলে যেকোনো উৎপাদনব্যবস্থা কিংবা উন্নয়ন প্রয়াস ভর্তুকির পরাশ্রয়ে যেতে বাধ্য।
দারিদ্র্যপীড়িত জনবহুল কোনো দেশে শিক্ষা বিভাগ যদি বেকার ও অকর্মণ্যদের জন্য যদি অভয়ারণ্য কিংবা কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করে তাহলে সেখানে শিক্ষা তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। যদি বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করা না যায় উপযুক্ত কর্মক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাহলে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বড় বড় বিনিয়োগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। শিক্ষক হিসেবে সরকারি চাকরিকে সোনার হরিণ বানানোর কারণে সে চাকরি পাওয়া এবং রাখার জন্য অস্বাভাবিক দেনদরবার চলাই স্বাভাবিক। দায়দায়িত্বহীন চাকরি পাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকার ফলে নিজ উদ্যোগে স্বনির্ভর হওয়ার আগ্রহতেও অনীহা চলে আসে। মানবসম্পদ অপচয়ের এর চেয়ে বড় নজির আর হতে পারে না।
দরিদ্রতম পরিবেশে যেখানে শ্রেণিনির্বিশেষে সবার কঠোর পরিশ্রম, কৃচ্ছ্রসাধন ও আত্মত্যাগ আবশ্যক সেখানে সহজে ও বিনা ক্লেশে কিভাবে অর্থ উপার্জন সম্ভব সে দিকে ঝোঁক বেশি হওয়াটা সুস্থতার লক্ষণ নয়। ক্লাসে না পড়িয়ে কোচিং যেন ট্রেড ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রার্থীর পরিচয়ে যে অঢেল অর্থব্যয় চলে তা যেন এমন এক বিনিয়োগ যা অবৈধভাবে অধিক উসুলের সুযোগ আছে বলে। ন্যায়নীতিহীন সমাজে শোষক আর পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থায় উপযুক্ত শিক্ষাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে নিবেদিতচিত্ত হওয়ার বদলে শিক্ষক নেতৃত্ব নিজেরা যখন উৎপাদনবিমুখ আর শ্রমিক স্বার্থ উদ্ধারের পরিবর্তে আত্মস্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শোষণের প্রতিভূ বনে যায় তখন দেখা যায় যাদের তারা প্রতিনিধিত্ব করছে তাদেরই তারা প্রথম ও প্রধান প্রতিপক্ষ। প্রচ- স্ববিরোধী এই পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে উৎপাদন, শিক্ষা উন্নয়ন সবই বালখিল্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাংলাদেশের সাফল্য অবশ্যই আছে অনেক ক্ষেত্রে যেমন- নবজাত শিশু ও প্রসূতি মায়েদের মৃত্যুর হার কমেছে : এ জন্য নামকরা পুরস্কারের শিকাও ছিঁড়েছে দেশের ভাগ্যে- সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার রোধ ও ক্ষেত্রবিশেষে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। দূষিত পানি বেশির ভাগ রোগের কারণ বিধায় সুপেয় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনায় সাফল্য অবশ্যই ঘটেছে। সরকারের বাইরে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মতৎপরতায় এসব ইন্টারভেনশনে মানুষের গড়া আয়ু বাড়ছে, স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে। তবে এটা এখনো বাস্তব ও বিব্রতকর যে স্বাস্থ্যসেবা খাতে সরকারের বাজেটে বিপুল বরাদ্দ এবং তা ব্যয় সত্ত্বেও মানুষের দোরগোড়ায় ন্যায় ও প্রযোজ্য চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছানো যায়নি, যাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের উপস্থিতি, উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার, চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ সরবরাহের অতি দারিদ্র্য ও অপারগ পরিস্থিতি স্বাস্থ্যসেবা প্রশাসন ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা, অপারগতা ও অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে।
সমস্যার গভীরে যাওয়া দরকার। ব্রিটিশ ভারতে এমনকি পাকিস্তান আমলেও গ্রামে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক এলএমএফ পর্যায়ে পেশাদারিত্বের ব্যবস্থা ছিল। মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসা তাদের কাছে পেত। স্বাধীন বাংলাদেশে সেই প্যারামেডিক্যাল ব্যবস্থা এলএমএফ চিকিৎসকরা আর নেই। এমবিবিএস পাস করা উচ্চ শিক্ষিতরা তাদের স্থলাভিষিক্ত হবেন এমন ধরনের ব্যবস্থাপনার বিবরে বর্তমানে পল্লী চিকিৎসা ব্যবস্থায় সমন্বয়হীনতা ও শূন্যতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কেননা এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসকেরা গ্রামে গড়ে ওঠা সরকারি চিকিৎসালয়ে তো দূরের কথা- গ্রামে পদায়িতই হতে চান না। এর কারণ অবশ্য আছে-গ্রামে নাগরিক সুযোগ সুবিধাসহ পেশাগত দায়িত্ব পালনের অনুকূল পরিবেশ পাওয়া দুষ্কর। ফলে অতিমাত্রায় সাংগঠনিক শক্তিতে বলবান ও একাট্টা হয়ে তারা পল্লীতে যাওয়ার যৌক্তিকতায় আর নিজেদের পান না। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গ্রামে অনেক চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান ও কাঠামো গড়ে তোলা হলেও সেখানে চিকিৎসক মিলছে না। অথচ একসময়কার ব্যক্তিপর্যায়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেই চিকিৎসাব্যবস্থার স্বীকৃতি তুলে দিয়ে উচ্চশিক্ষিত চিকিৎসককে সেখানে স্থলাভিষিক্তকরণ পর্বে এসে প্রচ- অপারগতার ভাইরাস পল্লীর পুরো চিকিৎসাকাঠামো সঙ্কটাপন্ন করে তুলেছে।
ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের সরকারি উদ্যোগটি নিয়োগবাণিজ্যে ও দলীয় রাজনীতিকীকরণের পাল্লায় পড়েছে। পরিবার পরিকল্পনা ও কল্যাণ কর্মসূচিটি আজ অতি অমনোযোগিতার শিকার অথচ এক বিশাল কর্মিবাহিনী ও পরিদফতর রয়েছে বহালতবিয়তে। এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই পল্লী স্বাস্থ্যসেবায় এখন দেশী-বিদেশী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো নানান বরণে ও ধরনে চিকিৎসাসেবা বাণিজ্য বজরা নিয়ে ফিরছে। অনস্বীকার্য যে, স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক উন্নয়ন একটি দীর্ঘমেয়াদি ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অথচ দুঃখজনক এ দীর্ঘ সময়ের প্রয়াস প্রচেষ্টায় অর্জিত সাফল্যকে অনেকে নিজেদের তাৎক্ষণিক সাফল্য বলে দাবি করেন। মহামারী আকারে ধেয়ে আসা করোনা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সারের মতো অসংক্রামক ব্যাধি বিস্তার রোধকল্পে সময় থাকতে উপযুক্ত প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং সে কাজে সরকারের তরফে নীতিমালা প্রণয়ন, কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দেখাশোনা আবশ্যক হবে, গণস্বাস্থ্য উন্নয়নে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সবার অংশগ্রহণের অনিবার্য আবশ্যকতা রয়েছে। নীতি কৌশল বাস্তবায়নে দলীয় বা সংগঠনগত দৃষ্টিভঙ্গির বিবরে সীমাবদ্ধ হয়ে গেলে সাফল্যকে বিলম্বিত করবে মাত্র। আর্থসামাজিক পরিবেশ উন্নয়নে জনস্বাস্থ্য একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। একে উপেক্ষা কিংবা এ খাতে অপারগতার অবকাশ খুব কম। লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com