ব্যতিক্রমী এক কারখানা দিয়ে বদলেছেন ভাগ্যের চাকা। শুধু নিজের ভাগ্য নয় সেখানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন ৪৫ জন নারী-পুরুষের। সেই উদ্যোক্তার নাম ওয়াহিদ হাসান। ঢাকা কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেন তিনি। এরপর অন্য সবার মতো চাকরির পেছনে না ছুটে গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রমী এক কুমড়া বড়ির কারখানা। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার গাড়াগঞ্জ এলাকার শিক্ষিত যুবক ওয়াহিদ হাসান গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে তুলেছেন বাণিজ্যিক এই কুমড়া বড়ির কারখানা। কালো মাষকালাই, ডাল ও চাল-কুমড়া দিয়ে উৎপাদিত সুস্বাদু এ কুমড়াবড়ি পৌঁছে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। লেখাপড়া শেষ করে চাকরির পেছনে না ছুটে ব্যবসার পাশাপাশি করেছেন কুমড়াবড়ি তৈরির কারখানা। মাষকলাই, ডাল ও চাল-কুমড়ার মিশ্রণে মেশিনে পেস্ট তৈরি করে প্রতিদিন সকালে নেটের উপর ছোট ছোট করে বড়ি তৈরি করেন নারীরা। তার কারখানায় ৪৫ জন নারী-পুরুষ কাজ করেন দীর্ঘ ৬ মাস ধরে। বাড়ির কাজের পাশাপাশি ২ থেকে ৩ ঘণ্টা বড়ি তৈরির কাজ করেন নারীরা। এতে যে পারিশ্রমিক পান তা দিয়ে ভালোভাবেই চলে যায় সংসার। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খোলা আকাশের নিচে সারি সারি কুমড়া বড়িগুলো রোদে শুকানো হচ্ছে। অন্যদিকে পর্দার আড়ালে মহিলারা মেশিনে কুমড়া ও ডালগুলো দিয়ে পেস্ট তৈরি করছে। অন্য মহিলারা সেগুলোকে নেটের উপর ছোট ছোট করে বড়ি বানাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পুরুষেরা সেগুলোকে নিয়ে সকালের রোদে শুকাচ্ছেন। আবার শুকানো বড়িগুলো নেট থেকে ছাড়িয়ে মাটিতে শুকাতে দেওয়া হচ্ছে। এই কর্মযোগ্য চলে দুই থেকে তিন ঘন্টাব্যাপী। তাদের মাঝেই দেখা মেলে ওয়াহিদের। দেখে বোঝার উপয় নেই তিনিই এই কারখানার মালিক। নারী পুরুষের সাথে এক নাগাড়ে তিনিও কাজ করে যাচ্ছে। প্রায় ৬ বছর ধরে শীত মৌসুমে ৫-৬ মাস চলে বড়ি তৈরির কাজ। প্রতিদিন ১০ মন বড়ি তৈরিতে খরচ হয় ৫০ থেকে ৫৬ হাজার টাকা। যা থেকে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা লাভ হয় বলে জানান তিনি। উদ্যোক্তা ওয়াহিদ হাসান বলেন, ২০১৫-১৬ শিক্ষা বর্ষে ঢাকা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করি। পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরি না করে এই ব্যবসায় নিজেকে সম্পৃক্ত করি। ছোট থেকেই ভাবনা ছিল নিজে ব্যবসা করব। বেকারত্ব দূর করার লক্ষ রেখেই এই যাত্রা। প্রথমে ১৫-২০ কেজি ডালের বড়ি বানানো হতো। বর্তমানে ৪শ কেজি ডালের বড়ি তৈরি করা হয়। এই কারখানায় যেসব পরিবারের মহিলাদের বাড়িতে কোনো কাজ নেই, এমন ৪০ জন মহিলা এখানে নিয়মিত কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এছাড়াও ৪ জন পুরুষ ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকা মাসিক বেতনে নিয়মিত কাজ করেন। এই কারখানায় ৪০-৪৫ জন পুরুষ-মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। এছাড়াও এই বড়িগুলো বিক্রির কাজে ১০ থেকে ১৫ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। এই বড়ি তৈরি করে রোদে শুকিয়ে প্যাকেট করে ঢাকা, খুলনা, চিটাগং,রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। তিনি আরো বলেন, কারখানায় প্রতিদিন ৪শ কেজি বড়ি উৎপাদনে উপকরণ বাদে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়। সব খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজি বড়ি তৈরি করতে খরচ হয় ১৪০ টাকা। পাইকারি বিক্রি করা হয় ১৫০ টাকা দরে। মাত্র ১০ টাকা লাভে বিক্রি করা হয়, যার ফলে মার্কেটে বিক্রিও হয় বেশি। মেশিন ও হাতের সাহায্যে বড়ি তৈরি করা হয়। যার ফলে উৎপাদন খরচও কম। চালকুমড়া, মাষকালাই ও সামান্য পরিমাণ অ্যাংকর ডাল ব্যবহার করার কারণে বড়ির তৈরির খরচও কম হয়। আবার বড়িটা দ্রুত সেদ্ধও হয়ে যায়। একারণে সব শ্রেণির ক্রেতারা কুমড়া বড়ির স্বাদ নিতে পারেন। ওয়াহিদ আরও বলেন, আগে ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলেই এই ব্যবসা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু বর্তমানে সকল পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই ব্যবসা পরিচালনা করতে গেলে ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা প্রয়োজন হয়। যদি সরকারিভাবে অল্প সুদে ঋণ পান তাহলে কারখানা বৃদ্ধি করবেন। যাতে করে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। তবে যদি কেউ এই ব্যবসা করতে চায়, তার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করতে পারবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি। শ্রমিক আতিয়ার রহমান জানান, এই কারখানায় মাসিক বেতনে চারজন কাজ করেন। আগে মাঠে শ্রমিকের কাজ করতেন। মাঠে প্রতিদিন কাজ হতো না। কিন্তু এই কারখানায় একটানা ৬ মাস কাজ করেন। নিয়মিত বেতন পেয়ে সংসার ভালোভাবে চলছে তাদের। শ্রমিক মজনু হোসেন ও জসিম জানান, ৫-৬ বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করেন। এখানে মহিলারা যে বড়িগুলো তৈরি করে সেগুলোকে রোদে শুকাতে হয়। বড়িগুলো রোদে শুকানেরার পর সেগুলোকে নেট থেকে উঠায়ে প্যকেটিং শেষ করে কার্টুনে ভরা হয়। এভাবে একটানা ৪-৫ মাস ধরে কাজ চলে। শীত মৌসুম চলে গেলে আবার মাঠের কাজ করেন তারা। কারখানায় কাজ করা মহিলারা জানান, সকালে নিজেদের বাড়ির কাজ শেষ করে কারখানায় আসেন। প্রথমে মেশিনে ডালগুলো ফেনানোর (পেস্ট) কাজ করেন। এরপর সেগুলোকে জালের (নেট) উপর বড়ি বসানো হয়। এভাবে শীত মৌসুম ধরেই একটানা দুই থেকে তিন ঘন্টা কাজ হয়। এই কাজ করে প্রতিদিন দেড় থেকে দুইশ টাকা পান। ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আজগর আলী বলেন, কৃষি পণ্য উৎপাদন করে চাষী ভাইয়েরা সঠিক দাম পান না বলে সবসময় অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু এই কৃষি পণ্য যদি ড্রাইভ্যাট করে এগ্রোবেজ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে সেই পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। তখন আবার কৃষরাও তাদের উৎপাদিত ফসলের সঠিক দাম পান। এই রকমই প্রকল্প নিয়ে বিগত ৬ বছর কাজ করছেন ওয়াহিদ হাসান। প্রথমে তার বাবা বড়ি তৈরি করে বাজারে বিক্রয় করত। আস্তে আস্তে বেশি পরিমাণ তৈরি করে ঢাকাতে বিক্রয় শুরু করে। ব্যবসায় লাভ ভালো হওয়ায় সেখান থেকেই দেখে তিনিও এই কাজে মনোনিবেশ করেন। ওয়াহিদ ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ার বাজার থেকে মাষকলাই কিনেন। এছাড়া বিভিন্ন বাজার থেকে চালকুমড়া সংগ্রহ করে এই বড়ি তৈরির কাঁচা মাল হিসেবে ব্যবহার করেন। এক কেজি ডাল বা একটি চালকুমড়া কিনতে ৫০ টাকা খরচ হলে এগুলো দিয়ে বড়ি তৈরি করে বিক্রি করলে আয় হয় ৩০০ টাকা। এভাবে শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, শিক্ষিত এই যুবক নিজে স্বাবল¤॥^ী হওয়ার পাশাপাশি অনেকেরই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। ওয়াহিদের এমন কাজে আরো অনেকেই উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। বানিজ্যিকভাবে কুমড়াবড়ি তৈরিতে সকল প্রকার সহযোগীতার আশ্বাসও দেন।