ঈমানদার আল্লাহ নির্ভরশীল। সুখে থাকুন বা দুঃখে উভয় অবস্থায় সে মনে করে, আল্লাহর ইচ্ছায়ই পূর্ণ হচ্ছে। পক্ষান্তরে যারা দুনিয়াপূজারী তারা তাগুতের অনুসারী। তাগুতকে নিজেদের সহায়তাকারী মনে করে। ঈমানদার যা কিছু উপার্জন করবে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করার পর আল্লাহর পথে ব্যয় করে। পক্ষান্তরে দুনিয়াপূজারী নিজের উপার্জিত সম্পদে অন্যের হক বা অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় না। ঈমানদার দুনিয়ার ক্ষণিকের জীবন দ্বারা সীমাহীন অন্তহীন জীবনের ঘর নির্মাণ করে নেয়। আর দুনিয়াপূজারী ধন-সম্পদ আঁকড়ে ধরে রাখে এবং সবসময় সম্পদ আহরণের নতুন নতুন ফন্দি-ফিকিরে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। তার কাছে আখিরাত বলতে কিছু নেই। ঈমানদার বৈধ ও হালাল পথে যতটুকু উপার্জন করে তাতেই সন্তুষ্ট। পক্ষান্তরে দুনিয়াপূজারী হালাল-হারাম যা-ই সামনে আসে দু’হাতে লুটে নেয়। তার লোভের জিহ্বা ও পেট কখনো তৃপ্তি লাভ করে না।
আল্লাহ বিশ্বাসী ও দুনিয়াপূজারীর মানসিকতার দিন ও রাতের মতো পার্থক্য বিদ্যমান। দুনিয়াপূজারী নিজের প্রবৃত্তির আকাক্সক্ষা পূর্ণ করার জন্য সব কিছু করে। কোনো বৈষয়িক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার ওপরই তার প্রবৃত্তির সুখ ও আনন্দ নির্ভর করে। এ উদ্দেশ্য লাভে সক্ষম হলেই সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। আর উদ্দেশ্য লাভে ব্যর্থ হলে সে ম্্িরয়মান হয়ে পড়ে। তারপর বস্তুগত কার্যকারণই প্রায় তার সব সহায় অবলম্বনের কাজ করে। সেগুলো অনুকূল হলে তার মনোবল বেড়ে যেতে থাকে। আর প্রতিকূল হলে সে হিম্মত হারাতে থাকে।
অন্য দিকে যারা আল্লাহ বিশ্বাসী মানুষ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই সব কিছু করে। এ কাজে সে নিজের শক্তি ও বস্তুগত উপায়-উপকরণের ওপর ভরসা করে না; বরং সে পুরোপুরি নির্ভর করে আল্লাহর সত্তার ওপর। সত্যের পথে কাজ করতে গিয়ে সে বিপদ-আপদের সম্মুখীন হলে অথবা সাফল্যের বিভিন্ন পর্যায়ে অতিক্রম করলে, উভয় অবস্থায় সে মনে করে আল্লাহর ইচ্ছায়ই পূর্ণ হচ্ছে। বিপদ-আপদ তার মনোবল ভাঙতে পারে না। আবার সাফল্যও তাকে অহঙ্কারে লিপ্ত করতে পারে না। কারণ, প্রথমত সে উভয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত বলে মনে করে। সব অবস্থায় সে আল্লাহর সৃষ্ট এ পরীক্ষায় নিরাপদে উত্তীর্ণ হতে চায়। দ্বিতীয়ত, তার সামনে কোনো বৈষয়িক উদ্দেশ্য থাকে না এবং তার মাধ্যমে সে নিজের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিচার করে না। তার সামনে থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি মাত্র উদ্দেশ্য। বৈষয়িক সাফল্য লাভ করা বা না করার মাধ্যমে তার এ উদ্দেশ্যের নিকটবর্তী হওয়া বা দূরে অবস্থান করার ব্যাপারটি পরিমাপ করা যায় না। বৈষয়িক কার্যকারণ ও উপায়-উপকরণের আশায় সে বসে থাকে না। সেগুলোর অনুকূল ও প্রতিকূল হওয়া তাকে আনন্দিত ও নিরানন্দ করে না। সে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখে। তিনিই কার্যকারণ ও উপায়-উপকরণ রাজ্যের একচ্ছত্র মালিক। কাজেই তার ওপর ভরসা করে সে প্রতিকূল অবস্থায়ও এমন হিম্মত ও দৃঢ় সঙ্কল্পসহকারে কাজ করে যায়, দুনিয়ায়পূজারীরা একমাত্র অনুকূল অবস্থায়ই সেভাবে কাজ করতে পারে। এ জন্য আল্লাহ বলে দিয়েছেন- ‘(হে মুহাম্মদ) তাদের বলে দাও আল্লাহ আমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা ছাড়া আর কোনো (ভালো বা মন্দ) কিছুই আমাদের হয় না। আল্লাহই আমাদের অভিভাবক ও কার্যনির্বাহক এবং ঈমানদারদের তাঁর ওপরই ভরসা করা করা উচিত।’ (সূরা তাওবা-৫১) তাই দুনিয়াপূজারী ও ঈমানদারদের ব্যাপার মূলগতভাবে ভিন্ন। তাদের আনন্দ ও নিরানন্দের রীতি-পদ্ধতি ঈমানদারদের থেকে আলাদা। তাদের নিশ্চিন্ততা ও অস্থিরতার উৎস এক, আর ঈমানদারদের অন্য।
‘যারা ঈমান আনে আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর মধ্যে নিয়ে আসেন। আর যারা কুফরির পথ অবলম্বন করে তাদের সাহায্যকারী সহায় হচ্ছে তাগুত। সে তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়। এরা আগুনের অধিকারী। সেখানে থাকবে এরা চিরকালের জন্য।’ (সূরা বাকারা-২৫৭)
যারা সত্যিকার অর্থে ঈমানদার তাদেরকে মহান আল্লাহ অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসেন। আর দুনিয়াপূজারীর অভিভাবক হলো তাগুত। কুরআনের পরিভাষায় তাগুত এমন এক বান্দাকে বলা হয়, যে বন্দেগি ও দাসত্বের সীমা অতিক্রম করে নিজেই প্রভু হওয়ার দাবিদার সাজে এবং আল্লাহর বান্দাদের নিজের বন্দেগি ও দাসত্বে নিযুক্ত করে। আল্লাহর মোকাবেলায় বান্দার প্রভুত্বের দাবিদার সাজার এবং বিদ্রোহ করার তিনটি পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায় বান্দা নীতিগতভাবে তাঁর শাসন কর্তৃত্বকে সত্য বলে মেনে নেয় কিন্তু কার্যত তার বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করে। একে বলা হয় ফাসেকি। দ্বিতীয় পর্যায়ে সে আল্লাহর শান কর্তৃত্বকে নীতিগতভাবে মেনে না নিয়ে নিজের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় অথবা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো বন্দেগি ও দাসত্ব করতে থাকে। একে বলা হয় কুফরি। তৃতীয় পর্যায়ে সে মালিক ও প্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার রাজ্যে এবং তার প্রজাদের মধ্যে নিজের হুকুম চালাতে থাকে। এই শেষ পর্যায়ে যে বান্দা পৌঁছে যায় তাকেই বলা হয় তাগুত। কোনো ব্যক্তি এই তাগুতকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত কোনো দিন সঠিক অর্থে আল্লাহর মুমিন বান্দা হতে পারে না।
যারা আল্লাহর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একটি তাগুতের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয় না; বরং বহু তাগুত তার ওপর চেপে বসে। শয়তান এক তাগুত। শয়তান তার সামনে প্রতিদিন নতুন নতুন আকাশকুসুম রচনা করে তাকে মিথ্যা প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে রাখে। দ্বিতীয় তাগুত হচ্ছে নিজের নফস। এই নফস তাকে আবেগ ও লালসার দাস বানিয়ে জীবনের আঁকাবাঁকা পথে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। এ ছাড়া বাইরের জগতে অসংখ্য তাগুত ছড়িয়ে রয়েছে। মানুষ তার এই অসংখ্য প্রভুর দাসত্ব করতে করতে এবং এদের মধ্যে থেকে কাকে সন্তুষ্ট করবে আর কার অসন্তুষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করবে এই ফিকিরের চক্করে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়।
যারা দুনিয়াপূজারী তাদের জন্য দুনিয়াকে মনোহর করে দেয়া হয় যাতে তারা আরো বেশি করে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যেতে পারে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা কুফরির পথ অবলম্বন করেছে তাদের জন্য দুনিয়ার জীবন বড়ই প্রিয় ও মনোমুগ্ধকর করে সাজিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের লোকেরা ঈমানের পথ অবলম্বনকারীদের বিদ্রƒপ করে। কিন্তু কিয়ামতের দিন তাকওয়া অবলম্বনকারীরাই তাদের মোকাবেলায় উন্নত মর্যাদায় আসীন হবে। আর দুনিয়ার জীবিকার ক্ষেত্রে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত দান করে থাকেন।’ (সূরা বাকারা-২১২)
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদের যা কিছু ধন-সম্পদ দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করো। সেই দিনটি আসার আগে, যেদিন কেনাবেচা চলবে না, বন্ধুত্ব কাজে লাগবে না এবং কারো কোনো সুপারিশও কাজে আসবে না। আর জালেম আসলে সেই ব্যক্তি যে কুফরি নীতি অবলম্বন করে।’ (সূরা বাকারা-২৫৪) যারা ঈমানদার তারা ধন-সম্পদের অধিকারী হলে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারা আল্লাহরই নির্ধারিত পথে ধন-সম্পদ ব্যয় করে। অর্থাৎ ধন-সম্পদের তুলনায় তারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই বেশি অগ্রাধিকার দেয়। তারা কৃপণ হয় না অপচয়ও করে না। কিন্তু যারা দুনিয়াপূজারী তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির তুলনায় নিজের ধন-সম্পদকে অধিক প্রিয় মনে করে অথবা যারা সেই দিনটির ওপর আস্থা রাখে না যে দিনটির আগমনের ভয় দেখানো হয়েছে। যারা এই ভিত্তিহীন ধারণা পোষণ করে যে, আখিরাতে তারা কোনো না কোনোভাবে নাজাত ও সাফল্য কিনে নিতে সক্ষম হবে এবং বন্ধুত্ব ও সুপারিশের সাহায্যে নিজেদের কার্যোদ্ধার করতে সক্ষম হবে।
শয়তানের সঙ্কীর্ণমনা অনুসারীদের দৃষ্টিতে নিজের ধন-সম্পদ আঁকড়ে ধরে রাখা এবং সবসময় সম্পদ আহরণের নতুন নতুন ফন্দি-ফিকির করাই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। কিন্তু যারা আল্লাহর কাছ থেকে অন্তরদৃষ্টি লাভ করেছে, তাদের মতে এটি নেহাত নিবুর্দ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের মতে, মানুষ যা কিছু উপার্জন করবে, নিজের মাঝারি পর্যায়ের প্রয়োজন পূর্ণ করার পর সেগুলো প্রাণ খুলে সৎকাজে ব্যয় করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। দুনিয়ায় হাতেগোনা কয়েক দিনের জীবনে প্রথম ব্যক্তি দ্বিতীয়জনের তুলনায় হয়তো অনেক বেশি প্রাচুর্যের অধিকারী হতে পারে। কিন্তু মানুষের জন্য এই দুনিয়ার জীবনটিই সম্পূর্ণ জীবন নয়; বরং এটি আসল জীবনের একটি সামান্যতম অংশ মাত্র। এই সামান্য ও ক্ষুদ্রতম অংশের সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতার বিনিময়ে যে ব্যক্তি বৃহত্তম ও সীমাহীন জীবনের অসচ্ছলতা, দারিদ্র্য ও দৈন্যদশা কিনে নেয় সে আসলে নিরেট বোকা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে ব্যক্তি সংক্ষিপ্ত জীবনকালের সুযোগ গ্রহণ করে মাত্র সামান্য পুঁজির সহায়তায় নিজের ওই চিরন্তন জীবনের সমৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে সে-ই আসল বুদ্ধিমান। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং লজ্জাকর কর্মনীতি অবলম্বন করতে প্রলুব্ধ করে কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের আশ্বাস দেন। আল্লাহ বড়ই উদারহস্ত ও মহাজ্ঞানী।’ (সূরা বাকারা-২৬৮) লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট