জাহিলিয়াতের ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত গোটা আরব দুনিয়া। মানুষ এক আল্লাহকে ভুলে গেল। তারা নানা রকম পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়লো। মারামারি ও হানাহানি আরব সমাজে লেগেই থাকতো। মারামারি একবার শুরু হলে তো তা বছরের পর বছর ধরে চলতো। ফলে সমাজে শান্তি বলতে কিছুই ছিল না। মানুষ যেন বন্য হায়েনার মতো পাষাণ হয়ে পড়েছিল। সত্য ও ন্যায়নীতি বলতে কিছুই আর বাকি ছিল না আরব সমাজে। এমন এক দুঃসময়ে আঁধারের চাদর ছিঁড়ে দুনিয়ায় এলেন আল্লাহর নবী। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা)। তাঁর আগমনে আরব মরুতে ফুটলো সত্যের স্বপ্নিল গোলাপ। এই গোলাপের সৌরভ ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। মক্কার আনাচে-কানাচে শোনা গেল মুক্তির অমোঘ বাণী। নবীজি এলেন ইসলামের আলো নিয়ে। এই আলোয় উদ্ভাসিত হলো আরব সমাজ। সত্য-সন্ধানী মানুষের বুকে নাড়া দিলো নবীজির কথা। তিনি বললেন,
‘বন্ধুরা, তোমরা যা করছো তা ঠিক নয়। তোমরা মূর্তিপূজা ছাড়ো। এসব মিথ্যা ও অলীক। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তাই এক আল্লাহকে মানো।’
আরবের লোকেরা ছিল অহঙ্কারী। তাদের মন ছিল কলুষিত। অধিকাংশ আরব নবীজির কথা শুনলো না। বরং তারা নবীজির কথায় ক্ষিপ্ত হলো। আরবের হিংস্্র লোকেরা নবীজিকে কটাক্ষ করলো। তারা নবীজিকে নানাভাবে কষ্ট দিলো। মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর নবী। কাফেরদের কোনো বাধাই তাঁকে দাবিয়ে রাখতে পারলো না। তিনি ইসলামের কথা বলতে লাগলেন। এ সময় অনেকে নবীজির কথায় আস্থা রাখলো। তাঁরা নবীজির কথা মেনে নিলো। ফলে এসব নও-মুসলিম কাফের-মুশরিকদের কোপানলে পড়লেন। তাঁরা চরম নিপীড়ন ও অত্যাচারের শিকার হলেন। এদের মধ্যে অন্যতম হজরত ইয়াসির (রা)-এর গর্বিত পরিবার। ইয়াসির (রা) নবীজির আহ্বানে সাড়া দিলেন। সাড়া দিলেন তাঁর স্ত্রী হজরত সুমাইয়া (রা)। দুই পুত্র আবদুল্লাহ ও আম্মার (রা)। তাঁরাও ইসলাম গ্রহণ করলেন। ফলে তাঁরা সবাই কাফেরদের সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হলেন। চরম ইসলামবিরোধী ও পাপিষ্ঠ আবু জেহেলের বর্শার আঘাতে ঝাঁঝরা হলো হজরত সুমাইয়ার পবিত্র দেহ। তিনি শহীদ হলেন। ইসলামের প্রথম মহিলা শহীদ তিনি। তাঁর স্বামী হজরত ইয়াসির (রা)। কাফেররা তাঁকেও শহীদ করলো। শহীদ হলেন তাঁদের আদরের সন্তান আবদুল্লাহও।
এই শহীদ পরিবারের আরেক সন্তান হজরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা)। তিনিও ইসলামের অমিয় বাণী গ্রহণ করে ধন্য হলেন। বড় বিচিত্র ছিল তাঁর জীবন। অনেক অনাচার ও অত্যাচারে তিনিও জর্জরিত হয়েছেন। ইসলামের দুশমনরা হজরত আম্মার (রা)-কে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তবে হজরত আম্মার সাহসী পিতা ইয়াসিরের মতোই ছিলেন অটল অবিচল। অত্যাচারের স্টিম রোলার হজরত আম্মার (রা) সহ্য করলেন। কিন্তু তিনি ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত হলেন না।
একবার কাফেররা আগুন জ্বেলে হজরত আম্মার (রা)-কে আগুনের মধ্যে শুইয়ে দিলো। এ সময় কাফেররা আম্মার (রা)-এর কষ্ট দেখে হাসাহাসি ও লাফালাফি করলো। তবে আল্লাহর অসীম রহমতে হজরত আম্মার (রা) বেঁচে গেলেন। আরেকবার পাপিষ্ঠ কাফেররা হজরত আম্মার (রা)-কে পানিতে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করলো। এ সময় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তবে এবারও তিনি আল্লাহর সীমাহীন কুদরতে বেঁচে গেলেন।
হজরত আম্মার (রা) ইসলামের কাজে ছিলেন অগ্রগামী। যেখানেই দীনের ডাক এসেছে তিনি উৎসাহে আনন্দে সেখানে ছুটে গেছেন। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে বাজি রেখেছেন নিজের জীবন। কাফেরদের সাথে লড়াইয়ে প্রতিটি রণাঙ্গনে হজরত আম্মার (রা) সাহসের সাথে লড়াই করেছেন। দায়িত্ব নিয়ে অগ্রসর হয়ে ইসলামকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন।
ইয়ামামার যুদ্ধের কথা। সেই এক ভয়ানক যুদ্ধ। প্রাণপণে লড়ছেন হজরত আম্মার (রা)। এক সময় তলোয়ারের তীব্র আঘাতে তাঁর একটি কান কেটে মাটিতে পড়ে গেল। তাতে কী! কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই আম্মারের। খাপ খোলা তলোয়ার নিয়ে ছুটছেন হজরত আম্মার (রা)। কাফেরদের ব্যূহ তছনছ করে তিনি এগিয়ে গেলেন। তবে কাফেরদের আক্রমণে মুসলিম বাহিনী পড়ল মহাসঙ্কটে। তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো। কিন্তু হজরত আম্মার (রা) সাহসের সাথে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি সাথীদেরকে উদাত্ত আহ্বান জানালেন। হজরত আম্মার (রা)-এর ডাক জাদুর মতো কাজ করলো। আল্লাহর দীনের সৈনিকরা সম্বিত ফিরে পেল। মুসলিম সেনারা এবার প্রাণপণে লড়াই করলেন। অবশেষে তাঁরা বিজয়ীও হলেন। এই যুদ্ধে আম্মার (রা)-এর সাহসী ভূমিকায় সবাই খুশি হলেন।
হজরত আম্মারকে নবীজি খুব ভালোবাসতেন। কারণ, তিনি ছিলেন এক গর্বিত শহীদ পরিবারের সাহসী সন্তান। হিজরতের পর মদিনা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হচ্ছে। নবীজি নিজেও এর জন্য কাজ করছেন। এ সময় হজরত আম্মার (রা) মাথায় ইট বহন করে আনলেন। একবার তিনি রাসূল (সা)-এর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় মহানবী (সা) অত্যন্ত আদরের সাথে আম্মার (রা)-এর মাথার ধুলোবালি ঝেড়ে দিলেন। এরপর নবীজি অত্যন্ত কষ্টের সাথে হজরত আম্মারকে বললেন, ‘আফসোস আম্মার! একটি বিদ্রোহী দল তোমাকে হত্যা করবে। তুমি তাদেরকে আল্লাহর আদর্শের দিকে ডাকবে। আর তারা তোমাকে ডাকবে জাহান্নামের দিকে।’ ৬৫৬ সাল। হজরত আলী (রা) ও হজরত মুয়াবিয়ার মধ্যে সংঘটিত হলো দুঃখজনক লড়াই। সিফফিনের যুদ্ধ। হজরত আম্মার (রা) তখন বেশ বৃদ্ধ। তাঁর বয়স একানব্বই বছর। এই দুঃসময়ে হজরত আম্মার (রা) স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি হজরত আলী (রা)-এর পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য রওয়ানা হলেন। অবশেষে তিনি যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে পৌঁছলেন। তুমুল লড়াই চলছে। মুসলমানরা নিজেদের মধ্যেই লড়াই করলেন। ফলে উভয়পক্ষের চার হাজার মুসলমান শাহাদতবরণ করলেন। হজরত আম্মার (রা)। তিনিও সিফফিনের যুদ্ধে শহীদ হলেন। ইসলামের সাহসী সৈনিক হজরত আম্মার (রা) ছিলেন অত্যন্ত সহজ ও সরল। তিনি অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। খোদাভীরু আম্মার (রা) ছিলেন সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও অসীম সাহসী এক মুজাহিদ। আল্লাহকে ভালোবেসে তিনি জীবনকে ধন্য করেছিলেন। আর হাসতে হাসতে মহান আল্লাহর রাস্তায় তিনি জীবনকে উৎসর্গ করেন। তাঁর মহৎ জীবন মুসলমানদের উজ্জীবিত করে। আজও অগণিত ইসলামী সৈনিক হজরত আম্মার (রা)-এর সাহসের শিহরণ বুকে ধারণ করে। আর এই আবেগ নিয়ে আল্লাহর পথে জীবন বিলিয়ে দিতে তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করেন না।