জাকির হোসেন, বাড়ি মানিকগঞ্জ। ৩৫ বছর বয়সী এ যুবক সুঠাম দেহের অধিকারী। তবে তিনি কানে শোনেন না, কথাও বলতে পারেন না। পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতে চাননি। কাজের সন্ধানে দুই বছর আগে চলে আসেন ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায়। বাকপ্রতিবন্ধী হওয়ায় কাজ পাচ্ছিলেন না জাকির।
অবশেষে নিজ এলাকার পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে টিম গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠান ফোর-এ ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেডে চাকরি পান তিনি। বাকপ্রতিবন্ধী জাকির ঠিকমতো কাজ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে শুরুতে ওই পোশাক কারখানার সহকর্মীদের মনে সংশয় ছিল। যদিও সবসময় তার পাশে ছিলেন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহিল রাকিব। তার প্রচেষ্টায় জাকিরের সব প্রতিবন্ধকতা কেটে যায়। তিনি এখন প্রতিষ্ঠানটিতে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। প্রতিবন্ধী হওয়ায় এলাকার মানুষ নানান কথা বলতো। শুনতে হয়েছে অনেক কটু কথা। পরিবারের লোকেরাও কথা শোনাতে ছাড়েনি। পরে ঢাকায় চলে আসি। অবশেষে ফোর-এ ইয়ার্ন ডায়িংয়ে কাজও পাই। এখন আমি আর পরিবারের বোঝা নই। বরং পরিবারকে আমিই টাকা পাঠাচ্ছি। নিজে ভালো আছি, ভালোভাবে চলতে পারছি, পরিবারেও সচ্ছলতা ফিরেছে। শুধু জাকির হোসেন নন, ফোর-এ ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেডে বর্তমানে কাজ করছেন এমন আরও ৫২ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী। এর মধ্যে রয়েছেন অপারেটর শান্তনা, জুনিয়র অপারেটর লিপি খাতুন, আল-আমিন ও শহিদুল ইসলাম। তাদের কারও হাত নেই, কারও পা নেই। অনেকে আবার চোখে দেখেন না। শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও তারা দমে যাননি। নিজের খরচ মিটিয়ে বেতনের টাকা থেকে বাড়িতেও পাঠাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উৎসাহে প্রত্যেকে হয়ে উঠেছেন অদম্য কর্মী। কাজ করে যাচ্ছেন সুনামের সঙ্গে। দক্ষতার সঙ্গে কাজ করায় অনেকে পদোন্নতিও পেয়েছেন।
জাকির হোসেনের সহকর্মীরা জানান, তিনি কানে শোনেন না। কথাও বলতে পারেন না। মাসের ১ তারিখ ব্যাংকের মাধ্যমে বেতন পান। এটিএম বুথ থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী টাকাও তোলেন। এতে কারও সাহায্যের প্রয়োজন হয় না তার। ব্যবহার করেন স্মার্টফোন। অদম্য এ যুবক সম্প্রতি বিশ্ব ইজতেমা মাঠেও তিনদিন সময় দিয়েছিলেন।
জাকিরের কাছে জানতে চাওয়া হয় কাজ করতে কোনো সমস্যা হয় কি না? ইশারার মাধ্যমে তার সহকর্মীরা তাকে প্রশ্ন বুঝিয়ে দেন। প্রশ্ন বুঝতে পেরে মুচকি হাসেন জাকির। হাতের ইশারায় ডেকে নিয়ে যান নিজের কাজ দেখাতে। কাজ করে দেখান জাকির, সঙ্গে ইশারায় বোঝান প্রতিষ্ঠানের সবাই খুব আন্তরিক। তাকে সবসময় উৎসাহ দেন, সহায়তা করেন কাজে। একজনের প্রয়োজনে অন্যজন এগিয়ে আসেন। কাজ চলে, ঠিকঠাক মতো বেতনও পাচ্ছেন। হাতের ইশারায় জাকির কথা বলতে থাকেন। তা সাংবাদিকদের বুঝিয়ে দেন তার সহকর্মীরা। জাকির জানান, একাই চলাফেরা করেন তিনি। ছুটি পেলে বেড়াতে যান গ্রামের বাড়িতে। কারখানা খুলেছে কি না, তা জানতে মেসেঞ্জারে ভিডিও কল দেন সহকর্মীদের। ইশারায় জেনে নেন তথ্য।
একই কারখানায় কাজ করছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কর্মী সুবেদা খাতুন। তিনি জুনিয়র অপারেটর হিসেবে কর্মরত। গ্রামের বাড়ি রংপুরে। সুবেদা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিবন্ধী হওয়ায় এলাকার মানুষ নানান কথা বলতো। শুনতে হয়েছে অনেক কটু কথা। পরিবারের লোকেরাও কথা শোনাতে ছাড়েনি। পরে ঢাকায় চলে আসি। অবশেষে ফোর-এ ইয়ার্ন ডায়িংয়ে কাজও পাই। এখন আমি আর পরিবারের বোঝা নই। বরং পরিবারকে আমিই টাকা পাঠাচ্ছি। নিজে ভালো আছি, ভালোভাবে চলতে পারছি, পরিবারেও সচ্ছলতা ফিরেছে।
এ কারখানায় কাজ করা প্রতিবন্ধী কর্মীদের মধ্যে লিপির উচ্চতা কম। এজন্য তাকে কোনো প্রতিষ্ঠান চাকরিতে নিতো না। ফোর-এ ইয়ার্ন ডায়িংয়ে বর্তমানে তিনি জুনিয়র অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন। তার সহকর্মী শান্তনা খাতুন। তিনিও অপারেটর। শান্তনার এক পা অচল। হাঁটাচলায় সমস্যা হয়। তবে কাজে মনোযোগের কোনো কমতি নেই তার। সবাইকে আমরা মানুষ হিসেবে দেখি। কাজের মূল্যায়ন করি। কেউ কথা বলতে পারেন কি না, হাঁটতে পারেন কি না, এটাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। এখানে আমরা যারা কাজ করছি তারা সবাই মিলে একটি পরিবার। পরিবার নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠান। মালিকপক্ষও সেভাবে সবাইকে মূল্যায়ন করে। প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বেতন, পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট (বেতন বৃদ্ধি) হচ্ছে। প্রতিবন্ধী যারা আছেন তারাও এটা পাচ্ছেন। লাভের একটা অংশও শ্রমিকদের দিয়ে থাকি আমরা। সব শ্রমিকের জন্য বিমা সুবিধাও রয়েছে।
ফোর-এ ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেডের জিএম (এইচআর অ্যাডমিন অ্যান্ড কমপ্ল্যায়েন্স) কাউসার উদ্দিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘টিম গ্রুপের প্রতিষ্ঠানে মোট ৫৩ জন শারীরিক প্রতিবন্ধীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে সবাই সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। একে অন্যকে সহযোগিতা করছেন। অনেকে কাজের মূল্যায়ন হিসেবে পদোন্নতিও পেয়েছেন।’
টিম গ্রুপের জিএম (এইচআর) খন্দকার মমতাজুল ইমাম বলেন, ‘সবাইকে আমরা মানুষ হিসেবে দেখি। কাজের মূল্যায়ন করি। কেউ কথা বলতে পারেন কি না, হাঁটতে পারেন কি না, এটাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। এখানে আমরা যারা কাজ করছি, তারা সবাই মিলে একটি পরিবার। পরিবার নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠান। মালিকপক্ষও সেভাবে সবাইকে মূল্যায়ন করে। প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বেতন, পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট (বেতন বৃদ্ধি) হচ্ছে। শারীরিক প্রতিবন্ধী যারা আছেন, তারাও এটা পাচ্ছেন। লাভের একটা অংশও শ্রমিকদের দিয়ে থাকি আমরা। সব শ্রমিকের জন্য বিমা সুবিধাও রয়েছে।’ এ বিষয়ে কথা হয় সিনিয়র আইনজীবী ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘টিম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ফোর-এ ইয়ার্ন ডায়িং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের কাজের সু্যােগ করে দিয়ে একটা মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমার বিশ্বাস এটা দেখে অন্য কারখানাও এমন মহতী উদ্যোগ নেবে। আমরা অটিস্টিকদের এভাবে কাজের সুযোগ করে দিতে পারলে তারা আর পরিবারের বোঝা হবে না, সম্পদ হয়ে দায়িত্ব নিতে পারবে।’ – জাগোনিউজ২৪.কম