লন্ডভন্ড করপোরেট সাম্রাজ্য
আক্রমণের মুখে পড়া গৌতম আদানির জন্য নতুন কিছু নয়। ১৯৯৮ সালে ভারতীয় এ ধনকুবের অপহরণের শিকার হয়েছিলেন। শোনা যায়, কয়েকশ কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে সেবার ছাড়া পেয়েছিলেন তিনি। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ের তাজমহল প্যালেস হোটেলে সন্ত্রাসী হামলার সময়ও সেখানে ছিলেন আদানি। গোটা একটা রাত বেজমেন্টে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তিনি। কয়েকদিন যাবৎ আবারও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন গৌতম আদানি। তবে এবার শুধু ব্যক্তিগতভাবে নয়, তার নাম জড়িয়ে থাকা কোম্পানিগুলোর ওপর দিয়েও বয়ে যাচ্ছে এই ঝড়। আদানি গ্রুপের তালিকাভুক্ত ১০টি কোম্পানি মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৯ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার বা দুই-প মাংশ বাজারমূল্য হারিয়েছে। আর ব্যক্তিগত সম্পদের দিক থেকে পাঁচ হাজার কোটি ডলারের বেশি হারিয়েছেন আদানি। বছরের শুরুতে যেখানে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী ছিলেন, এখন শীর্ষ দশেও নেই তিনি। তার ওপর গত ১ ফেব্রুয়ারি আদানি এন্টারপ্রাইজেসের প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের নতুন শেয়ার (এফপিও) ছাড়ার প্রক্রিয়া হঠাৎ স্থগিত করা হয়েছে। এসবের ফলে ভারতের অন্যতম শক্তিশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠীটির ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আদানি গ্রুপে এমন করুণ দশার কারণটা দেখলে অনেকটা পাহাড়ের গায়ে তীরের আঘাতে রক্তক্ষরণের মতো মনে হতে পারে। ভারতীয় এ করপোরেট জায়ান্টের বিষয়ে গত ২৪ জানুয়ারি একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ গবেষণা সংস্থা হিনডেনবার্গ রিসার্চ। এতে ‘করপোরেট জগতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধোঁকাবাজ’ আখ্যা দিয়ে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে শেয়ারবাজার কারসাজি, আর্থিক জালিয়াতির মতো গুরুতর অভিযোগ তোলা হয়। এর জবাব দিতে অবশ্য দেরি করেনি আদানি গ্রুপ। কয়েক দিনের মধ্যেই ৪১৩ পৃষ্ঠার বিশাল বক্তব্য প্রকাশ করে তারা। এতে হিনডেনবার্গের প্রতিবেদনের সব তথ্যকে ‘পুরোপুরি মিথ্যা’ এবং প্রতিবেদনটিকে সরাসরি ‘ভারতের ওপর আক্রমণ’ বলে উল্লেখ করা হয়। তাদের দাবি, আদানি গ্রুপ আইন মেনেই সব কিছু করেছে। তবে এতেও আস্থা ফেরেনি শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের। ১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ জানায়, সুইস ব্যাংক ক্রেডিট সুইস তার প্রাইভেট ব্যাংকিং ক্লায়েন্টদের মার্জিন ঋণের জামানত হিসেবে আদানি গ্রুপের বন্ড গ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছে। আদানি এন্টারপ্রাইজেসের শেয়ারের দর প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। গোষ্ঠীটির অন্য কোম্পানিগুলোও পিছিয়ে পড়েছে। এমন ‘অভূতপূর্ব’ বাজার পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত নতুন শেয়ার ছাড়ার পরিকল্পনা স্থগিত করে আদানি গ্রুপ।
কিন্তু এরপর কী হবে? উত্তর অনিশ্চিত। বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে সারা বিশ্ব ছুটে বেড়াচ্ছেন আদানি গ্রুপের নির্বাহীরা। কোভিড-১৯’র ধাক্কা মোকাবিলায় একটি বিশেষ দল গঠন করেছিল গোষ্ঠীটি। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত সমস্যাগুলো মোকাবিলায়ও কাজ করেছে এই দল। সাম্প্রতিক ধাক্কা মোকাবিলায় তাদের উচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে।
অবশ্য আদানি সাম্রাজ্যের জন্য এই হুমকিকে সাদা চোখে বাস্তব বলে মনে হয় না। গৌতম আদানিকে একজন দক্ষ পরিচালক হিসেবে মনে করা হয় এবং তার কোম্পানিগুলো অনেক মূল্যবান সম্পদের মালিক। তারা ভারতের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, ইসরায়েল ও শ্রীলঙ্কায় কয়েকটি বড় বন্দর চালায়। ভারতের ৩০ শতাংশ শস্য আদানির গুদামে, দেশটির বিদ্যুৎ স ালন লাইনের এক-প মাংশ পরিচালনা করে গোষ্ঠীটি। ভারতে বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের এক-চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করে তারা এবং সম্ভবত সিমেন্ট উৎপাদনের এক-প মাংশও তাদের হাতে। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভারতের বৃহত্তম খাদ্য সংস্থা হওয়ার চেষ্টায় রয়েছে আদানি গ্রুপ। গত আর্থিক বছরে গোষ্ঠীটির তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মোট আয় ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার, যা ভারতের মোট জিডিপির ০.৭ শতাংশের সমতুল্য। ওই বছর তাদের নিট মুনাফা ছিল ১৮০ কোটি ডলার।
তবু আদানির এই বিশাল সাম্রাজ্য একটুও প্রভাবিত হবে না তা বিশ্বাস করা কঠিন। আদানি গ্রুপ মুম্বাইয়ের কাছে একটি নতুন বিমানবন্দর তৈরি করছে, তিনটি সমুদ্রবন্দরে ব্যয় করছে মোট ৫০০ কোটি ডলার, দক্ষিণ কোরীয় সংস্থা পোস্কোর সঙ্গেথে অংশীদারত্বে ৫০০ কোটি ডলারের একটি ইস্পাত কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। তাদের নবায়নযোগ্য ও হাইড্রোজেন জ্বালানি প্রকল্পগুলো ভারতকে শুদ্ধ জ্বালানির পাওয়ার হাউসে পরিণত করার প্রচেষ্টার ভিত্তি হিসেবে দেখা হয়। এই সব প্রকল্পের জন্য প্রচুর পুঁজি প্রয়োজন। আর সেটি সংগ্রহেই নতুন শেয়ার বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিল আদানি গ্রুপ। কিন্তু যদি গোষ্ঠীটির বন্ডের দেনা বাড়ে এবং শেয়ারের দাম কমে যায়, তাহলে প্রয়োজনীয় তহবিল জোগাড় করা কঠিনই হবে।
এরই মধ্যে আদানি গ্রুপের এই সংকটের পরোক্ষ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে তার অংশীদারদের ওপরও। গত ১ ফেব্রুয়ারি ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বিমা কোম্পানি এলআইসি এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার শেয়ারের দম কমে গেছে যথাক্রমে আট ও পাঁচ শতাংশ। তবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো ঝুঁকি নিচ্ছেন না। গত সপ্তাহে অন্যান্য উদীয়মান বাজারগুলোর তুলনায় ভারতীয় শেয়ারবাজারের পারফরম্যান্স ছিল খারাপ। গত ২৭ জানুয়ারি ও ৩০ জানুয়ারি মাত্র দুই দিনে ভারতীয় শেয়ারবাজার থেকে ১৫০ কোটি ডলার তুলে নিয়েছে বৈশ্বিক তহবিলগুলো৷ এ অবস্থায় পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো হয়তো ভারতীয় টাইকুনদের সঙ্গে নতুন অংশীদারত্ব গড়ে তোলার আগে দু’বার চিন্তা করবে। সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট