শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:১৩ অপরাহ্ন

মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে অনিদ্রা ব্যবস্থাপনা

জিয়ানুর কবির
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

বর্তমান করোনা ভাইরাসের মহামারির পরবর্তী সময়ে অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে ঠিকমতো ঘুম না আসা। ঘুম মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙ্গা করে রাখে। আর ঘুম না এলে এই চাঙ্গা ভাবটা থাকে না, যা কাজ-কর্মে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। জীবনে কোনো না কোনো সময়ে সকলেই অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়। অনেকই অনিদ্রার সমস্যা কাটিয়ে উঠলেও বেশির ভাগ মানুষই দিনের পর দিন এই সমস্যায় ভুগতে থাকেন। ঘুমের সময় বিছানায় শুয়েও যখন কোনো ব্যক্তির সহজে ঘুম আসতে চায় না, কিংবা ঠিকমতো ঘুম হয় না বা ঘুম এলেও কিছুক্ষণ পর ভেঙে গিয়ে আর ঘুম আসতে চায় নাÍএ রকম সমস্যায় প্রায়ই ভুগতে থাকাকেই ইনসমনিয়া বা ঘুমের সমস্যা বলে মনে করা হয়।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, বয়সভেদে বিশ্বের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষই নিদ্রাহীনতা বা ইনসমনিয়া সমস্যায় ভুগছেন। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তি এবং অন্তঃসত্ত্বা নারী বা নতুন মায়েদের এ সমস্যা আরো বেশি হয়। ৫০ শতাংশ বয়স্ক ব্যক্তি এবং অন্তঃসত্ত্বা নারী বা ছোট বাচ্চার মায়েরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। বর্তমানে অনেক শিশু-কিশোরেরাও এই সমস্যার কথা বলেন। অনিদ্রা বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন-কারো ক্ষেত্রে রাত ১০টায় ঘুমোতে যায় কিন্তু রাত ১১টার আগে তার ঘুম আসে না অর্থাৎ ঘুমিয়ে পড়তে সমস্যা হয়। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুম ভেঙে যায়, অর্থাৎ একটানা ঘুমাতে পারেন না। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েন ও একটানা পাঁচ-ছয় ঘণ্টা ঘুমাতে পারেন কিন্তু এত ঘুমিয়েও তার তৃপ্তি হয় না। তিনি মনে করেন, তার ঘুম খুবই হালকা ও অপর্যাপ্ত। এজন্য তিনি একটা সতেজ ও গভীর ঘুম চান।
ইনসমনিয়া বা অনিদ্রার অনেক কারণ রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে অনিদ্রার প্রধান কারণগুলো হলো, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা, বিষণ্নতায় ভোগা, মানসিক অস্থিরতা, দাম্পত্য কলহ, চাকরি বা সামাজিক জীবনের কোনো বিষয় নিয়ে বিচলিত থাকা, মানসিক চাপ, জীবনধারায় শৃঙ্খলার অভাব ইত্যাদি। বিভিন্ন মানসিক রোগের উপসর্গ হিসেবেও অনিদ্রা হতে পারে। শরীরে হরমোনের পরিবর্তন যেমনÍথাইরয়েড হরমোনের সমস্যার কারণেও ঘুমের সমস্যা হতে পারে। মাদকাসক্ত, কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, তীব্র শারীরিক ব্যথা, শারীরিক বিভিন্ন রোগের কারণ হিসেবেও ঘুমের সমস্যা হতে পারে। ঘুমের সমস্যা বা ইনসমনিয়ার পরিণতি ভয়াবহ ও মারাত্মক। সুনিদ্রা একজন মানুষের জীবনে সুষম খাবারের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। দিনের পর দিন পর্যাপ্ত ঘুম না হলে একজন মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন গবেষণায় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুম আবশ্যক বলে মনে করেছেন। ঠিকমতো ঘুম না হলে জীবনযাত্রা এলোমেলো হয়ে পড়ে। একজন ব্যক্তির কর্মক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং জীবনের মানকে প্রভাবিত করে। গবেষণায় দেখা যায়, সাধারণত সমস্ত গুরুতর গাড়ি দুর্ঘটনার প্রায় ২০ শতাংশই চালকের ঘুমের সঙ্গে সম্পর্কিত। ঘুমের সমস্যার কারণে শারীরিকভাবে মানুষ দুর্বলতা বোধ করতে পারেন, তার মাথাব্যথা, মাথাব্যথা, শরীর ঝিমঝিম করা অনুভব হতে পারে, এমনকি স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে। ঘুমের ব্যাঘাতের কারণে মানসিকভাবে মনোযোগের ঘাটতি দেখা যায়, মেজাজ রুক্ষ হয়ে যায়, অল্পতেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, এমনকি আচরণজনিত নানাবিধ সমস্যা দেখা যায়।
অনেকেই দিনের বেলা কোনো কাজকর্ম ঠিকমতো না করতে পারার কারণে চাকরি বা ব্যক্তিগত দক্ষতায় প্রভাব পড়ে। আয়-রোজগার কমে গিয়ে জীবনযাত্রার মারাত্মক অবনতি ঘটে। ঘুমের সমস্যার সময়মতো চিকিৎসা না করার কারণে রাষ্ট্রের অনেক ক্ষতি হয়। বছরে শত শত বিলিয়ন টাকা ডাক্তারের ভিজিট, হাসপাতালের ফি, প্রেসক্রিপশন এবং ওষুধের পেছনে খরচ হয়। সুস্থ ব্যক্তিদের তুলনায়, অনিদ্রায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের উৎপাদনশীলতা অনেক কম হয়, যা দেশের জিডিপিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
আমাদের দেশে অনিদ্রার দুই ধরনের চিকিৎসা আছে। মেডিসিন সাপোর্ট থেরাপিতে অনিদ্রা দূর করার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঘুমের কতগুলো ওষুধ প্রদান করা হয় এবং এই মেডিসিন খেয়ে অনেকেই ভালো ফল পেয়ে থাকেন। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে ঘুমের ওষুধ খেলে লাভের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। আর সাইকোলজিক্যাল থেরাপিতে একজন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মনোবিজ্ঞানী কতগুলো মনোবৈজ্ঞানিক নীতি ও কৌশল ব্যবহার করে অনিদ্রার চিকিৎসা করে থাকেন। অনিদ্রায় আক্রান্ত ব্যক্তির সাইকোলজিক্যাল এসেসমেন্ট এর পর একজন সাইকোলজিস্ট সাধারণত চার ধরনের ওষুধবিহীন মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা কৌশল প্রয়োগ করে থাকেন। এই কৌশলগুলো হলোÍ
ক) স্লিপ হাইজিন :স্লিপ হাইজিনের মাধ্যমে ব্যক্তি বিছানায় যাওয়া ও জীবন যাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে ভালো ঘুম তৈরিতে সহায়তা করতে পারে। সুষ্ঠু জীবন যাপনের জন্য স্লিপ হাইজিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্লিপ হাইজিনের দুটি বিষয় হলো, (১) জীবনধারা ও (২) শোবার ঘরের বিষয়। (১) জীবনধারার প্রধান বিষয়গুলো হলো: ক্যাফেইন, নিকোটিন অ্যালকোহল, ব্যায়াম ও খাদ্যাভাস। ঘুমাতে যাবার চার ঘণ্টার মধ্যে ক্যাফেইন, নিকোটিন ও শক্ত ব্যায়াম করলে শরীর অনেক সতেজ থাকে এবং সহজে ঘুম আসতে চায় না। তাই চার ঘণ্টার মধ্যে এগুলো না করলে ঘুম ভালো হয়। অ্যালকোহলের নেশাও ঘুমের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। একদম ক্ষুদা নিয়ে কিংবা ভরা পেট খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় গেলেও ভালো ঘুম হয় না। তাই হালকা খাবার খেয়ে কিংবা ভরা পেটে খেলে দুই ঘণ্টা পরে ঘুমাতে যেতে বলা হয়। আবার (২) শোবার ঘরের বিষয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো, শোবার ঘরের গোলমাল বা শব্দের মাত্রা, ঘরের তাপমাত্রা, ঘরে বায়ু চলাচলের ধরন, আলোর মাত্রা, এবং তোশক ও বালিশের আরাম প্রভৃতি আমাদের ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে। শোবার ঘরটি এমন হতে হবে যেখানে তাপমাত্রা সহনীয় থাকবে, যথেষ্ট পরিমাণে আলো চলাচলের ব্যবস্থা থাকবে, নিঃশব্দ হবে এবং তোশক ও বালিশ পরিষ্কার ও আরামদায়ক হবে।
খ) স্লিপ শিডিউলিং :এই পদ্ধতিতে কতক্ষণ বিছানায় থাকবেন তা নির্ধারণ করা হয়। স্লিপ শিডিউলের প্রথমে বিছানায় যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠার একটি সময় ঠিক করে নেওয়া হয়। এই সময়ে প্রতিদিন বিছানায় যাওয়া ও নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠার প্রাকটিস করতে হয়। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও একই শিডিউল মানতে পরামর্শ দেওয়া হয়। সাধারণত ১৫ মিনিটের মধ্যে ঘুম না আসলে অন্য রুমে গিয়ে নামাজ পড়া বা পবিত্র কোরআন মজিদ তেলোয়াত করা বা প্রিয় বই পড়া বা রিলাক্সেশন প্রাকটিস করা যাতে করে আবার ঘুমানোর ভাব তৈরি হয়। এতে বিছানা ও ঘুমের মধ্যে সংযোগ স্থাপন হয়। আর বিছানায় বসে অন্য কাজ করা কিংবা ঘুমের সময় ছাড়া অন্য সময় ঘুমালে এমনকি দিনের বেলা ঘুমানো কিংবা দিনের বেলা ঘুমের তন্দ্রাভাব আসলে কিছুক্ষণ বিছানা ব্যবহার করলেও তা ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে।
গ) কগনিটিভ থেরাপি :কগনিটিভ থেরাপির মাধ্যমে ব্যক্তির চিন্তা, প্রত্যাশা, মূল্যায়ন, বিশ্বাস ইত্যাদিতে পরিবর্তন নিয়ে আসার মাধ্যমে ব্যক্তির ঘুম বাড়ানো। সাধারণ কগনিটিভ থেরাপিতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত সাইকোলজিস্ট কগনিটিভ থেরাপি প্রদান করেন। এই থেরাপিতে ব্যক্তির নেতিবাচক চিন্তা ও অযৌক্তিক বিশ্বাসগুলো তালিকা করে বিভিন্ন ধরনের সাইকোলজিক্যাল টেকনিক ব্যবহার করে চ্যালেজ করা হয়। কগনিটিভ থেরাপির মাধ্যমে মানসিক চাপ, উদ্বিগ্নতা, ডিপ্রেশন ও মানসিক সমস্যার চিকিৎসা করে ব্যক্তির ঘুমে পরিবর্তন আনা হয়।
ঘ) মাইন্ডফুলনেন্স থেরাপি বা রিলাক্সেশন :অনিদ্রায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতির কারণে শরীর উত্তেজিত থাকে, যা ভালো ঘুমের ক্ষেত্রে বিঘœ সৃষ্টি করে। মাইন্ডফুলনেন্স মেডিটেশন প্রাকটিস বা রিলাক্সশন শরীরে প্রশান্তি এনে দেয়। প্রফেশনাল সাইকোলজিস্টের কাছে এই পদ্বতি ট্রেনিং নিয়ে নিয়মিত প্রাক্টিস করতে পারলে খুব সহজেই ঘুম আসে। অনিদ্রা একটা চিকিৎসাযোগ্য মানসিক সমস্যা। আপনি বা পরিবারের কেউ অনিদ্রায় আক্রান্ত হলে উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে নিজে থেকেই অনিদ্রার ব্যবস্থাপনা করতে পারেন। উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো নিজে নিজে প্রাকটিস করেও পর্যাপ্ত ঘুম না আসলে আপনি একজন বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ নিতে পারেন। লেখক : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com