‘ছয় বা আট লেনের এক্সপ্রেসওয়ে, উড়াল বা আন্ডারপাস-পদ্মা সেতু- মেট্রো রেলসহ যোগাযোগে একের পর এক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। অথচ সড়কে শৃঙ্খলার ঘাটতিতে সব উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাবে। সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলার অভাব আমাকে অনেক কষ্ট দেয়।’ কথাগুলো দেশের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের। গত রোববার এক অনুষ্ঠানে তার মুখ থেকে বের হওয়ার কথাগুলো স্পষ্টতই সড়ক পরিবহন সেক্টরের বেহাল দশার স্পষ্ট আলামত।
যখন সড়কে বিশৃঙ্খলা থাকবে তখন তো দুর্ঘটনা ঘটবে- এটাই স্বাভাবিক। একজন মন্ত্রী হিসেবে তিনিও তা অনুভব করেন; দেশের প্রেক্ষাপটে এটাই বা কম কি! তাছাড়া অনুভব না করেও তো উপায় নেই। তিনি যদি অস্বীকার করেন; সাধারণ মানুষ তো সেটা মানবে না। এটাই বাস্তবতা। মন্ত্রী হিসেবে ওবায়দুল কাদের সড়কের বাস্তবতা স্বীকার করলেও কিছুটা উল্টো পথে হাঁটার চেষ্টা দেখছি বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কর্তৃপক্ষের। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ বেসরকারী বিভিন্ন সংগঠনের গত বছরের সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা একেবারেই মেনে নিতে রাজি হননি। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে পাওয়া বাৎসরিক পরিসংখ্যান সঠিক। এতে দেখো গেছে দুর্ঘটনা কমছে। কমছে হতাহতের সংখ্যাও। বিআরটিএ সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে উল্টো পথে হাঁটলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গত এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের চারধাপ অবনতি হয়েছে। এই পরিসংখ্যান তো আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশে চলমান সড়ক দুর্যোগের চিত্র আবারো উন্মোচিত করেছে। এটা বিশ্বাস সবাই করে দুর্ঘটনা কখনও শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যাবে না। তবে নিয়ন্ত্রণের বেশ কিছু পথ রয়েছে। সে পথে দেশকে হাঁটতে হবে। তাই বিতর্ক মুখ্য নয়। মুখ্য হলো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া।
বহুল কাঙ্খিত সড়ক পরিবহন আইনে একজন চালকের আট ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো নিষেধ। অথচ গেল সপ্তাহেই দেখা গেছে টানা ২৬ ঘণ্টা একজন এ্যাম্বুলেন্স চালক গাড়ি চালালেন। ক্লান্ত শরীরে তার চোখে ঘুম। ঘুমের চোখে গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ছয় জনের! অথচ তা দেখার কেউ নেই। একটু নজরদারি থাকলে তো এই দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা যেত।
যখন একটি গাড়ি নিয়ম ভঙ্গ করে টানা চলছে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে যদি গাড়িটি বন্ধ করে দিয়ে চালকের সঙ্গে বিআরটিএ কন্ট্রোল রুম থেকে কথা বলা যেত; তাহলে হয়ত ছয় জনের প্রাণ রক্ষা হতো। তা তো সম্ভব হয়নি। এই ব্যর্থতা কী কারো নয়? উন্নত দেশে তো সড়ক নিরাপত্তায় নানা রকম প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। আমরা সেদিক থেকে একেবারেই পিছিয়ে। কেন? সড়ক নিরাপত্তায় বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়ার সময় কী এখনও আসেনি?
গত রোববার রাজধানীর প্রগতি সরণিতে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় ঘটনাস্থলে প্রাণ গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাদিয়ার। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তা অকালেই ঝরে গেল সড়কে। একটি সম্ভাবনাময় জীবন প্রদীপ নিভে গেল সবার চোখের সামনেই।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, নাদিয়া তার এক বন্ধুর সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে রাজধানীর প্রগতি সরণি এলাকায় ঘুরতে আসেন। দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটের দিকে স্থানীয় একটি মার্কেটের সামনে পৌঁছালে পেছন দিক থেকে আসা ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের একটি বাস মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এতে নাদিয়া মোটরসাইকেল থেকে রাস্তায় পড়ে বাসের সামনের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান। প্রগতি সরণি বা বসুন্ধরা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনা কিন্তু মোটেও নতুন নয়। এর আগেও বহু দুর্ঘটনা এই এলাকায় ঘটেছে। কিন্তু প্রতিরোধে কার্যকর যে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে না। চালকদের যেমন প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতন করা যাচ্ছে না, তেমনি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের কার্যক্রম একেবারেই নামেমাত্র। সবচেয়ে আতঙ্কের জায়গাটি এখানেই। ঢাকার চালকরা দিনে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা গাড়ি চালান। বেশিরভাগ চালক চুক্তিতে মালিকদের থেকে দিনে ছয় থেকে আট হাজার টাকায় গাড়ি ভাড়া নেন। তাই চালকদের প্রথম টার্গেট থাকে মালিকের জমা উঠানো। পথে পথে নানা রকম চাঁদার দাবি মিটানো। তারপর তেল কেনা ও গাড়ি মেরামত। সবশেষে নিজেদের খরচ। খরচ মিটিয়ে নিজের আয় তোলার তাগিদে সড়কে চালকরা অনেক সময় বেপরোয়া। সেইসঙ্গে যানজটের কারণে চালকদের মানসিক চাপ আরো বাড়ে। এটা কি নিয়ম? মোটেই না।
অথচ চুক্তিতে গাড়ি চালানোসহ ওয়েবিল বন্ধে মালিক সমিতি বহুবার ঘোষণা দিয়েছে। নিয়োগপত্র দিয়ে চালক নেয়ার কথাও আইনে আছে। এর কোনো কিছুই কার্যকর হচ্ছে না। এজন্য কী কারো দায় নেই? অবশ্যই সড়ক মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএকে এর দায় নিতে হবে। এ জন্য ছদ্মবেশে রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সহাসড়ক, আঞ্চলিক ও জেলাসহ গ্রামীণ সড়কে বিআরটিএ দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের পাঠানো যেতে পারে। তারা দীর্ঘ তিনমাস ঘুরে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেন। সে অনুযায়ি তো কিছু ব্যবস্থা নেয়া যায়। তেমনি ১১১দফা সুপারিশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বাছাই করে বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। অন্যথায় চালকরা ২৬ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে গাড়ি চালাতেই থাকবে। বাসের থাক্কায় প্রাণ যাবে বিশ্ববিদ্য্যালয় শিক্ষার্থী নাদিয়ার। আমরা ঘটনা শুনব। আফসোস করব। দুঃখ প্রকাশ করব। সমবেদনা জানব। এটা সমাধান নয়। আর সমবেদনা জানাতে চাই না, দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন চাই। চাই নিরাপদ পথ।- রাইজিংবিডি.কম লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক