সুইডেনের পর ডেনমার্কে তুর্কি দূতাবাসের বাইরে এবং রাজধানী কোপেনহেগেনের একটি মসজিদের সামনে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের একটি অনুলিপি পোড়ানোর ঘৃণ্য ঘটনা ঘটেছে। এই ধর্মবিদ্বেষের নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি, যে কোনো ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ বা গ্রন্থসমূহ অন্যান্য ধর্মের মানুষের কাছেও পবিত্র বলে গণ্য। অনুরূপভাবে যে কোনো ধর্মের প্রবর্তক অন্যান্য ধর্মের মানুষের কাছেও অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও সম্মানীয়। ইউরোপে যারা পবিত্র কোরআন পোড়ায়, মহানবী (সা.)-কে অবমাননা করে, তাদের মানবিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে স্বাভাবিককারণেই প্রশ্ন ওঠে। এই অসুস্থতার বিস্তৃতি ঘটলে বিশ্বে শান্তি-স্থিতিশীলতা আরো হুমকির মধ্যে পতিত হবে, যা সাধারণভাবে বিশ্বমানবের কাম্য হতে পারে না। সুইডেন ও ডেনমার্কে পবিত্র কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় বিশ্বের প্রতিটি মুসলমান মানসিকভাবে প্রচ- আঘাত পেয়েছে, মর্মাহত হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বিশ্বমুসলিমের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে, নানা বিষয়ে পারস্পরিক বিরোধ ও মতপার্থক্য থাকলেও পবিত্র কোরআন ও রাসূল (সা.) এর ব্যাপারে কোনো বিরোধ বা মতপার্থক্য নেই। কিছুদিন আগে ভারতে মহানবী (সা.)-এর অবমাননায় বিশ্বের তাবৎ মুসলিম দেশ ও জনপদ থেকে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছিল। একইভাবে পবিত্র কোরআন পোড়ানোর প্রতিবাদ উঠেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনপদ থেকে। প্রতিবাদের এই ধরন ও ভাষাটা সংশ্লিষ্ট দেশ, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র তথা খ্রিস্ট বা শ্বেতাঙ্গবিশ্বকে উপলব্ধি করতে হবে, বিবেচনায় নিতে হবে। বিশ্বের এক চতুর্থাংশের বেশি মানুষ মুসলমান। তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, তাদের রাসূল (সা.) এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ ও অবমাননা প্রদর্শন তারা কখনোই মেনে নেবে না।
সুইডেনের পর ডেনমার্কে তুর্কি দূতাবাসের বাইরে এবং রাজধানী কোপেনহেগেনের একটি মসজিদের সামনে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের একটি অনুলিপি পোড়ানোর ঘৃণ্য ঘটনা ঘটেছে। এই অতিগর্হিত অপকর্মটি করেছেন কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দল হার্ড লাইনের নেতা রাসমুস পলুদান। এই একই ব্যক্তি ২১ জানুয়ারি ডেনমার্কের রাজধানী স্টকহোমে তুর্কি দূতাবাসের সামনে পবিত্র কোরআন পোড়ান। আমরা এই অমার্জনীয় দুষ্কর্মের তীব্র নিন্দা জানাই। ঘটনার হোতাকে জানাই ধিক্কার। উল্লেখ্য, রাসমুস পলুদান সুইডেন ও ডেনমার্কের যৌথ নাগরিক। তিনি গত বছর এপ্রিলে ঘোষণা দেন, পবিত্র রমজান মাসে তিনি বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে পবিত্র কোরআন পোড়াবেন। তার এ ঘোষণায় তখন সুইডেনজুড়ে দাঙ্গা হয়েছিল। সেই পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক, তিনি প্রথমে সুইডেনে এবং পরে ডেনমার্কে পবিত্র কোরআন পোড়ালেন। লক্ষ করার বিষয়, রাসমুস পলুদান পবিত্র কোরআন পোড়ানোর স্থান হিসাবে তুর্কি ‘দূতাবাসের সামনে’র জায়গা বেছে নিয়েছেন। এতে বুঝা যায়, তুরস্কের প্রতি তার অসন্তোষ রয়েছে। জানা যায়, ডেনমার্ক ও প্রতিবেশী ফিলল্যান্ড ন্যাটো জোটের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। এজন্য ন্যাটোর সকল সদস্যের অনুমোদন বা সমর্থন প্রয়োজন। ন্যাটোর অন্যতম সদস্য তুরস্কের আপত্তি আছে তাদের বিষয়ে। তুরস্ক আগেই ইঙ্গিত দিয়েছে, সে সুইডেনের অন্তর্ভুক্তিতে অনুমোদন দেবে না। এছাড়া তুরস্ক ব্রাসেলসে একটি বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে, যেখানে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। ডেনমার্কের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পথে তুরস্ক অন্তরায় হওয়ায় রাসমুস পলুদান পবিত্র কোরআন পোড়ানোর কর্মসূচি না নিয়ে অন্য কোনো কর্মসূচিও নিতে পারতেন। তা না নিয়ে তিনি পবিত্র কোরআনকে বেছে নিয়েছেন সম্ভবত এজন্য, এতে তুরস্ক সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ ও আহত হবে। তার ভেতর পবিত্র কোরআন বা মুসলিম বিদ্বেষ যে অস্থি-মজ্জায় জড়িয়ে আছে, এটাও এ থেকে প্রমাণিত হয়।
রাসমুস পলুদানের মতো রাজনীতিক ইউরোপে কম নেই, যারা ইসলাম বা মুসলিম বিদ্বেষে আক্রান্ত। ইসলামকে তারা ভীতিকর এবং তার অনুসারী মুসলমানদের তাদের অস্তিত্বের হুমকি মনে করে। ইউরোপের দেশে দেশে চরম ডানপন্থী বা উগ্রপন্থী রাজনৈতিক দলের প্রভাব বিস্তার লাভ করছে, যারা মূলত শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী, ঘোর সাম্প্রদায়িক এবং বিশেষভাবে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশেও এ ধারার রাজনীতির সম্প্রসারণ লক্ষ করা যাচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পবিত্র কোরআনের অবমাননা, রাসূল (সা.)-কে কাটুর্নের বিষয়বস্তু বানানো, হিজাব নিষিদ্ধ করাসহ বিবিধ ইসলাম বা মুসলিমবিদ্বেষী অপকর্ম ও মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন সম্প্রতিক বছরগুলোতে উদ্বেগজনকহারে বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ জাগিয়ে তোলা হয়েছে বা হচ্ছে মূলত রাজনৈতিক কারণে। শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাওয়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতা ভবিষ্যতে তাদের হাত থেকে অন্যদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে এটা করা হচ্ছে। শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠাই যখন মুখ্য, তখন অন্যান্য বর্ণের অবহেলিত, ধিকৃত হওয়াই স্বাভাবিক। তাদের ওপর বর্ণবাদী হামলা-নির্যাতন অবশ্যম্ভাবী। সেটাই হচ্ছে। কালো ও মিশ্র বর্ণের লোকদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপে নানাভাবে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। বর্ণবাদ, সম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিদ্বেষের সবচেয়ে ভয়াবহ শিকার হচ্ছে মুসলমানরা। তারা অধিকাংশই অশ্বেতাঙ্গ। আবার শ্বেতাঙ্গদের বেশিরভাগই খ্রিস্টান। খ্রিস্টানদের সঙ্গে মুসলমানদের বিরোধ-বিবাদ পুরানো। তাদের মধ্যে দীর্ঘ ক্রুসেডও সংঘটিত হয়েছে। খ্রিস্টবিশ্ব মুসলিমবিশ্বকে ভালো নজরে দেখে না। অন্যভাবে এখানে ক্রুসেড অব্যাহত আছে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার আজকের অবস্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা দায়ী। অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে এসব দেশকে প্রায় ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলোর বিপরীতে ইহুদিরাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করেছে ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্র গং। তারাই তাকে টিকিয়ে রেখেছে মুসলিম দেশগুলোকে জব্দ করার জন্য। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং খ্রিস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদ এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। এই দুই শ্রেষ্ঠত্ববাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়েছে মুসলমানরা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা সারাবিশ্বে মানবাধিকার ফেরি করে বেড়ায়। তাদের মানবাধিকার নীতি কার্যত শ্বেতাঙ্গ ও খ্রিস্টানদের জন্য প্রণীত। ইউক্রেন যুদ্ধে শ্বেতাঙ্গরা বিপন্ন ও দেশত্যাগী হয়েছে। তাদের আশ্রয় ও সেবার জন্য প্রতিযোগিতা চলছে। অথচ, সিরিয়া-লিবিয়া ও অন্যান্য দেশের শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়নি। আফ্রিকার অনেক দেশে খাদ্যাভাবে মানুষ দুর্ভিক্ষাবস্থার শিকার। তাদের জন্য কোনো সহায়তা নেই। এই হলো যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের মানবাধিকারবোধ ও নীতির স্বরূপ।
এধরনের অপকর্ম ও ঘৃণ্য ঘটনা ঘটতে থাকলে তার খেসারত একদিন সংশ্লিষ্টদের দিতে হবে। আমরা আশা করবো, তারা সর্তক ও সাবধান হবে এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ, খ্রিস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদের পথ থেকে দ্রুত সরে আসবে। শান্তিময়, স্থিতিশীল ও মানবিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় এর বিকল্প নেই। বিশ্ব সম্প্রদাযকেও এমন ঘটনা রোধে আরো কঠোর হতে হবে। তা না হলে কোন নির্দিষ্ট ধর্ম বা গোষ্ঠির মানুষ নয়, গোটা মানবজাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।