বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৫৯ অপরাহ্ন

নোবেল জয়ী আবদুল রাজাক গুরনাহর কুরআন ক্লাসের কথা

আহমদ মতিউর রহমান
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

বিশ্ব সাহিত্যের বর্ণাঢ্য আসর বসেছিল ঢাকায়। সাহিত্যের এই মহা আসরে অংশ নেন নোবেল ও বুকার পুরস্কার বিজয়ী লেখক লেখিকাসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশের নামকরা সাহিত্যিকরা। গত ৮ জানুয়ারি রোববার শেষ হয় চার দিনের এই সাহিত্য-সাংস্কৃতিক উৎসব। ঢাকা লিট ফেস্ট নামের এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন গত তিন বছরে আর হয়নি। কোভিড বিরতির পর হলো ঢাকা লিটারারি ফেস্টিভ্যাল বা ঢাকা লিট ফেস্ট এর দশম আসর। রোববার সন্ধ্যায় জাঁকজমকপূর্ণ সমাপনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ উৎসব। সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবারের আয়োজনে আমন্ত্রিত বিশেষ অতিথিরা। এই মিলনমেলা হয়তো ঢাকাকে বিশ্বসভায় তুলে ধরবে কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনকে বিশ্বসভায় নেয়ার ক্ষেত্রে তেমন ভূমিকা রাখবে কি না সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কেননা আশপাশের দেশগুলোতে যে হারে ইংরেজি ভাষায় বই বের হচ্ছে, ইংরেজি অনুবাদ বা ভার্সন হচ্ছে বাংলাদেশে সে হারে হচ্ছে না। উৎসব শব্দটাকে ব্রান্ডিং না করে ফেস্ট দিয়ে কি বার্তা দেয়া হলো তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবে আন্তর্জাতিকতার যে ছোঁয়া দিয়ে গেল এই উৎসব সেটাও কম নয়। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের সবুজ অঙ্গনসহ একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তন, নজরুল মঞ্চ ও কয়েকটি হলে হয় এসব অনুষ্ঠান। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে হয় উদ্ভোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান। উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন ২০২১ সালে নোবেল বিজয়ী আবদুল রাজাক গুরনাহ। সাধারণ পোশাকে তিনি চার দিন ঘুরে বেরিয়েছেন বাংলা একাডেমি চত্তরে। বহু লোককে দিয়েছেন অটোগ্রাফ। উৎসবের তৃতীয় দিনে সাহিত্য বিশারদ মিলনয়তনে এক অনুষ্ঠান শেষে দেখা পেলাম তার। কথা বললাম, অভিনন্দন জানালাম। বললাম আপনাকে নিয়ে ঢাকার পত্রপত্রিকায় আমি আর্টিক্যাল লিখেছি। শুনে খুশি হলেন। ক্লিপিং দিতে চাইলে তার প্রটোকলের দায়িত্বে নিয়োজিত মেয়েটি জানাল স্যার তো বাংলা বুঝবেন না নিয়ে কি করবেন। এদিকে যারা তাকে চিনতে পারছে এসে অটোগ্রাফ নিচ্ছে। আমি বুকওয়ার্ম স্টল থেকে তার বই সংগ্রহ করে আনতে আনতে তিনি জন অরণ্যে হারিয়ে গেছেন। পরে জানলাম হোটেলে চলে গেছেন। পরিবহন পুলে খবর নিয়ে গেলাম হোটেলে। শেষে হোটেলের কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের সহায়তায় সংগ্রহ করা গেল অমূল্য অটোগ্রাফ।
শেষ দিনের অনুষ্ঠানে গুরনাহর ছিল একটি একক অনুষ্ঠান। সেখানে নিজের জীবনের সফলতার গল্প শোনালেন সাহিত্যে এই নোবেলজয়ী । বেলা ১১টায় শুরু হয় ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহর আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ডেজারশন’ পর্ব। গুরনাহর সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন ব্রিটিশ প্রকাশক ও সম্পাদক আলেকজান্ডার প্রিঙ্গলে। তাঁদের আলোচনায় সাহিত্যের বিভিন্ন প্রসঙ্গের সঙ্গে উঠে আসে গুরনাহর শৈশবের গল্প। প্রিঙ্গলে সম্পাদনা করেছেন গুরনাহর বই। অনুষ্ঠানে গুরনাহ জানালেন ছোটবেলায় পড়ার মতো বইয়ের যথেষ্ট জোগানও তিনি পাননি। অথচ নিজের মেধায় তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। বই জোগাড় করতে না পেরে পড়ার ক্ষুধা মেটাতেন স্কুলের পাঠ্যবই থেকেই। এরপর ছাত্রজীবনেই লেখালেখিও শুরু করেন তিনি। তবে সেটাও ছিল নিজের বোঝার জন্য। এমনকি নিজের লেখা প্রকাশের বিষয়েও তেমন কোনো ধারণা ছিল না। শিক্ষাজীবন এবং বই পড়ার অভ্যাস প্রসঙ্গে গুরনাহ বলেন, ‘শিক্ষা বলতে স্কুলেই শুরু। পঞ্চম শ্রেণী থেকে আমি একটি সরকারি স্কুলে লেখাপড়া শুরু করি। সকাল ৭টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত সরকারি স্কুলের ক্লাস। শেষ করে দুপুরের খাবার খেতাম বাসায়। বেলা ২টা থেকে আবার আরেকটি স্কুলে যেতাম। সেখানে কুরআন শেখানো হতো। ২ ঘণ্টা কুরআন স্কুলে থাকতাম। এই স্কুলের একটি ভালো দিক ছিল, পবিত্র কুরআন পুরোটা পড়া শেষ হলে পরীক্ষা নেয়া হতো। পরীক্ষায় পাস করলে গ্র্যাজুয়েট বলা হতো। তারপর আর কুরআন স্কুলে যাওয়া লাগত না। অন্য বিশেষ একটি কারণে, হয়তোবা বিশেষ প্রতিভার কারণে আমি দুইবার পড়া শেষ করেছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর।’ আবদুলরাজাক গুরনাহ তার আলোচনায় বলেন, ছোটবেলায় যখন পড়ার ইচ্ছা জেগেছিল, তখন বইয়ের বেশ দাম ছিল। নিজের প্রথম লেখা বই প্রসঙ্গে গুরনাহ বলেন, ‘আমি সেই সময়টা সম্পর্কে লেখার চেষ্টা করেছিলাম, সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কিছু না বলেই। আমাকে একজন প্রশ্ন করেছিল যে আপনি কতখানি বলতে পারেন? এই ক্ষেত্রে আপনি সেসব মানুষ যারা সেখানে ছিল তাদের বিপদের মুখে না ঠেলে দিয়ে কতখানি লিখতে পারেন। কারণ, আমি তখন সেই সময়ের নাগরিক অধিকার নিয়ে লিখতাম, শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য স্বাধীনতা নিয়েও লিখতাম। আরেকটি বিষয় নিয়ে লিখতাম যে একজনের সাথে আরেকজনের এত নির্মমতা কেন! আমি কিছু মানুষকে জানতাম, যাদের সাথে এমনটা করা হয়েছিল। তাদের অভিজ্ঞতাগুলো তুলে ধরার চেষ্টায় ছিলাম।’ এসব কথা ভালো লাগার মতো। সুদূর আফ্রিকার তাঞ্জানিয়ার লোক হয়েও তিনি এখানে এসে বাংলাদেশীদের আপন হয়ে গেলেন। শৈশবে মক্তবে কোরআন পাঠ করে এ দেশের সকল মানুষই। এ ছাড়া দিনজুড়ে ছিল অতিথিদের নিয়ে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সাহিত্য, অনুবাদকর্মসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা পর্ব। শেষ দিনে বিভিন্ন আলোচনা পর্ব ও অনুষ্ঠান শুরু হয় সকালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। সকাল ১০টায় হয় ভবিষ্যতের বিজ্ঞান, ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের ধাঁধা নিয়ে আলোচনা। বিশ্বায়নের সময় ভবিষ্যতের কবিতা কেমন হবে, তা নিয়ে আলোচনা করেন গৌতম গুহ রায়, সাথে ছিলেন আশরাফ জুয়েল ও মোহাম্মদ নুরুল হুদা। একই সময়ে শিশুদের বেড়ে ওঠা নিয়ে আলোচনা করেন ফারহানা মান্নান।
৫ জানুয়ারির হিমেল সকালে আবদুলরাজাক গুরনাহ, ভারতের সাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষ, বাংলাদেশের সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা ফিতা কেটে আনুষ্ঠানিকভাবে লিট ফেস্টের উদ্বোধন করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন লিট ফেস্টের তিন পরিচালক সাদাফ সায, কাজী আনিস আহমেদ ও আহসান আকবর। অংশ নেন সোমালিয়ার ঔপন্যাসিক নুরুদ্দিন ফারাহ, আন্তর্জাতিক বুকারজয়ী ভারতীয় লেখিকা গীতাঞ্জলী শ্রী, বুকার জয়ী শ্রীলংকার শেহান তিলকাকরুণা, পশ্চিম বঙ্গের বিশিষ্ট কবি জয় গোস্বামীসহ বিভিন্ন দেশের আমিন্ত্রত সাহিত্যিকগণ। তৃতীয় দিনে দুপুরে ছিল গীতাঞ্জলীর বক্তৃতা। আমি গিয়েছিলাম বিকেলে ফলে সে অনুষ্ঠান শোনা হয়নি। তাকে নিয়ে আমি ৫/৬ টি পত্রিকায় আর্টিক্যাল লিখেছি। দেখা হলে মন্দ হতো না। হোটেলে খোঁজ করেও পাওয়া গেল না। তিনি ফেরেননি। ফ্রন্ট ডেস্কে ক্লিপিংস ও একটি ম্যাজাজিন রেখে এলাম তার জন্য। কর্মকর্তারা যতœ করে রেখে দিলেন তাকে পৌছাবেন বলে। ফেস্টে জার্মানি, বৃটেন ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশের লেখক লেখিকাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। বাংলাদেশের আতিথেয়তায় তারা মুগ্ধ, এত সাহিত্যামোদীর দেখা পেয়েও ভাল লাগছে বলে জানালেন তারা। মেলায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি স্টল দেখে কথা বললাম রোহিঙ্গা তরুণী আয়লার সাথে। সে জানালো তার বাবা মাকে হত্যা করেছে মিয়ানমান সেনারা। সে আশ্রয় নিয়েছে উখিয়ার একটি ক্যাম্পে। সে একজন চিত্রশিল্পী। তার দু:খের কাহিনী শুনে মনটা ভার হয়ে উঠলো।
ঢাকা লিট ফেস্টের টাইটেল স্পন্সর ছিল ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউন। সমাপনী অনুষ্ঠানের শুরু হয় ঢাকা লিট ফেস্টের আয়োজক প্রতিষ্ঠান যাত্রীকের প্রযোজনায় আয়োজিত নাচ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। লিট ফেস্টের দশম আয়োজনে অংশ নিয়েছেন পাঁচ মহাদেশের পাঁচ শতাধিক বক্তা, শিল্পী ও চিন্তাবিদ। তাদের মধ্যে একটি বিরাট সংখ্যক লেখক সাহিত্যিক অতিথি ছিলেন ৫ টি মহাদেশ থেকে আসা। ১৭৫টির বেশি সেশনে আলোচনা হয় দেশি-বিদেশি সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা, চিকিৎসা, উদ্ভিদবিজ্ঞান থেকে শুরু করে শিশুদের বিনোদন নিয়ে। সমাপনী অনুষ্ঠানে ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক ও প্রযোজক সাদাফ সায জানান, সবার অংশগ্রহণই সফল করেছে এই আয়োজন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অন্য দুই পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ ও আহসান আকবর। লিট ফেস্টের দশম আসরের প্লাটিনাম স্পন্সর ছিল সিটি ব্যাংক। সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সিটি ব্যাংকের সিইও মাসরুর আরেফিন। সমাপনী অনুষ্ঠান শেষে বর্ধমান হাউসের মাঠে শুরু হয় কোক স্টুডিও বাংলার পরিবেশনা। সমাপনী দিনে সারা দিনই ছিল দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকদের সরব উপস্থিতি। আয়োজকেরা জানান, এই উৎসব গত তিন বছর করা সম্ভব হয়নি করোনা মহামারির কারণে। ভবিষ্যতে ঢাকা লিট ফেস্ট আরও বড় পরিসরে করার কথা জানিয়েছেন তাঁরা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com