একদিন দু’দিন নয়, ৩২ বছর হলো দৈনিক ইনকিলাবে কলাম লিখে চলেছি। এছাড়া বছরের পর বছর ধরে প্রথম পৃষ্ঠায় রাজনৈতিক ভাষ্যও লিখেছি। মেঘে মেঘে বেলা অনেক হলো। এখন মনে হচ্ছে, কবির ভাষায়, ‘চারিদিকে দেখ চাহি’। জাতীয় কবি নজরুলকে প্রেমের কবি, বিদ্রোহী কবি প্রভৃতি সব ধরনের অভিধায় ভূষিত করা যায়। কিন্তু তিনিও তো লিখেছেন,
খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে
বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে।
তিনি কাকে উদ্দেশ্য করে এই অমর কিন্তু মহা মূল্যবান গানটি রচনা করেছেন সেটি বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ বিশ^কবি হিসেবে পরিচিত। তিনিও নানান বিষয়ে কবিতা, গান ইত্যাদি রচনা করেছেন। কিন্তু তিনি এমন গানও লিখেছেন যার বাণী হলো,
তব নাম লয়ে চন্দ্র তারা অসীম শূন্যে ধাইছে
রবি হতে গ্রহে ঝরিছে প্রেম, গ্রহ হতে গ্রহে ছাইছে
অসীম আকাশ নীলশতদল তোমার কিরণে সদা ঢলঢল
তোমার অমৃতসাগর-মাঝারে ভাসিছে অবিরামে।
এখানেও কবি কোন মহাশক্তির কথা বলছেন সেটি বুঝতেও বিদগ্ধজনের কোনো অসুবিধা হয় না। আমরাও তো বলি, আসমান, জমিন এবং এর মধ্যবর্তী যত কিছু আছে, যথা চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা, পাহাড়, পর্বত, মানুষ অর্থাৎ সমস্ত চেতন ও অচেতন পদার্থের মালিক, ¯্রষ্টা এবং পালনকর্তা সেই মহাপ্রভু। এর মধ্যে বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে। সাধারণ বিজ্ঞানী তো বটেই, নোবেল পুরষ্কার জয়ী কিছু কিছু বিজ্ঞানীও এমন সব তথ্য প্রকাশ করেছেন, যা পড়ে খোদ মহাবিজ্ঞানীরাই চমকে ওঠেন। যেমন নোবেল পুরষ্কার জয়ী স্যার রোজার পেনরোজের পিলে চমকানো তথ্য। তিনি বলেছেন, আমরা বর্তমানে যে পৃথিবীতে বাস করি, সেটি মহাবিশ^ বা ইউনিভার্সের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ। বলা হয় যে, কম করে হলেও ১৩৭৫ কোটি বছর পূর্বে এই মহাবিশে^র সৃষ্টি হয়েছে। আরো বলা হয় যে, বিগব্যাং বা মহাবিষ্ফোরণের মাধ্যমে এই মহাবিশে^র সৃষ্টি হয়েছে। বিগব্যাং হোক বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, এই মহাবিশে^র শুরুটা যে আকারে ছিল এখন সেটি শত সহ¯্র কোটি গুণ বর্ধিত এবং সম্প্রসারিত হয়েছে। অথচ, আমরা এই মহাবিশ^ সম্পর্কে কতটুকুই বা জানি? একটু আগেই বলেছি, হাজার হাজার কোটি গ্রহনক্ষত্রের মধ্যে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পৃথিবী নামক আমাদের এই গ্রহটি। আর চন্দ্র সেই গ্রহেরই একটি উপগ্রহ মাত্র। সেই চন্দ্রপৃষ্ঠেও মানুষ অবতরণ করেছে মাত্র সেদিন, অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে। নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে নেমেও এক জায়গায় স্থির থাকতে পারেননি। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে তাকে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হয়েছে। শুধুমাত্র চাঁদে অবতরণ করতেই মানবজাতিকে শত শত বছর গবেষণা ও সাধনা করতে হয়েছে। তাহলে ভাবুন, হাজার হাজার মাইল আলোকবর্ষ দূরে যেসব গ্রহ নক্ষত্র রয়েছে তার রহস্য আদৌ কি কোনোদিন উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে?
মুসলমান হিসাবে আমরা ইহকাল-পরকাল এবং জান্নাত ও জাহান্নামে বিশ^াস করি। কিন্তু আমরা কেউ জানি না, সেগুলি কোথায় অবস্থিত। এছাড়া মহাপবিত্র আসমানী গ্রন্থ আল কোরআনে অসংখ্য জাতিগোষ্ঠির কাহিনী বর্ণনা করা আছে, যারা নাফরমানীর জন্য ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু এসব ঘটনা কতদিন আগের? কত হাজার বা লক্ষ বছর আগের? এইসব প্রশ্নের মধ্যে বোমা বিষ্ফোরণের মতো নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী স্যার রোজার পেনরোজ বলেছেন যে, এই মহাবিশে^র আগে আরেকটি মহাবিশ^ ছিল। তার অস্তিত্ব ছিল বিগব্যাং বা মহাবিশে^র আগে। এই আলোচনাটি সামান্য টেকনিক্যাল হবে। না করে উপায় নাই। স্যার পেনরোজ বলছেন, ব্ল্যাক হোল যদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় তাহলে সেই হারিয়ে যাওয়া মহাবিশে^র অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেতেও পারে। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের আবিষ্কারের পর পর স্যার পেনরোজ আরেকটি মহাবিশে^র সন্ধান দিলেন। তিনি বলেছেন যে, আকাশে ‘হকিং পয়েন্টস’ বলে যে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তেজষ্ক্রিয়তা দেখা যায়, সেগুলো ঐ আরেকটি মহাবিশে^র ভগ্নাংশবিশেষ। এই তেজষ্ক্রিয়তা বিচ্ছুরিত হচ্ছে ব্ল্যাক হোল থেকে, যে ব্ল্যাক হোল একটি মহাবিশ^কেও খেয়ে ফেলেছে। ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে এটুকু বলেই শেষ করতে চাই যে, তার আকর্ষণ শক্তি এত প্রবল যে আলোক রশ্মিও তার রাহুগ্রাস থেকে রক্ষা পায় না। আরেক মহাবিশ^ সম্পর্কে আজ আপাতত এখানেই শেষ করছি। যদি বেঁচে থাকি তাহলে এটি নিয়ে আরো বিস্তারিত কথা বলার আশা রাখি।
॥দুই॥
আমরা তো জানি ছায়াপথ বা মিল্কিওয়েজের কথা। সেই সূত্রেই জানি সৌরমন্ডলের কথা। সৌরমন্ডলের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য। তার চারিধারে অসংখ্য গ্রহ-উপগ্রহ আপন আপন কক্ষ পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব আনুমানিক ১৫ কোটি কি.মি.। সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছতে সময় লাগে ৮ মিনিট। অর্থাৎ সূর্য যখন উদিত হয় ঠিক সেই মুহূর্তেই আমরা সূর্যকে দেখতে পাই না। দেখতে পাই উদিত হওয়ার ৮ মিনিট পর যখন সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসে। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল। এই গতিতে ট্র্যাভেল করে ৮ মিনিটে সূর্যরশ্মি আমাদের চোখে পড়ে। আর পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ২ লক্ষ ৩৮ হাজার ৮৫৫ মাইল। চাঁদের চেয়ে পৃথিবী ৫০ গুণ বড়।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই যে, এই পৃথিবী থেকে আমরা যে সূর্যকে দেখি তার বাইরেও রয়েছে এক বা একাধিক সূর্য। তেমনি একটি সূর্যের অস্তিত্ব কিছু দিন আগে আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে যে ছবি দেওয়া হলো সেখানে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বাইরেও আরেক পৃথিবী। আর সেই পৃথিবী আমাদের পৃথিবীর মতো বন বন করে ঘুরছে আরেক সূর্যের চারধারে। এই নতুন খোঁজ পেয়ে আশায় বুক বেঁধেছেন বিজ্ঞানীরা। বলা হচ্ছে, বিশ্বব্রহ্মা-ে অর্থাৎ মহাবিশে^ পৃথিবীর মতো দেখতে গ্রহও আছে, আবার সূর্যের মতো উজ্জ্বল নক্ষত্রও আছে। তবে এই গ্রহ-তারার জুটি রয়েছে আরও কাছাকাছি, পাশাপাশি। পৃথিবী থেকে তিন হাজার আলোকবর্ষ দূরে। আসলে সূর্যও হাজার হাজার নক্ষত্রের মতই একটি নক্ষত্র। কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ সম্ভবত নক্ষত্ররাজির সমষ্টি দেখেই বলেছিলেন, ‘অনন্ত নক্ষত্র বিথি’। একটু আগে যে আরেকটি সূর্যের কথা বললাম সেটির নাম ‘কেপলার-১৬০’। তাকে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবীর মতো যে গ্রহটি তার নাম ‘কেওআই-৪৫৬.০৪’। আমি একটি ফাইল মেইনটেইন করছি, যার শিরোনাম দিয়েছি ‘চন্দ্র সূর্য ও মহাবিশ^’। সেই ফাইলে এসম্পর্কিত অনেক তথ্য আছে। বর্তমান রাজনৈতিক ডামাডোল থেকে আমরা যদি শান্তিপূর্ণ পথে বেরিয়ে আসতে পারি তাহলে আমি ধীরে ধীরে ঐসব তথ্য ইনকিলাবের সম্মানিত পাঠকদের কাছে পেশ করবো, ইনশাআল্লাহ।
॥তিন॥
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মহাকাশ বিজ্ঞানের এক অসাধারণ অনন্য আবিষ্কার। এই অতিকায় ও অতি শক্তিশালী টেলিস্কোপটি মহাবিশ^ সম্পর্কে আমাদের সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। আজ সে সম্পর্কে কিছু লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগে চন্দ্র সম্পর্কে সর্বশেষ যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে সেসম্পর্কে আলোকপাত করা যাক।
২০২২ সালের ২১ নভেম্বর নাসার বিজ্ঞানীরা এমন একটি তথ্য দিয়েছেন যেটি একদিকে বিশ^বাসীকে চমকিত করেছে, অন্যদিকে তেমনি তাদের মনে কিছু আশাও সঞ্চার করেছে। নাসার ঐ ঘোষণা বা তথ্যে বলা হয়েছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে মানবজাতি চন্দ্র বা চাঁদে বাস করতে পারবেন এবং সেখানে কাজ করতে পারবেন। খবরটি কি থ্রিলিং বা রোমহর্ষক মনে হচ্ছে না? এই খবরটি প্রকাশের এক সপ্তাহ আগে নাসা মনুষ্যবিহীন একটি মহাকাশযান চন্দ্রে উৎক্ষেপণ করে। নভোচারীরা বলেন যে, সেদিন সুদূর নয় যখন শুধু চন্দ্রই নয়, মঙ্গলগ্রহেও মানুষকে নিয়ে মহাশূন্যযান অবতরণ করবে। ওরিয়ন লুনার (চন্দ্র সম্পর্কিত) মহাকাশযানের নেতা হাওয়ার্ড হু বলেন যে, আমরা মানুষকে চাঁদে পাঠানোর চেষ্টা করছি। তারা সেখানে আরো বেশি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান কাজে ব্যাপ্ত থাকবেন।
॥চার॥
জাপানের একটি মহাকাশ মিশন ৬ বছর ধরে মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষণা করেছে। গত ১৬ আগস্ট (২০২২) তাদের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, পৃথিবীতে যে বিপুল জলরাশি বা পানি রয়েছে সেই সব পানি সৌরমন্ডলের চারিদিকে পরিভ্রমণরত যেসব গ্রহাণু রয়েছে সেই সব গ্রহাণু থেকে এই বিপুল পরিমাণ পানি এসেছে। রাইগু নামক গ্রহাণু থেকে ২০২০ সালে যেসব ম্যাটেরিয়াল পৃথিবীতে আনা হয়েছে, সেসব ম্যাটেরিয়াল নিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রাণের উৎস এবং মহাবিশে^র গঠন নিয়ে গবেষণা করছেন। এই গবেষেণা করতে গিয়ে তারা বলেছেন যে, আগামী ৮ বছরের মধ্যে বসবাস করার জন্য মানুষকে চাঁদে পাঠানো সম্ভব হতে পারে।
শেষ করার আগে আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের খবরে প্রকাশ, এক শ্রেণীর বিজ্ঞানী বলেছেন যে, মঙ্গলগ্রহে মানুষ আছে, সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে এই গ্রহটি নিয়ে আমরা যতটুকু ভেবেছি তারচেও বেশি বসবাসযোগ্য। আমরা সকলেই জানি, পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণী বাস করতে পারে না। এখন বলা হচ্ছে যে, মঙ্গলগ্রহে পানি আছে। আর সেই পানির অস্তিত্বই বিজ্ঞানীদের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করছে যে, মঙ্গলগ্রহে হয়তো মানুষের অস্তিত্ব আছে। এখন অন্য একটি প্রসঙ্গ দিয়ে শেষ করবো। আমার নিজের কাছেই ছোটবেলা থেকে প্রশ্ন: কত হাজার বা কত লক্ষ বছর আগে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে? এই প্রশ্নের সঠিক জবাব বা হিসাব এখন পর্যন্ত অনুসন্ধান করেও পাইনি। এই হাজার বা লক্ষ লক্ষ বছরে কোটি কোটি মানুষ মারা গেছে এবং কোটি কোটি মানুষ জন্ম নিচ্ছে। যারা মারা যাচ্ছে তারা রোজ হাশরে পুনরুজ্জীবিত হবে। কোথায় হবে? এটি কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমরা অতি সাধারণ মানুষ বলি, আল্লাহর দুনিয়ায় জায়গার অভাব নাই। এই জায়গাটি শুধুমাত্র আমাদের এই সুন্দর গ্রহ, পৃথিবী নয়। আল্লাহর দুনিয়া বলতে বোঝায় এই মহাবিশ^- চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা-রবি-শশি। আমি ধর্ম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখি না। তবে ইংরেজিতে কোরআন শরীফ একাধিক বার পড়েছি এবং অনেক স্থানে মার্কার দিয়ে দাগিয়েছি। আমার মনে বিভিন্ন সময় যেসব প্রশ্নের উদয় ঘটে সেগুলোর কয়েকটির উত্তর আমি আমার মহাবিশ^ সংক্রান্ত ফাইলে পেয়েছি। কিন্তু এ সম্পর্কে আমি কনক্লুসিভ বা চূড়ান্ত কিছু বলবো না। বলতে গেলে ধর্ম ছাড়াও ফিজিক্স এবং অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ওপর রীতিমত মাস্টারি থাকতে হবে। এসম্পর্কে যারা আরো জানতে চান তাদের কাছে আমি একটি ভিডিও দেখার সুপারিশ করবো। ভিডিওটির নাম অষষধয ধহফ ঃযব ঈড়ংসড়ং অর্থাৎ ‘আল্লাহ ও মহাবিশ^’। আপাতত ৭টি পর্বে এটি পাওয়া যাচ্ছে। ইউটিউবে সার্চ করলেই পাবেন। ইংরেজি ভাষায় বর্ণিত এই ভিডিওটি আমি বাংলা করছি। শেষ হলে এসম্পর্কেও কিছু লিখবো ইনশাআল্লাহ। Email: journalist15@gmail.com