সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৩১ অপরাহ্ন

নিপাহ ভাইরাস আতঙ্কে দেশ: মৃত্যুহার ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে নিপাহ ভাইরাস। এর প্রধান বাহক বাদুড়। শীত মৌসুমে খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া কেন্দ্র করে বাড়ছে এ রোগের প্রাদুর্ভাব। বাদুড়ে খাওয়া ফল খেলেও শরীরে বাসা বাঁধতে পারে এ ভাইরাস। সংক্রামক এ রোগের মৃত্যুহার ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ। চলতি বছর আক্রান্ত ১০ জনের মধ্যে মারা গেছেন সাতজন। তাই আধ-খাওয়া ফল পরিহারের পাশাপাশি যে কোনো উপায়ে সংগ্রহ করা খেজুরের কাঁচা রস খেতে মানা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিপাহ ভাইরাস রোগের লক্ষণ সবার ক্ষেত্রে একরকম হয় না। কখনো কখনো কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে। সাধারণভাবে খেজুরের কাঁচা রস পান করা, বাদুড়ের আংশিক খাওয়া ফল খাওয়া অথবা নিপাহ ভাইরাস রোগে আক্রান্ত পশু বা ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার দুই সপ্তাহের মধ্যে মৃদু থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট, জ্বরসহ মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, খিঁচুনি, প্রলাপ বকা, অজ্ঞান হওয়ার মতো লক্ষণ থাকলে নিপাহ ভাইরাস রোগ বলে সন্দেহ করা যেতে পারে।
তবে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন জাগো নিউজকে জানান, মালয়েশিয়ায় শূকরের দেহে এই ভাইরাস পাওয়া গেলেও এখন পর্যন্ত দেশে কোনো পশুর শরীরে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণের ঘটনা পাওয়া যায়নি। দেশে এখন পর্যন্ত খেজুরের রস থেকেই সংক্রমণের ঘটনা বেশি। তবে বাংলাদেশে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশের ২৮ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে নিপাহ ভাইরাস।
আইইডিসিআরের তথ্যমতে, দেশে চলতি বছরের প্রথম মাসেই ছয় জেলায় ১০ জনের শরীরে প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন সাতজন। গত জানুয়ারিতে নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্তের এ সংখ্যা আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর মৃত্যু বিবেচনায় চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ বছর রাজশাহী, নওগাঁ, পাবনা, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ঢাকা ও নাটোরে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেলেও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সারাদেশেই এই ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে বলে জানান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশে গত ২২ বছরে ৩৩ জেলায় এ ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এসব জেলাকে এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে। তাই হাসপাতালে জ্বর নিয়ে আসা রোগীদের সেবা দেওয়ার সময় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে চিকিৎসকদের।
আইইডিসিআরের পরিসংখ্যান বলছে, নিপাহ ভাইরাসে ২০০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ৩৩৫ ব্যক্তি সংক্রমিত হয়েছেন। মারা গেছেন ২৩৫ জন। চলতি বছরের প্রথম মাসেই শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ। অথচ ২০২২ সালে সারাবছরে তিনজন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে দুজন মারা যান। ২০২১ সালে দুজন, ২০২০ সালে সাতজন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে মারা যান পাঁচজন। ২০১৯ সালে আটজন শনাক্ত হন, মারা যান সাতজন। ২০১৮ সালে চারজন শনাক্ত হন, দুজন মারা যান। ২০১৭ সালে তিনজন শনাক্ত হন। তাদের মধ্যে দুজন মারা যান। ২০১৬ সালে শনাক্ত পাওয়া যায়নি। ২০১৫ সালে ১৫ জন শনাক্ত হন। মারা যান ১১ জন। এর আগে দেশে সর্বোচ্চ নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ২০১১ সালে। ওই বছরে ৪৩ জন শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে মারা যান ৩৭ জন।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, কোনো জায়গায় একবার নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেলে ওই স্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। কারণ, যেখানে নিপাহ ভাইরাসের রোগী পাওয়া যায়, সেখানে বাদুড়ও থেকে যায়, খেজুরের রসও থাকে। দেশের প্রায় সব এলাকাই নিপাহ ভাইরাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু যেসব জেলায় রোগী পাওয়া গেছে, সেখানে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এর মধ্যে সেসব এলাকার চিকিৎসকদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। ব্যানার, ফেস্টুন করা হয়েছে সতর্কতার জন্য।
তিনি বলেন, এই রোগীদের চিকিৎসায় কোনো আলাদাভাবে প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। আর এই রোগ ব্রেনে সংক্রমণ ছড়ায় বলে জটিল আকার ধারণ করে। এই রোগীদের যত দ্রুত সম্ভব লাইফ সাপোর্টে নেওয়া যাবে তত সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত যেসব চিকিৎসক ব্রেন বিশেষজ্ঞ তারা প্রথমে ওষুধ দিয়ে রোগীকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করেন। তবে রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে লাইফ সাপোর্টে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়।
আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন জাগো নিউজকে বলেন, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর যদি কেউ বেঁচেও যান, তবুও তার শরীরে নানান ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার শুধু একটাই উপায়, তা হলো খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া বন্ধ করা। এটা করতে পারলেই কেবল আমরা ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারবো।
‘অনেকেই বলেন, সতর্কতা অবলম্বন করে খেঁজুরের রস সংগ্রহ করছেন তারা। এটা কিন্তু ভুল কথা। কারণ বাদুড়ের মুখ দিয়েই শুধু নয়, এর ইউরিন থেকেও এটা (নিপাহ ভাইরাস) ছড়াতে থাকে। অনেকে জাল দিয়ে ঢেকে রাখেন, যাতে বাদুড় মুখ দিতে পারে না। কিন্তু ইউরিন তো আর তাতে আটকাচ্ছে না। তাই খেজুরের কাঁচা রস পানে আক্রান্তের আশঙ্কা সব সময়ই থেকে যাচ্ছে।’
ঢাকা শহর, ফেনী জেলাসহ সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় নিপাহ ভাইরাসের সচেতনতামূলক ব্যানার, ফেস্টুন ও এলইডি স্ক্রিনে বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে।
এদিকে নিপাহ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ঢাকার মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ২০টি শয্যা প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম শফিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা পেয়ে নারী ও পুরুষ আলাদা করে ১৬টি সাধারণ শয্যা ও ১৭টি আইসিইউ শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের হাসপাতালে ৩৩টি শয্যা প্রস্তুত। এর মধ্যে সন্দেহভাজন দুজন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
জানা যায়, নিপাহ ভাইরাস রোগের প্রথম প্রাদুর্ভাব ১৯৯৮ অথবা ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ার সুঙ্গাই নিপাহ নামক গ্রামে দেখা দেয়। এই গ্রামের নামেই ভাইরাসটির নামকরণ। সব বাদুড়ই এই ভাইরাসের বাহক নয়। তবে যেসব বাদুড় ফল খায় তারাই এই ভাইরাসের বাহক হয়। এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাস রোগের কোনো টিকা এবং সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। এই রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সতর্কতা এবং সচেতনতাই একমাত্র উপায়।-জাগোনিউজ২৪.কম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com