শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০০ পূর্বাহ্ন

জামাতবদ্ধ দাওয়াত

ড. মাহফুজুর রহমান :
  • আপডেট সময় বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

ব্যক্তিগতভাবে যেমন প্রত্যেক মুমিনকে তার সামনে কোনো অন্যায় হতে থাকলে তাতে বাধা দিতে হবে, অন্যায়ের প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে হবে; তেমনিভাবে সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করার জন্য অর্থাৎ দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করার জন্য মুসলমানদের মধ্যে এমন একটি দলও থাকতে হবে যারা সর্বক্ষণ দাওয়াতি কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখবে। যারা উম্মতের হেদায়াতের দরদ নিয়ে তাদের কাছে পূর্ণ ইসলামের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দেবে। এ রকম একটি দল মুসলমানদের মধ্যে থাকা আবশ্যক। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি দাওয়াত দেবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই হবে সফলকাম।’ (সূরা আলে ইমরান-১০৪) আলোচ্য আয়াতে ‘খাইর’ বা কল্যাণ বলতে বোঝানো হয়েছে ইসলামকে। কারণ ইসলামের সব আকিদা, সব ইবাদত, সব শরিয়তের বিধান, সব শিক্ষা, সব নৈতিক বিষয় আল্ল‍াহ কর্তৃক মানুষের জন্য দেয়া কল্যাণ। এর সব কিছুতেই মানুষের কল্যাণ রয়েছে। মানুষের দুনিয়াবি কল্যাণ ও পরকালীন কল্যাণ রয়েছে।
ইমাম আবু জাফর তাবারি এ আয়াতের তাফসির ও ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে’ মানে তোমরা মুসলমানদের মধ্য থেকে। ‘উম্মাহ’ মানে একটি দল। ‘কল্যাণের দিকে দাওয়াত দেবে’ মানে আল্ল‍াহ মানুষের জন্য যে ইসলাম ও তার শরিয়তের বিধান দিয়েছেন সেই ইসলাম ও তার শরিয়তের বিধিবিধান পালনের জন্য দাওয়াত দেবে। ‘সৎকাজের আদেশ দেবে’ মানে মুহাম্মদ সা: আল্ল‍াহর পক্ষ থেকে যে দ্বীন নিয়ে এসেছেন তা পালনের জন্য আদেশ করবে। আর ‘মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে’ মানে আল্লাহর প্রতি কুফরি করতে ও মুহাম্মদ সা:-এর নবুওয়াত অস্বীকার করতে এবং তিনি আল্ল‍াহর পক্ষ থেকে যা নিষিদ্ধ ও অন্যায় বলে জানিয়েছেন তা করতে মুখে নিষেধ করবে। আর হাত ও শরীর দিয়ে জিহাদ করে নিষেধ করবে, যতক্ষণ না মানুষ তোমাদের আনুগত্য করে।’ (তাফসিরে তাবারি, খ–৭, পৃষ্ঠা ৯০-৯১ ) আল্লামা যামাখশারি এ আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে বলেন, ‘আলোচ্য আয়াতের ‘মিনকুম’-এর ‘মিন্-টি’ তাবয়িযিয়া; অর্থাৎ কিছুসংখ্যক বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত। সুতরাং আয়াতের অর্থ হবে তোমাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ থাকতে হবে যারা কল্যাণের দিকে দাওয়াত দেবে। কারণ সৎকাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা একটি ফরজে কেফায়া কাজ। তা কেবল ওই সব লোকেরাই করতে পারে যারা সৎকাজ ও মন্দ কাজ কোনটি জানে। আরো জানে কিভাবে সৎকাজের আদেশ করতে হয় এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতে হয়। কারণ, যে ব্যক্তি সৎকাজ ও মন্দ কাজ কোনটি তা জানে না; সে হয়তো না বুঝে সৎকাজ করতেই নিষেধ করবে, আর মন্দ ও খারাপ কাজ করতে আদেশ করবে। এমনও হতে পারে, সে তার নিজের মাজহাবের হুকুমটি জানে আর অপরের মাজহাবের হুকুম সম্পর্কে জানে না। তাই সে অপরের মাজহাবে মন্দ নয় বরং অনুমোদিত এমন কাজ করতেও নিষেধ করবে। আবার এমনও হতে পারে, যে বিষয়ে কঠোরতা আরোপের সুযোগ নেই সে বিষয়েই কঠোরতা আরোপ করছে। আর যে বিষয়ে কঠোরতা আরোপ করা আবশ্যক সে বিষয়ে নম্রতা অবলম্বন করছে। অথবা এমন মানুষকে নিষেধ করছে যাকে নিষেধ করলে সে তা আরো বেশি করে করবে। অথবা এমন মানুষকে নিষেধ করছে যাকে নিষেধ করা বৃথা।’ (যামাখশারি, আল কাশশাফ, প্রথম খ-, পৃষ্ঠা-৩৯৬)
আল্ল‍ামা কুরতুবি এ আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে বলেন, ‘আলোচ্য আয়াতের ‘মিনকুম’ কিছুসংখ্যক বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত। সুতরাং আয়াতের অর্থ হবে- তোমাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ থাকতে হবে যারা আলেম ও জ্ঞানী হবেন। সব মানুষ জ্ঞানী হয় না। আর কারো কারো মতে, ‘মিনকুম’ শব্দটি ‘জিনস’ বা শ্রেণী বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এর মানে হচ্ছে তোমাদের সব উম্মাহকেই কল্যাণের দাওয়াত দিতে হবে। (তিনি আরো বলেন) প্রথম অভিমতটিই অধিক সঠিক। কারণ তা প্রমাণ করে যে সৎকাজের আদেশ দান আর মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা ফরজে কেফায়া। কারণ আল্ল‍াহ তায়ালা যাদের ওপর দাওয়াত দান ফরজ তাদের দায়িত্ব তাঁর নিম্নোক্ত বাণী দিয়ে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ‘যাদেরকে আমি জমিনে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, জাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।’ (সূরা আল হজ-৪১)‘অথচ সব মানুষ ক্ষমতা লাভ করে না।’ (তাফসিরে কুরতুবি, খ–৪, পৃষ্ঠা-১৬৫)
উপরোক্ত আয়াত থেকে জানা যায়, যারা মুসলমানদের ক্ষমতা লাভ করবে তাদের ওপর দ্বীনের দাওয়াত দান বা দ্বীনের দাওয়াত দানের ব্যবস্থা করা ফরজ হবে। যেমন ফরজ নামাজ কায়েম করা ও জাকাত দানের ব্যবস্থা করাও ফরজ হয়। এটা ফরজ বলেই আবুবকর রা: তার খেলাফতকালে যারা জাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে জাকাত আদায় করতে বাধ্য করেছিলেন। মোট কথা : পূর্ণ ইসলামের দাওয়াত দান সব মুসলমানের ওপর ফরজ নয়। তবে সরকারকে মুসলমানদের মধ্য থেকে এমন একটি দল গঠন করতে হবে যারা সর্বক্ষণ নিজেদের পূর্ণ ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য নিয়োজিত রাখবে। আর যদি দাওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য সরকার একটি দাওয়াতি দল গঠন না করে; তবে মুসলমানদের নিজেদের মধ্য থেকে একটি দাওয়াতি দল গঠন করে নিতে হবে। যে দলটি নিজেদের ইসলামের দাওয়াত দানের জন্য ব্যস্ত রাখবে। অবশ্য কারো সামনে যখন কোনো অন্যায় ও খারাপ কাজ হতে থাকে তখন তার ওপর ব্যক্তিগতভাবে সে কাজে বাধাদান ও নিষেধ করা ফরজ হয়ে পড়ে। লেখক : ইসলামিক স্কলার ও অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com