সিএনসির নির্বাহী পরিচালক কবি ও কথাসাহিত্যিক মাহবুবুল হক বলেছেন, দেশ ও জাতির সামনে সত্য ঘটনা তুলে ধরা সাংবাদিকদের দায়িত্ব। কিন্তু গোষ্ঠি স্বার্থ, রাজনৈতিক প্রভাব, অদক্ষতা, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কারণে অনেক সাংবাদিক যথায়থভাবে সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাদের সেই ব্যর্থতার কারণে ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও গোটা বিশ্ব আজ মহা সঙ্কটে। তিনি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ন্যাশনাল কালচার আয়োজিত সিএনসি’র লাইভ আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে এ কথা বলেন। ইসমাইল হোসেনের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক হারুন ইবনে শাহাদাত।
হারুন ইবনে শাহাদাত বলেন, সাংবাদিক অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে মানবাধিকার রক্ষার প্রত্যয়ে কাজ করেন। অনেক সীমাবব্ধতাও আছে। তবে আশার কথা দেশে সৎ ও যোগ্য অনেক সাংবাদিক আছেন, যারা কোন কিছুর বিনিময়েই বিক্রি হন না। তারা আজীবন উন্নত আদর্শকে ধারণ করে পথ চলেন। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, তারাও মানুষ। ভুল তাদেরকেও হতে পারে। নানান সীমাবব্ধতার কারণে ভুল হতে পারে। অসর্তকতার কারণে হতে পারে। হলুদ সাংবাদিকতা আর ভুল সাংবাদিকতা এক জিনিস নয়। ইচ্ছে করে কোন স্বার্থের লোভে কিংবা মিডিয়ার প্রচার বাড়ানোর জন্য বিভ্রান্ত ছড়ানো হলো হলুদ সাংবাদিকতা। কিন্তু অসর্তকতা কিংবা অন্য কোন সীমাবব্ধতার কারণে কোন ভুল তথ্য প্রচার হয়ে গেলে একজন সৎ সাংবাদিক সাথে সাথে নিজের ভুল স্বীকার করে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেন। তবে অবশ্যই সদা সতর্ক থাকবে হবে যেন এমন ভুল না হয়।
তিনি হলুদ সাংবাদিতকতার ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, হলুদ সাংবাদিকতার জন্ম হয়েছিল সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম দুই ব্যক্তিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম রুডলফ হার্স্টের মধ্যে পেশাগত প্রতিযোগিতার ফল হিসেবে। ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ শব্দটি আতঙ্কের হলেও এর পেছনে রয়েছে মজার এক ইতিহাস। সোনায় যেমন খাদ থাকে, তেমনি সাংবাদিকতা পেশাতেও আছে অপসাংবাদিকতা। এসব অতিক্রম করে অসির চেয়ে মসির শক্তি বেশি এ কথা বারবার প্রমাণ করেছেন সাংবাদিকরা। সাংবাদিকতা শুধু একটি পেশা নয়, এতে রয়েছে আবেগ, আদর্শ ও দেশপ্রেমের সম্ভার। সাংবাদিকতায় ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা শব্দটি এসেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। দুই ভুবন বিখ্যাত সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম হার্স্টের এক অশুভ প্রতিযোগিতার ফসল আজকের এই ‘হলুদ সাংবাদিকতা’।
হারুন ইবনে শাহাদাত আরো বলেন, ১৮৮৩ সালে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড নামে একটি সংবাদপত্র কিনেন প্রখ্যাত সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজার। পত্রিকাটির আগের মালিক ছিলেন জে গোল্ড। অন্যদিকে উইলিয়াম হার্স্ট ১৮৮২ সালে ‘দ্য জার্নাল’ নামে একটা পত্রিকা কিনে নেন জোসেফ পুলিৎজারের ভাই অ্যালবার্ট পুলিৎজারের কাছ থেকে। কিন্তু পরিবারের সদস্যের পত্রিকা হার্স্টের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টিকে সহজ ভাবে নিতে পারেন নি পুলিৎজার। শুরু হয় হার্স্টের সাথে পুলিৎজারের স্নায়ুযুদ্ধ। পুলিৎজার নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড কিনেই ঝুঁকে পড়লেন চাঞ্চল্যকর খবর, চটকদারি সংবাদ ইত্যাদি প্রকাশে। রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্ট নামে একজন কার্টুনিস্টকে চাকরি দিলেন তার কাগজে। ওই কার্টুনিস্ট ‘ইয়েলো কিড’ বা ‘হলুদ বালক’ নামে প্রতিদিন নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের প্রথম পাতায় একটি কার্টুন আঁকতেন এবং তার মাধ্যমে সামাজিক অসংগতি থেকে শুরু করে এমন অনেক কিছু বলিয়ে নিতেন, যা ছিল অনেকটাই পক্ষপাতদুষ্ট। এক সময় হার্স্ট পুলিৎজারের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের কার্টুনিস্ট রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্টকে অধিক বেতনের প্রলোভনে নিয়ে এলেন তার ‘জার্নাল’ পত্রিকায়। হার্স্ট তাতেই ক্ষান্ত থাকেননি, মোটা বেতনের লোভ দেখিয়ে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের ভালো সব সাংবাদিককেও টেনে নেন নিজের পত্রিকায়। বেচারা পুলিৎজার রেগে আগুন। তিনি অগত্যা জর্জ চি লুকস নামে আরেক কাটুনিস্টকে নিয়োগ দেন। এদিকে জার্নাল, ওদিকে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড দুটো পত্রিকাতেই ছাপা হতে লাগলো ইয়োলো কিডস বা হলুদ বালক কার্টুন। শুরু হয়ে গেলো পত্রিকার কাটতি নিয়ে দুটো পত্রিকার মধ্যে দ্বন্দ্ব। জার্নাল এবং নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের বিরোধ সে সময়কার সংবাদপত্র পাঠকদের কাছে ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলো। দুটো পত্রিকাই তাদের হিট বাড়ানোর জন্য ভিত্তিহীন, সত্য, অর্ধসত্য ব্যক্তিগত কেলেংকারিমূলক খবর ছাপা শুরু করলো। এতে দুটো পত্রিকাই তাদের মান হারালো। তৈরী হলো একটি নষ্ট মানসিকাতর পাঠকশ্রেণি, যারা সব সময় চটকদার, ভিত্তিহীন, চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী, অর্ধ-সত্য সংবাদ প্রত্যাশা করতো এবং তা পড়ে তৃপ্তি পেতো। এভাবেই জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম হার্স্ট দু’জনেই হলুদ সাংবাদিকতার দায়ে অভিযুক্ত এবং ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছেন।