শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:৫৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে ভারতীয় সাপ্তাহিকের প্রতিবেদন খণ্ডন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের নিউ ইয়র্ক পুলিশের ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পেয়েছেন সিলেটের আব্দুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের সাথে মির্জা ফখরুলের বৈঠক বিভাজিত হওয়ায় আমাদের শিক্ষা বিশ্বমানের হয়নি : মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন হোয়াইট হাউসের কাছে বিমান দুর্ঘটনায় ষড়যন্ত্র দেখছেন ট্রাম্প শ্রমিক ঘাটতি পূরণে ইন্টার্নশিপ কতটা সহায়ক হতে পারে? হরতাল হবে না, মানুষ আওয়ামী লীগের শাস্তির অপেক্ষা করছে: রিজভী আ’লীগের প্রতি আচরণ তেমন হওয়া উচিত, গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে যেমন আমাদের সাথে করা হতো: হাসনাত আব্দুল্লাহ নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণে তিন বিষয়কে গুরুত্ব দেবে ইসি নাইম শেখের সেঞ্চুরি, খুলনার রান পাহাড়

বস্তি থেকে ফ্ল্যাটে উঠেও কেন তারা সুখী নয়

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

ফ্ল্যাটের ভাড়া বেশি নয়; তবে সার্ভিস চার্জ আর গ্যাস সিলিন্ডারের দাম চাপ হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ ভেবেছিলেন, বরাদ্দ মিলবে স্থায়ীভাবে। কিন্তু এখন খরচ পড়ে যাচ্ছে ১০ হাজার টাকা। বরিশালের বাদুল বেগম ৫৫ বছরের জীবনের ৩০ বছর কাটিয়েছেন মিরপুর-১১ এর বাউনিয়াবাঁধ এলাকার কলাবাগান বস্তিতে। মাঝে হারিয়েছেন ছেলে আর ছেলের বউকে। এখন নাতি আর নাতবউ নিয়ে দিন কাটছে তার।
তার মত মানুষদের মানসম্মত আবাসন নিশ্চিত করতে বাউনিয়া বাঁধের স্লুইসগেট এলাকায় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ যে পাঁচটি বহুতল ভবন নির্মাণ করছে, তার মধ্যে নির্মাণ শেষ হয়েছে তিনটির। ৫৩৩টি ফ্ল্যাটের মধ্যে পুরোপুরি প্রস্তুত ৩০০টি। এতদিন বস্তিতে থাকা ৩০০ জনকে বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের ৩ অগাস্ট ফ্ল্যাটগুলো হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই শয়নকক্ষ, একটি রান্নাঘর একটি টয়লেট রয়েছে প্রতিটি ফ্ল্যাটে। প্রতিটি ভবনে রয়েছে কমিউনিটি হল, দুটি লিফট ও প্রশস্ত সিঁড়ি, অগ্নিনির্বাপণ ও সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা; আছে জেনারেটর, বিদ্যুতের সাব-স্টেশন, প্রশস্ত ওয়াকওয়ে ও সৌন্দর্য্যবর্ধনের জন্য লাইটিংয়ের ব্যবস্থা। সরকার আশা করেছিল, বস্তির সুযোগসুবিধাহীন কষ্টকর জীবন ফেলে এখানে আসতে আগ্রহী হবে শ্রমজীবী মানুষেরা। কিন্তু হচ্ছে উল্টোটা। ফ্ল্যাটের বরাদ্দ পেয়েও বাদুল বেগম কেন সুযোগ সুবিধাহীন বস্তিতে থাকছেন?
এই পশ্নে তিনি বললেন, “পাঁচ নম্বর বিল্ডিংয়ের ১২ তালায় ফ্ল্যাট পাইয়া নয় হাজার ট্যাকা জামানত দিয়া রাখছি। কিন্তু উঠলেই তো ভাড়া দেওন লাগব। আবার গ্যাস-কারেন্ট-পানির বিল সব মিলাইয়া ১০ হাজার পইড়া যাব।
বাসিন্দারা বলছেন, ভাড়া সাড়ে চার হাজার টাকা হলেও সব মিলিয়ে ১০ হাজার টাকা পড়ে যায় তাদের।
“আমার এহন স্বাস্থ্য নাই। বাসাবাড়িত কাম করতে পারি না। নাতির একলার ইনকাম। আমি পইড়া না থাকলে কিছু ইনকাম করলে উঠতে পারতাম। ফ্ল্যাট পাইসি, তয় খরচ দেওয়ার সামর্থ্য আমার নাই। তাই উঠতাছি না।” ভাড়া সাড়ে চার হাজার টাকা হলেও সব মিলিয়ে ১০ হাজার টাকা পড়ে যাওয়ার কারণের খোঁজ নিতে গিয়ে উঠে এলে বিদ্যুৎ, পানি আর গ্যাসের সিলিন্ডারের দামের বিষয়টি। কিন্তু যে বস্তিতে বাদুল বেগম থাকেন, সেখানেও এই তিন খাতে তার খরচ সমানই বলা চলে। তাহলে কেন তিন চাপ অনুভব করছেন? এই প্রশ্নে উঠে এলো নিরাপত্তা, লিফট আর কমন বিদ্যুৎ বিলের বিষয়টি। এই তিন খাতে খরচ হবে দেড় হাজার টাকা। কেউ কেউ বলছেন, বস্তিতে তারা এটা ওটা কুড়িয়ে রান্না করে ফেলেন। কিন্তু ফ্ল্যাটে সেটা সম্ভব নয়। এখানে সিলিন্ডারের গ্যাস না থাকলে রান্না অসম্ভব। আর এখন সিলিন্ডারের যে দাম, তা তাদের মত মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন।
আরও একটি বিষয় জানা গেল, সেটি হল এই নারী যে বস্তিতে থাকেন, সেখানে তাকে কোনো ভাড়া দিতে হয় না। কেবল তিনি না, এই আবাসনে যাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাদের সবাই বিনা ভাড়ায় বস্তিতে থাকেন বছরের পর বছর ধরে।
বিনা ভাড়ায় কীভাবে: বাউনিয়াবাঁধের কলাবাগান বস্তি ছেড়ে ফ্ল্যাটে ওঠা মিজানুর রহমান জানান, এরশাদের আমলে এক খ্রিস্টান পাদ্রী বাউনিয়া বাঁধের এসব জায়গায় ঘরে তুলে সেগুলো ভাসমান, নিঃস্ব মানুষকে দিয়েছিলেন। সেখানে যে যেমন পারে তেমন ঘর তুলে এতদিন থেকে আসছিল। কোনো ভাড়া দিতে হত না। পাদ্রীর জমিদানের বিষয়টি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। তবে ওই এলাকায় যেসব বস্তি ছিল সেখানকার ভাড়ার ভিত্তিতে ফ্ল্যাটে পুনর্বাসিত অন্তত ১০ জন বাসিন্দা বস্তিতে বিনা খরচে এতদিন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এদের একজন মোছাম্মৎ রুমা। তিনি বলেন, “বস্তিতে তো কোনো ভাড়া দেওয়া লাগত না। নিজের ঘর আছিল সেখানে, এখন ভাড়ায় আইছি। যে টাকা কামাই করি তা ভাড়ায় চইলা যায়।” কলাবাগান বস্তিতে থাকা রুবিয়া খাতুন জানান, যে জমিতে ঘর তৈরি করে থাকছেন, সেখানে পানি উঠলে পা কাদায় ঢুকে যায়, তবে কোনো ভাড়া লাগে না। কষ্ট করে সেখানে থাকার আরও একটি কারণ হল, তার ছোট ছেলে ফ্ল্যাট পেলেও বড় ছেলে পাননি।
ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য আবেদন ‘ভুল ভেবে’: ফ্ল্যাটের বরাদ্দ পাওয়া মোছাম্মৎ রুমা বললেন, “ভাড়া-খরচ মিলাইয়া ১০ হাজার টাকা পইড়া যায়। এই টাকা দিয়া আগে সংসার চালাইছি, পোলাপান পড়াইছি। এখন কিছুই করতে পারি না। চার বাচ্চার একটারেও এবার স্কুলে দিতে পারি নাই।”
গার্মেন্টসে কাজ করে মেয়ের পাওয়া নয় হাজার টাকাই মাসিক আয় মোমেলা বেগমের সংসারের। তিনি বলেন, “মেয়ের ইনকামের চেয়ে খরচ বেশি। স্বামীও নাই। উঠে গেছি এখন তো নামারও উপায় নাই।”
সাবিনা বেগম বলেন, “আগে আছিল নিজের ঘর, আর এহন হইছি ভাড়াটিয়া। বস্তিতে ছিলাম রোদে পুড়ছি, ঘরে বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু না খাইয়া ছিলাম না। আগে সপ্তাহে এক পোয়া-আধা কেজি গোছ (মাংস) খাইছি, চাল কিনছি বস্তায়, এহন গোছও পাইনা আর চাল কিনি কেজি হিসাবে।”
লালমতি বেগম বলেন, “এক বোতল গ্যাস আনতে এইহানে দুই হাজার ট্যাকা লাগে। বস্তিতে লাকড়ি, ভূষি কিছু একটা দিয়ে রানছি, এখানে তো তা করা যাবে না। গ্যাস নাই, রান্না বন্ধ হয়ে আছে।” ফ্ল্যাটে উঠে সবার এত অভিযোগ, তাহলে তারা বরাদ্দের জন্য আবেদন কেন করেছেন- এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা গেল ‘পুনর্বাসন’ শব্দটি নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ার বিষয়টি। ফ্ল্যাটের ওঠা পরিবারগুলো বলছে, সরকারি কর্মকর্তারা প্রথমে বলেছিলেন ‘পুনর্বাসন’ করা হবে। যে কারণে তারা ভেবেছিলেন ফ্ল্যাট স্থায়ীভাবে বরাদ্দ পাবেন। পরে জেনেছেন, এসব ফ্ল্যাটে ভাড়ায় থাকতে হবে তাদের। আর এখন তাদের বলা হচ্ছে, ভাড়ার সঙ্গে বিভিন্ন সেবার খরচও বহন করতে হবে। এই পুনর্বাসন শব্দটি কিন্তু সরকারের নথিপত্রের কোথাও নেই। এটির কাগজে কলমে নাম ‘ঢাকার মিরপুরস্থ সেকশন–১১ এ বস্তিবাসীদের জন্য ভাড়াভিত্তিক ৫৩৩ টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প।’
তাহলে ‘পুনর্বাসন’ শব্দটি বস্তিবাসীদের মাথায় কীভাবে ঢুকল? এই প্রশ্নের খোঁজ নিতে গিয়ে নানা পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেল, তাদেরকে বস্তি ছেড়ে ফ্ল্যাটে ওঠার বিষয়টি সহজে বোঝাতে গিয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ‘পুনর্বাসন’ এর কথা বলে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেন। এরপরই বিষয়টি ছড়িয়ে যায়। ফ্ল্যাট পাওয়া সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেন বলেন, “আমাদের তো পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছিল। অথচ আমরা এখন ভাড়ায় থাকছি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও যদি ভাড়ায় থাকতে হয়, তাহলে এই ফ্ল্যাট পেয়ে কী লাভ?” তিনি বলেন, “আমরা হিসাব করে দেখেছি একটা পরিবারের মাসিক ইনকাম ৩০ হাজার টাকা না হলে এই ফ্ল্যাটে থাকা মুশকিল।” চার নম্বর ভবনের দোতলায় থাকেন মিজানুর রহমান। এক কক্ষে তিনি থাকেন, আরেক কক্ষে বসিয়েছেন এমব্রয়ডারির মেশিন।
মিজানুর বলেন, “বস্তিতে ছিলাম, এখন ফ্ল্যাটে উঠেছি। কিন্তু আয় তো বাড়ে নাই। এখনই লাগে প্রায় ১০ হাজার। এখনও পয়পরিষ্কারের লোক আসে নাই। তারা আসলে তো সার্ভিস চার্জ আরও বাড়বে। এই টাকা দিয়ে কয়দিন আসলে থাকা যাবে সেটাই এখন বিষয়।” ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়া মহসিন ব্যাপারী বলেন, “যে কোনো একটা করে দেক। হয় তারা বিলগুলো নেক, নয় ভাড়া নেক। অথবা আমাদের বলে দিক, কিস্তিতে এসব ফ্ল্যাট নিতে হবে। আমরা মাগনা তো চাইতেছি না। এখানে সবাই নি¤œ আয়ের মানুষ, এত ব্যয় দেওয়া তো সম্ভব না। এর থেকে তো ওখানেই ভালো ছিলাম।”
ফ্ল্যাটের বরাদ্দপ্রাপ্তদের এসব প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ঢাকা অ ল-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী জোয়ারদার তাবেদুন নবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “এসব ফ্ল্যাট পুনর্বাসন হিসেবে পাওয়ার কোনো কথা ছিল না। সরকারি নথিতেও কোথাও এই শব্দটি নেই। “আর পুনর্বাসনের কথা উঠলে তা ভুল। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এসব ফ্ল্যাটে তারা ভাড়া দিয়েই থাকবে। যেদিন তারা ফ্ল্যাট পেয়েছেন সেদিনই তিনি বলে দিয়েছেন, তারা কাজ করবে। দৈনিক, সাপ্তাহিক বা মাসিক যে কোনো হিসাবে তারা ভাড়া দিতে পারে। “যতদিন তারা ভাড়া দিতে পারবে ততদিনই তারা সেখানে থাকবে। টানা তিন মাস কেউ ভাড়া দিতে না পারলে তার ভাড়াপত্র বাতিল হবে।”
ভাড়া আগে ছিল বেশি, পড়ে কমানো হয়েছে: ভাড়ার সঙ্গে বিল প্রসঙ্গে তাবেদুন নবী বলেন, “এটি নির্ধারিত আগে থেকেই। প্রথমে ভাড়া ছিল সাড়ে সাত হাজার, পরে তা কমিয়ে সাড়ে চার হাজারে আনা হয়েছে। বস্তিতে তারা দুই কক্ষে চার হাজার টাকা ভাড়া দিত। এখানে তো আরেকটু উন্নত জীবন। এর বাইরে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি যে যেমন ব্যবহার করবে তার বিল তো তাকে দিতেই হবে। সঙ্গে কমন বিল হিসেবে ১৪০০ টাকা দিতে হবে।” বিনামূল্যে যদি থাকতে দেওয়া হয়, তাহলে এটি বিপত্তি তৈরি করবে বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “এটা হলে গ্রাম থেকে মানুষ ঢাকায় আসা শুরু করবে ফ্ল্যাট পাওয়ার আশায়, ঘনবসতি তৈরি হবে। চাপ সামলানো কঠিন হবে। আমরা আশা করি যেন ঢাকায় আর নতুন করে বস্তি তৈরি না হয়। সরকার বলেছে, তোমরা গ্রামে ফিরে গেলে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাবে, ছয় মাসের খাবার পাবে।”- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com