দেশের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। তালিকা অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯১ লাখ ৫১ হাজার ৪৪০ জন। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৬ কোটি ০৪ লাখ ৪৫ হাজার ৭২৪ জন, মহিলা ভোটার ৫ কোটি ৮৭ লাখ ০৪ হাজার ৮৭৯ জন এবং হিজড়া ভোটার ৮৩৭ জন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে জাতীয় ভোটার দিবস উপলক্ষে নির্বাচন কমিশন থেকে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়।
২০২২ সালের ২ মার্চ মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ১০। এর মধ্যে পুরুষ ছিল ৫ কোটি ৭৬ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৯ জন; নারী ছিল ৫ কোটি ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ২৭ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গ (হিজড়া) ছিল ৪৫৪ জন। ২০২২ সালের ২ মার্চ থেকে ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। তাতে নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্ত হয় ৭৯ লাখ ৮৩ হাজার ২৭৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪০ লাখ ৭২ হাজার ৪৫৫ জন; নারী ৩৯ লাখ ১০ হাজার ৪৩৯ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গ (হিজড়া) ৩৮৩ জন। একই সময়ে রিভাইজিং অথরিটির যাচাই-বাছাইয়ে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ৯০ হাজার ২৮২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬২ হাজার ৬১২ জন এবং নারী ২৭ হাজার ৬৭০ জন।
২০২২ সালের হালনাগাদে নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্ত হয় ৮০ লাখ ৭৩ হাজার ৫৫৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪১ লাখ ৩৫ হাজার ৬৭ জন; নারী ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ১০৯ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গ (হিজড়া) ৩৮৩ জন। একই সময়ে ভোটার কর্তন করা হয় মোট ২২ লাখ ৯ হাজার ১২৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১৩ লাখ ৭৮ হাজার ৮৭২ জন এবং নারী ৮ লাখ ৩০ হাজার ২৫৭ জন। এ বছর ভোটার বাড়ার সংখ্যা ৫৮ লাখ ৬৪ হাজার ৪৩০; ভোটার বাড়ার হার ৫.১৮ শতাংশ। এর আগে, ভোটার দিবস উপলক্ষে আগারগাঁও নির্বাচন ভবন থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে একটি র্যালি বের হয়। এ সময় অন্য নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ঢাকা জেলাসহ বিভিন্ন অ লের নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা যোগ দেন।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ‘জাতীয় নির্বাচনে যে কারণে পোস্টাল ব্যালট চালু করা দরকার’ শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে মতামত ব্যক্ত করেছেন। গুরুত্ব বিবেচনায় দৈনিক খবরপত্রের পাঠকদের জন্য তার লেখা মতামত তুল ধরা হলো:‘ভোটের দিন শারীরিকভাবে সরাসরি ভোটদানে অসমর্থ ভোটাররা আগে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করে তা ডাকযোগে প্রেরণ করে যে ভোটদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন, তাকে পোস্টাল ব্যালট বলা হয়। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর একটি সময়সীমার মধ্যে ভোটারদের পোস্টাল ব্যালটের অপশনটি দেওয়া হয়। যাঁরা সরাসরি ভোটকেন্দ্রে না এসে ডাকযোগে বা নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত অনলাইন বা ম্যানুয়েল পন্থায় ভোট দিতে আগ্রহী, তাঁদের পৃথক একটি নিবন্ধন করা হয়। এই নিবন্ধিত ভোটাররা ভোটের সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করে কমিশন নির্ধারিত একটি ফরমে অগ্রিম ভোট দান করতে পারেন।
দেশে দেশে পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি: পোস্টাল ব্যালট বা দূর-ভোটদানের পদ্ধতি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হচ্ছে। কারণগুলো—১. আজকাল জীবন-জীবিকা ও নানা পেশাগত কারণে মানুষ তার স্থায়ী ঠিকানা বা বাসস্থানের বাইরে থাকছে। যার ফলে ভোটের দিন অনেকের পক্ষে সশরীর উপস্থিত হয়ে ভোটদান সম্ভব হয় না।
২. বাংলাদেশে অনুপস্থিত ভোটারদের একটি বড় অংশ এনআরবি বা প্রবাসী শ্রমিক, যাঁদের পক্ষে কেন্দ্রে এসে ভোটদান সম্ভব নয়, ৩. অনেকের বয়স, শারীরিক অসমর্থতা ও যাতায়াতের অসুবিধা সরাসরি ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
৪. ভোটকেন্দ্র সব সময় নিরাপদ জায়গা নয়। ভোটকেন্দ্রগুলোয় সন্ত্রাসের কারণে অনেকে কেন্দ্রের কাছাকাছি থেকেও কেন্দ্রমুখী হন না। ৫. বাংলাদেশে বিগত অন্তত দুটি নির্বাচনে মানুষ ভোটকেন্দ্রে গিয়েও নিজের ভোট নিজে দিতে পারেনি। তাই সব মিলিয়ে মানুষ ভোটকেন্দ্রবিমুখ হয়েছে।ভোটকেন্দ্রবিমুখ মানে নির্বাচন বা রাজনীতিবিমুখতা নয়। ওপরে উল্লিখিত পাঁচটি কারণের উপযুক্ত প্রতিকার হলে মানুষ তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগে উৎসাহিত হবেন। কুমিল্লার বিগত তিনটি সিটি নির্বাচনে (২০১২, ২০১৭ ও ২০২২) একটি বিশেষ এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির ওপর আমি একটি জরিপ পরিচালনা করি। মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ১ কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশি পৃথিবীর নানা দেশে কর্মরত। তা ছাড়া এ দেশের অনেক নাগরিক বিভিন্ন কারণে বিদেশে অবস্থান করেন, কিংবা দ্বৈত নাগরিক হিসেবে দেশের বাইরে থাকেন। নির্বাচনী আইন ও ব্যবস্থাপনাগত সীমাবদ্ধতায় তাঁরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না। এভাবে তাঁদের ভোটের বাইরে রাখা সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন করার শামিল। দেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকট প্রকট। এ সময়ে আমরা এনআরবি ও প্রবাসীর প্রেরিত অর্থের জন্য আহাজারি করি। কিন্তু প্রবাসীদের ভোটাধিকার সুরক্ষার ব্যাপারে উদাসীনতা ক্ষমার অযোগ্য।
ভোটের আগের দিন, ভোটের দিন এবং ভোটের পরের দিন নির্দিষ্ট কিছু বাড়ি ও পরিবারে গিয়ে তাঁদের কে কে সেন্টারে গেলেন, কারা গেলেন না, না গিয়ে থাকলে কেন এবং গিয়ে থাকলে কেন গেলেন—চারটি বিষয় জানার চেষ্টা করি। তিনটি নির্বাচনে ওই নির্দিষ্ট পরিবারগুলোর ভোটাচরণ একটি অভিন্ন রূপ নিয়েছে। ২০১২ সালে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে যাননি। তাঁদের কেউ কেউ ভোটের আগের দিন রাতে শহর ছেড়ে পিকনিকও করেছেন। ২০১২ সালে কুমিল্লা শহর ভোটের আগের দিন কেমন জানি ভুতুড়ে জনপদের মতো মনে হচ্ছিল। বিকেল থেকে শহর ফাঁকা হয়ে যায়। সর্বত্র একধরনের ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। কোটবাড়ি এলাকায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে র্যাব একটি বাড়ি অবরোধ করে রাখে। তাই পরদিন ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির মানুষের বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে যাননি। কোনো কোনো পরিবারের কম বয়সীরা কেন্দ্রে গেলেও বয়স্ক পুরুষ এবং সব বয়সের নারীরা কেন্দ্রমুখী হননি। ২০১৭ সালে কোনো ভীতিকর পরিস্থিতি ছিল না।
তবু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর পুরুষ ৬০ শতাংশ এবং নারীদের ৮০ শতাংশ কেন্দ্রবিমুখ ছিলেন। ২০২২ এর পরিস্থিতি ২০১৭–এর তুলনায় মারমুখী ও সংঘাতপূর্ণ থাকায় কেন্দ্রবিমুখতা বেড়ে যায়। অনেকে বাসায় অবস্থান করেও কেন্দ্রমুখী হননি। এটি মোট ভোটের ফলাফলেও প্রতিফলিত হয়েছে। ভুতুড়ে অবস্থার মধ্যেও ২০১২ সালে ৭২-৭৫ শতাংশ ভোট পড়ে। ২০১৭ সালে তা ৬২ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৫৭ শতাংশে এসে ঠেকে।কোনো বিশেষ এলাকার ভোট বিশ্লেষণ যদিও এ লেখার প্রতিপাদ্য নয়, তবু একটি পর্যবেক্ষণ এখানে প্রণিধানযোগ্য যে বাংলাদেশের সামাজিক শ্রেণিভিত্তিক ভোটারের অংশগ্রহণের কোনো বিশ্লেষণে নেই। বিশ্লেষণে দেখা যাবে, তুলনামূলকভাবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত লোকজনের চেয়ে নি¤œবিত্ত ও নি¤œবর্গের মানুষের ভোটে অংশগ্রহণের হার বেশি।
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনে একশ্রেণির ভোটারের কেন্দ্রবিমুখতার বিদ্যমান অবস্থা ভবিষ্যতে তা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। ভারতেও একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে কম আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, কম বিত্ত ও নি¤œবর্গের মানুষের ভোটে অংশগ্রহণের হার বেশি। বাংলাদেশের বিশেষ অবস্থার কথা বাদ দিলেও সাধারণভাবে অনুপস্থিত ভোটারদের ভোটদান নিশ্চিত করার জন্য পোস্টাল ব্যালটের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশেও সীমিতভাবে ডাকযোগে ভোটদানের আইন আছে (অনুচ্ছেদ ২৭, জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২, যা ২০১৯ সালে সংশোধিত, অনুচ্ছেদ ৮ (৩) ও (৫), ভোটার তালিকা আইন ২০০৯, যা ২০১৯ সালে সংশোধিত)। সশস্ত্র বাহিনী, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্য কর্মীদের জন্য এ অধিকার সংরক্ষণ করা হলেও পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না, তাই বাস্তবচর্চা খুবই সীমিত।
পোস্টাল ব্যালটের প্রয়োজনীয়তা: বাংলাদেশে পোস্টাল ব্যালট ভোটে অংশগ্রহণ বৃদ্ধির একটি অতি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে। কেন্দ্র দখল, বুথ দখল, কেন্দ্রভিত্তিক নানামুখী সন্ত্রাস সমাজের শান্তিপ্রিয় ও নিরীহ মানুষগুলোকে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে উৎসাহিত করে না। ভোটকেন্দ্রে আসার ঝুঁকিমুক্ত একটি বিকল্প দিলে তাঁরা নিঃসন্দেহে সেটি লুফে নেবে। তা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি চাকরির কারণে দূরবর্তী কর্মস্থলে অবস্থান, অসুস্থতা, শারীরিক অক্ষমতা ইত্যাদি কারণে যাঁরা ভোটকেন্দ্রে আসতে অপারগ, তাঁদের জন্য পোস্টাল ব্যালট একটি অধিকারের পর্যায়ভুক্ত। আমার পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব একটি ত্রুটিমুক্ত পোস্টাল ব্যালট–ব্যবস্থা চালু করা গেলে অন্তত ৩০ শতাংশ প্রকৃত ভোটারের ভোটে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে।
কীভাবে পোস্টাল ব্যালট চালু করা যায়: আইনগতভাবে আইনের সংশ্লিষ্ট অংশ (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এবং ভোটার তালিকা অধ্যাদেশ ২০০৯) সংশোধন করে সীমিত অংশগ্রহণের বর্তমান বিধান রহিত করে এ পদ্ধতি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলে আইনগত প্রতিবন্ধকতা দূর হয়। এতে কমিশনের কিছু ব্যয় ও ব্যবস্থাপনাগত দায়িত্ব বাড়বে। আবার অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলাসহ অন্যান্য ব্যয় সাশ্রয় হবে।
নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলে নির্বাচনের অন্তত দুই মাস আগে থেকে পরিকল্পিতভাবে পোস্টাল ব্যালটের ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। নিবন্ধন, নিবন্ধিত ভোটারের এলাকাভিত্তিক তালিকা প্রকাশ, ভোটের আগে ব্যালট সরবরাহ, ভোটদানের পর ব্যালট সংগ্রহ ও গণনা—এই পাঁচটি ধাপের কাজের সুষ্ঠু নিয়মকানুন করতে হবে। মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ১ কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশি পৃথিবীর নানা দেশে কর্মরত। তা ছাড়া এ দেশের অনেক নাগরিক বিভিন্ন কারণে বিদেশে অবস্থান করেন, কিংবা দ্বৈত নাগরিক হিসেবে দেশের বাইরে থাকেন। নির্বাচনী আইন ও ব্যবস্থাপনাগত সীমাবদ্ধতায় তাঁরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না। এভাবে তাঁদের ভোটের বাইরে রাখা সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন করার শামিল। দেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকট প্রকট। এ সময়ে আমরা এনআরবি ও প্রবাসীর প্রেরিত অর্থের জন্য আহাজারি করি। কিন্তু প্রবাসীদের ভোটাধিকার সুরক্ষার ব্যাপারে উদাসীনতা ক্ষমার অযোগ্য। প্রবাসী শ্রমিক ও এনআরবিসহ বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের আমাদের দূতাবাসের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন একটি বিশেষ ব্যবস্থায় অবশ্যই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দিতে পারেন। নতুবা নির্বাচন কমিশন ভোটাধিকার ক্ষুণ্ন করে সংবিধান লঙ্ঘনের দায় মাথায় নেবেন।’