সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ। চলতি মার্চের এক সপ্তাহের মধ্যে রাজধানীসহ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও পর্যটননগরী কক্সবাজারে সংঘটিত বিভিন্ন দুর্ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না সরকারের শীর্ষমহল। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও এগুলো স্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়। তবে তাৎক্ষনিকভাবে এসব ঘটনাকে কেউ এখন পর্যন্ত নাশকতা হিসেবে দেখছেন না। তাই প্রতিটি ঘটনার পেছনে কারও কোনও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না বা কী কারণে এসব ঘটনা ঘটছে সেগুলো খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন তারা। গত শনিবার (৪ মার্চ) বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কদম রসুল এলাকায় ‘সীমা অক্সিজেন’ নামে একটি অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরও ৩০ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। প্ল্যান্টটিতে সিলিন্ডারে অক্সিজেন রিফিল করার সময় বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণের ফলে আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকার ঘরবাড়ি, দোকানপাট, কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনের কাঁচের জানালা, দরজা, টিনের ছাদ ও ঘর ভেঙে গেছে।
পরের দিন ৫ মার্চ সকালে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও নিউমার্কেট সংলগ্ন এলাকায় একটি বাণিজ্যিক ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১৪ জন। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বলেছে, ঠিক কী কারণে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তা এখনও জানা যায়নি। তবে কেউ কেউ বলছে গ্যাসের সিলিন্ডার বা এসি বিস্ফোরণে এই ঘটনা ঘটতে পারে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার প্রিয়াঙ্গন মার্কেটের পাশে একটি বাণিজ্যিক ভবনে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। একইদিন রবিবার (৫ মার্চ) দুপুরের পরে পর্যটননগরী কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ছয়টি ইউনিট দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। অগ্নিকা-ের ঘটনায় উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে দুই হাজারের বেশি ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে বেশকিছু দোকানপাটও রয়েছে।
এ ঘটনার একদিন পরে (৭ মার্চ) মঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে ক্যাফে কুইন ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ১৯ জন মারা গেছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও দেড় শতাধিক ব্যক্তি। চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২০ জন, কয়েজন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিস্ফোরণস্থলে কাজ করেছে ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট ও ৫টি অ্যাম্বুল্যান্স। পাশাপাশি দুটি বহুতল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি ভবন সাততলা এবং আরেকটি পাঁচতলা। এর মধ্যে সাততলা ভবনের বেজমেন্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় তলা বিধ্বস্ত হয়েছে। আর পাঁচতলা ভবনের নিচতলাও বিধ্বস্ত হয়েছে, ভবনটির দ্বিতীয় থেকে প ম তলা পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংকের কার্যালয়। বিকট শব্দে বিস্ফোরণে ভবনের ইট-পলেস্তারা, কাঠের টুকরো বহু দূর পর্যন্ত ছিটকে পড়ে। এতে অনেকে আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।
এদিকে গত কয়েকদিনে সংঘটিত এসব দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, মেয়রসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। গত কয়েকদিনে ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত এসব দুর্ঘটনায় তারা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন— এসব ঘটনার কোনটাই স্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়। এসব অগ্নিকা- ও বিস্ফোরণের ঘটনাগুলোর কোনও কারণ বলতে না পারলেও এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন তারা।
একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার গোলাম ফারুক ও এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র্যাব) বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান মেজর মশিউর রহমান। তিনি সিদ্দিকবাজারে মঙ্গলবার বিকালের বিস্ফোরণ স্বাভাবিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন।
এসব ঘটনার পর বুধবার (৮ মার্চ) সকালে সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এটা দুর্ঘটনা অথবা নাশকতা কি না — সেটা সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই নিয়ে কারও মাথাব্যথার প্রয়োজন নাই। গুলিস্তান, সীতাকু- ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগের যে ঘটনা ঘটেছে, তা বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে ঘটিয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী যখন দেশের কাজে বাইরে, ঠিক সেই সময় দেশে কয়েকটি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে গেছে। সিদ্দিকবাজারে ভবনে বিস্ফোরণ, চট্টগ্রামের সীতাকু-ে অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনে বিএনপির কোনও সম্পৃক্ত আছে কি না, তা সরকার খতিয়ে দেখছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, কী কারণে ঘটনা ঘটেছে তা তদন্তের পর জানা যাবে। বিস্ফোরণের কারণ জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে পারবো কেন এই বিস্ফোরণ ঘটেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণগুলোর কারণ খুঁজতে আপাতত বিদেশি কোনও বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই। মন্ত্রী বলেন, ফায়ার সার্ভিস এবং বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটসহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি ঢাকা ও চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিস্ফোরণের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত তৈরি করতে সক্ষম। এর জন্য বিদেশি কারও সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। এদিকে রাজধানীতে সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন শেষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমরা অনেকগুলো প্রাণ হারিয়েছি। এটি একটি মর্মান্তিক ঘটনা। এ ঘটনার যাতে কোনও পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
তিনি জানিয়েছেন, আমরা ধ্বংসস্তূপ পর্যবেক্ষণ করেছি। কী কারণে এমন ঘটনা ঘটলো, এটা তদন্ত করে বের করা দরকার। এটি কোনও স্বাভাবিক কেমিক্যাল বিস্ফোরণের ঘটনা নাকি অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড, সেটা তদন্তের প্রয়োজন আছে। এখানে অবশ্যই নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজন আছে। তবে এখানে যারা বিশেষজ্ঞ আছে, তারাই তদন্ত করে বের করবে আসল ঘটনা কী। রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে ভবন বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস জানিয়েছেন, যে কোনও দুর্ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। বিশেষত এ ধরনের দুর্ঘটনা যখন বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়, তখন তা সত্যিকার অর্থেই মেনে নেওয়া কষ্টকর। দুর্ঘটনা পরবর্তী উদ্ধার কাজে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সহযোগিতা করছে। এ বিষয়ে আমরা সজাগ রয়েছি। ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছে।
ডিএমপি কমিশনার কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক জানিয়েছেন, অনেক সময় মিথেন গ্যাস, এসির গ্যাস বা পয়োঃগ্যাস জমে এমন বিস্ফোরণ হতে পারে। এখন এটা নাশকতা না দুর্ঘটনা, তা আমাদের দায়িত্বরত বিশেষজ্ঞ দল তদন্ত শেষ করে বিস্তারিত বলতে পারবেন। সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণ স্বাভাবিক নয় বলে বুধবার দুপুরে মন্তব্য করেছেন র্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান মেজর মশিউর রহমান। তিনি জানিয়েছেন, আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি ভবনের বিস্ফোরণ বেজমেন্ট থেকে হয়েছে। এটা স্বাভাবিক কোনও বিস্ফোরণ নয়। গ্যাস জমে কিংবা অন্য কোনোভাবে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এ ঘটনা এসি থেকে ঘটেনি, এটা নিশ্চিত হয়েছি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিস্ফোরণে হতাহতদের দেখতে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, এটা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। অনেক জানমালের ক্ষতি হয়েছে। বড় বড় ভবনের ছাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটার তদন্ত করে বিস্তারিত জানা যাবে। আমাদের এ ধরনের ঘটনা রোধ করতে সতর্কাবস্থায় থাকতে হবে। এসি থেকে হয়ে থাকলে নজরে রাখতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম জানিয়েছেন, দেশে পরপর কয়েকটি বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের মতো ঘটনার পেছনে ভিন্ন কোনও কারণ আছে কিনা চিন্তা করছে সরকার। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকার সবকিছু করছে। এসব ঘটনা দুর্ঘটনা কি না সে বিষয় খতিয়ে দেখা হবে। আর আমাদের দলের পক্ষ থেকে ও সরকারের পক্ষ থেকে দেখা হচ্ছে এখানে কোনও দুর্বলতা ছিল কি না দায়িত্বরতদের।