দেশে চা রফতানির গৌরব ফিকে হয়ে আসছে। প্রতি বছর উৎপাদন বাড়লেও রফতানির পরিমাণ বাড়ছে না। উৎপাদন বৃদ্ধির চেয়ে অভ্যন্তরীণ ভোগ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশে বার্ষিক চায়ের চাহিদা প্রায় নয় কোটি কেজির মতো। উৎপাদন হচ্ছে চাহিদার চেয়ে কিছুটা বেশি। প্রতি বছর ৪ শতাংশ হারে চাহিদা বেড়ে গেলেও উৎপাদন বৃদ্ধির হার চাহিদার তুলনায় শ্লথ। যার কারণে এক সময় বার্ষিক দেড় কোটি কেজি চা রফতানি করা বাংলাদেশের বার্ষিক চা রফতানি ছয় লাখ কেজিতে নেমে এসেছে।
চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০০১-০২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চা রফতানি হয়েছিল ১ কোটি ৩৮ লাখ ২ হাজার কেজি। পরবর্তী সময়ে ২০০৪-০৫ অর্থবছর পর্যন্ত চা রফতানির এ ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু এরপর থেকে দেশে চায়ের চাহিদা বৃদ্ধি ছাড়াও ধারাবাহিকভাবে উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ায় রফতানি প্রক্রিয়ার গতি কমে যায়। এক পর্যায়ে রফতানি কমতে কমতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ লাখ ৭৬ হাজার কেজিতে নেমে আসে। পরবর্তী বছরগুলোতে চা রফতানি বাংলাদেশের হারানো গৌরব আর ফেরত আসেনি। সর্বশেষ অর্থবছর ও চলতি অর্থবছরেও চা রফতানি তলানিতে পড়ে আছে।
তথ্যমতে, ২০২০-২১ মৌসুমে দীর্ঘদিন পর চা রফতানির পরিমাণ কিছুটা বেড়ে ১২ লাখ ৪৩ হাজার কেজিতে উন্নীত হলেও সর্বশেষ অর্থবছরে (২০২১-২২) বাংলাদেশ থেকে চা রফতানি হয়েছে মাত্র ৬ লাখ ৩৯ হাজার কেজি। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে রফতানি হয়েছে ৬ লাখ ৩৬ হাজার কেজি। অর্থবছরের শেষে রফতানি কিছুটা বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও সেটি আশানুরূপ নয় বলে মনে করছেন চা খাতসংশ্লিষ্টরা। তবে দেশীয় চা উৎপাদনকে ২০২৫ সালের মধ্যে ১৫ কোটিতে উন্নীত করতে চায় বাংলাদেশ চা বোর্ড। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারেনি। সর্বশেষ বছর দেশে ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও উৎপাদন ৯ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার কেজিতে সীমাবদ্ধ ছিল। চলতি বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ কোটি ২০ লাখ কেজি।
চা বোর্ড বলছে, দেশে চায়ের বার্ষিক ভোগ ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ভোগ ছিল সাড়ে আট কোটি কেজি। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে ভোগের পরিমাণ বেড়ে নয় কোটি কেজি ছাড়িয়ে যায়। সর্বশেষ সাত মাসে দেশে চায়ের ভোগ্যতা ছিল ৬ কোটি ৬৩ লাখ ৮১ হাজার কেজি। এ হিসাবে অর্থবছরের শেষে চায়ের বার্ষিক ভোগ ১১ কেজি ছাড়িয়ে যাবে। ফলে চলতি বছর চা উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তার থেকে ভোগের পরিমাণ বেশি থাকবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ম্যাগনোলিয়া ব্র্যান্ডের চা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো না গেলে চা রফতানির পরিমাণ কোনোভাবেই বাড়ানো যাবে না। বাংলাদেশের চায়ের বিশ্ববাজারে চাহিদা থাকলেও শুধু উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ার কারণে রফতানি হচ্ছে না। চা বোর্ড বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে চা উৎপাদন বৃদ্ধি ও রফতানি বাড়ানোর প্রতি মনোযোগী হয়েছে। তবে রফতানির হারানো গৌরব ফিরে পেতে উদ্বৃত্ত চা উৎপাদনের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন তিনি। চা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন চা বোর্ড উৎপাদনের যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সেটি বাস্তবায়ন হলে আগামী এক দশকের মধ্যে চা রফতানির পুরনো গৌরব ফিরে পাবে বলে মনে করছেন তারা।’
চা বোর্ডের সদস্য (অর্থ ও বাণিজ্য) মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী বলেন, ‘এক সময় দেশের চায়ের ভোক্তা ছিল খুবই কম। যার কারণে উদ্বৃত্ত চা আমরা বহির্বিশ্বে রফতানি করেছি। এমনকি সাত-আট বছর আগে দেশে বার্ষিক দেড় থেকে দুই কোটি কেজি চা আমদানি হতো। বর্তমানে উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি কমিয়ে আনতেও সক্ষম হয়েছি। উৎপাদন বাড়ানো ছাড়াও চায়ের বহুমুখী উৎপাদনের মাধ্যমে বিশেষায়িত চা রফতানি বাড়ানো হবে। ট্র্যাডিশনাল চা বিশ্ববাজারে চাহিদা কম থাকায় গ্রিন টি কিংবা চীনের মতো বিভিন্ন ফ্লেবারের চায়ের বাজার তৈরির ইচ্ছা রয়েছে চা বোর্ডের।’- বণিক বার্তা