ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিফ নজরুল তার ফেসবুক পেজে সম্প্রতি লিখেছেন,
আমি প্রথম তবলীগে যাই ১৯৯৮ সালে। তখন লন্ডনে ছিলাম। পিএইচডির দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ অবস্থা আমার। পিএইচডি না হলে দেশে ফিরবো না কখনো – এটা ভেবে কান্না আসতো। আত্মহত্যা করবো কিনা এমনকি এই চিন্তাও আসতো মাথায়। এমন ছিন্ন ভিন্ন মানসিক অবস্থায় আমার প্রতিবেশী হয়ে আসেন আমার একজন কলিগ। তিনি আইন বিভাগে আমার সিনিয়র শিক্ষক লিয়াকত আলী সিদ্দিকী। ছাত্রজীবনে এক সময় বিতার্কিত হিসেবে নাম করেছিলেন। প্রথম দিকে পড়তেন জিনস, টি-শার্ট আর কেডস। অল্প দিন পর থেকে পুরো ইসলামী পোষাক।
তিনি আমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। প্রায় প্রতিদিন ডেকে খাওয়াতে নিয়ে যেতেন, পড়াশোনা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে মানা করতেন। তিনি নিজে এলএসসিতে মাস্টর্স চূড়ান্ত করার একমাস আগে দীর্ঘদিনের জন্য তবলীগে চলে গিয়েছিলেন, ডিগ্রিটা শেষ করেছিলেন ছয় বছর পর। এ দুনিয়ার সাফল্য, খ্যাতি, অর্জন সত্যি তুচ্ছ তার কাছে। কাজেই তিনি এসব বললে মন দিয়ে শুনতাম। কিছুদিন পর জানা গেল তিনি আবার তবলীগে যাচ্ছেন লীডস্-এ। আমিও যেতে রাজি হলাম। চার দিনের পড়া শিকেয় তুলে রাখার এই সাহস কিভাবে পেলাম জানি না। ফোনে স্বজনদের জানিয়ে দিলাম কোন যোগাযোগও করতে পারবো না কয়েকদিন। মক্কার হজযাত্রীদের মতো পবিত্র মনে রওনা দিলাম লীডসের পথে। বাসে সবাই দোয়া দরুদ পড়ছে, আমিও যোগ দিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি বিভিন্ন দেশের ছাত্রদের মেলা। কাউকে চিনি না, কিন্তু কয়েক মূহূর্তে এমন আপন হয়ে গেল সবাই। চোখা চোখি হলে হাসি, সালাম, খাবার নিতে গেলে এ ওকে ঠেলে দেয় আগে, কোন একটা সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে থাকে সবাই। দিনরাত গোল হয়ে বসি। একজনের পর একজন সুরা পড়ি। কেউ কেউ ধর্মের বয়ান দেন। দোযখ-বেহেস্ত না, সেখানে শুধু ভালো, নিঃস্বার্থ আর সৎ হওয়ার শান্ত আহ্বান। তাড়া নেই, অপেক্ষা নেই, চিন্তা নেই- আশ্চর্য এক প্রশান্তিময় সময়। ঘুমাতে গেলে ঘুম আসে, গভীর ঘুম অনায়াসে ভাঙে আজানের শব্দে। যেটা খাই অমৃতের মতো লাগে, যতোটুকু খাই মন ভরে থাকে। বুকের ভেতর আচড় নেই, নেই দাহ, হাহাকার! কিসের পিএইচডি, কিসের ঘর-সংসার। মনে হলো যাবো না এ জায়গা ছেড়ে কোন দিন আর।
আমার জীবনে তীব্রতম, অবিশ্বাস্য, দুঃসাহসী আর অপার আনন্দের বহু স্মৃতি আছে। কিন্তু সবচেয়ে প্রশান্তিতম দিন কেটেছে লীডস্-এর মসজিদে। যে সৃষ্টিকর্তাকে আমি ছোটবেলা থেকে খুঁজি গাছের নবীণ পাতা, আকাশের অবিরাম বদলে যাওয়া আর দুর নক্ষত্রের নিশ্চল আলোয়, কিংবা মাঝরাতে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ঘোর লাগা বর্ষণে, লীডস্-এ আমি তাকে অতি সামান্য হলেও অনুভব করতে পেরেছিলাম। যে শান্তি আমি পেয়েছি সেই চারদিন তা আর পাইনি আগে পরে কখনো। জীবনের সব দায় শোধ হলে আমি একদিন আবার চলে যাবে তার খোঁজে। অনন্তকালের জন্য। জানি না তিনি আমাকে সে সুযোগ দিবেন কিনা।