মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:০২ অপরাহ্ন

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নায়েক আব্দুল মান্নান এর দুঃসাহসিক ঘটনার বর্ণনা

ভৈরব (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩
সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার (অবঃ) আব্দুল মান্নান

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন দেশের অনেক মুক্তিযোদ্ধাই দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অনেকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন, অনেকে আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেও বীরের মর্যাদায় বেঁচে আছেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তার দুঃসাহসিক এবং কিছু ঘটনা জানতে সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম ভৈরবের কৃতি সন্তান ভৈরবপুর গ্রামের সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার (অবঃ) আব্দুল মান্নান এর। তিনি ১৯৪৭ সালের ৭ই মার্চ কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৃত আব্দুল কাদের মিয়া। বাল্যকাল থেকেই তিনি স্বাধীনচেতা, সাহসী ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। ১৯৬৪ সালের ৭ই মার্চ তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি যুদ্ধ চলাকালীন সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক হয়ে নায়েক পদে নিয়োজিত ছিলেন। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আলফা কোম্পানীর তৎকালীন অধিনায়ক মেজর নাসিম এর সহকারী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ভারতে মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ হেড কোয়ার্টারে অস্ত্র, গোলাবারুদ, বস্ত্র সরবরাহসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায?িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি মেজর নাসিম ও ডাঃ কামাল সাহেব এবং আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্যে ভারতের আগরতলা হাসপাতালে নিয়ে যান। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ৩১ আগস্ট মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আলফা কোম্পানীর অধীনে আশুগঞ্জের মাধবপুর মনতলা, কাতলামারা, ভারতের পঞ্চবটিতে বিভিন্ন অর্গানাইজেশনে এবং পরবর্তীতে ১১ ইস্ট বেঙ্গলে বিশেষ দায?িত্ব পালন করেন। তৎকালীন যুদ্ধের পারিপার্শ্বিকতায় উনাকে ৩নং সেক্টরের অধীনে ১১ ইস্ট বেঙ্গলে নিয়োজিত রেখে বিশেষ দায?িত্ব অর্পন করা হয়। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, একটি সেকশনে তারা ১০জন মুক্তিযোদ্ধাসহ আখাউড়ার চান্দুরা নামক স্থানে ব্রীজ ঘাটের পাশে এম্বুস পজিশন নিয়ে অপেক্ষা কালে কভারিং ফায়ার দিয়েছিলেন। তাদের সেক্টর কমান্ডার এ.কে.এম শফিউল্লাহ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর জনৈক মেজর ছিলেন। একজন অফিসারসহ ২ জনে সিএন্ডবি রোডের পাশ দিয়ে আসছিল। তাদের একটু পিছন দিয়ে ১১ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর নাসিম ও ডাক্তার কামাল পিছনে ছিলেন। পাকসেনাদেরকে মেজর নাসিম সাহেব হ্যান্ডসআপ করান, পাকসেনাদের মধ্যে একজন মেজর নাসিম সাহেবকে কাছ থেকে গুলি করেন। ওই মূহুর্তে তেলিয়াপাড়া অথবা মাধবপুর হতে একটি খোলা ট্রাকে করে ২০/২৫ জন পাকসেনা সামনের দিকে আসছিল। ট্রাকটি দেখে মেজর নাসিম বলেন, স্যার তেলিয়াপাড়া অ্যাকসেসটা বোধহয় আমাদের আওতায় এসে গেছে। ট্রাকটির বর্ণ ১১ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রাকের মত মনে করে কিন্তু ট্রাকটি সামনা সামনি আসার পর বুঝা যায় ট্রাকটি শত্রু পক্ষের। ওই ট্রাকে চালকের আসনে পাকবাহিনীর সুবেদার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ওই ট্রাকটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসার সাথে সাথে মেজর নাসিম ট্রাকের সকল পাকসেনাদের আত্মসমর্পন করাতে সক্ষম হন । ঠিক ওই মূহুর্তে পুণরায় ট্রাকে থাকা পাক সেনারা ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। তখন নায়েক মান্নান কঠিন পরিস্থিতিতে জরুরী ভিত্তিতে বিশেষ দায?িত্বপ্রাপ্ত হয়ে একটি এম্বুস লে আউট করে এবং এম্বুস কমান্ডারের দায?িত পালন করেন। এম্বুস চলাকালীন সময়ে স্মল আর্মসের কভারিং ফায়ারের মাধ্যমে এম্বুস পরিচালনা করেন। ওই মূহুর্তে মেজর নাসিম সাহেবের ডান পায়ের উরুতে ও ডান হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এসময় ডাঃ কামালও আহত হন। এ জটিল অবস্থায় সেক্টর কমান্ডার সফিউল্লাহ সাহেব সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন। সফি উল্লাহর সাথে একজন মিত্র বাহিনীর ভারতীয় অফিসার ছিলেন। পাকবাহিনীর সুবেদার ও সফিউল্লাহ সাহেব এর বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে তুমুল ধস্তাধস্তি শুরু হয় এবং অনেকে আহত হয়। পাক বাহিনীর হঠাৎ ছোড়া গুলি লাগে লে. কর্নেল কে. এম. সফিউল্লাহ’র কোমরে রক্ষিত পিস্তলে। ভাগ্যক্রমে পিস্তলে গুলি লাগায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ঘটনার সাক্ষী সেই পিস্তলটি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট সমর যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। তিনি বলেন, তার জানা মতে মেজর নাসিম সাহেব, ডাঃ কামাল সাহেব, নায়েক মস্তোফা, নায়েক আজাদ, মর্তুজাসহ নাম না জানা অনেকে আহত হয়েছিলেন। তখন সেক্টর কমান্ডার সফি উল্লাহ আহতদের চিকিৎসার জন্য ট্রাক ড্রাইভার ট্রাক ড্রাইভার বলে উচ্চস্বরে চিৎকার করতে থাকে ওই মূহুর্তে নায়েক মান্নান উপস্থিত হয়ে বলতে থাকেন আমি ট্রাক ড্রাইভার স্যার । সেক্টর কমান্ডার সফি উল্লাহ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ট্রাকে উঠানোর নির্দেশ দিলে তিনি আহতদের ট্রাকে করে আখাউড়ার চান্দুরার দিকে রওনা দেন। চান্দুরা দিয়ে ভারতে যাবার পথে চান্দুরা গ্রামবাসী এবং তাদের কমান্ডার রুস্তম আলী কে বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেন। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে আহত মেজর নাসিম সাহেব কে নিয়ে মহেশপুরে পৌঁছালে ভারতীয় এম্বুলেন্সের মাধ্যমে জরুরী চিকিৎসার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিকট হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশ এবং ভারতীয় যৌথবাহিনীর মাধ্যমে সকল যুদ্ধাহতদের গুহাটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। গুহাটিতে মেজর নাসিম তাকে বলেন, মান্নান তুমি পাশে থেকো এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী নায়েক মান্নানকে নাসিম সাহেবের সাথে রাখতে অনুরোধ করেন। গুহাটিতে ৭/৮ দিন চিকিৎসার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের লাখনৌ কমান্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি নাসিম সাহেবের পাশে থেকে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। হাসপাতালে অবস্থান কালে সর্বাধীনায়ক কর্নেল উসমানী সাহেবের সাথে তার দেখা হয়। তিনি তার কাছে থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে উনাকে অবগত করেন। কমান্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জরুরী ভিত্তিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে এক কনফারেন্সের আয়োজন করে। কনফারেন্সে কর্নেল উসমানী সাহেব, তৎকালীন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জগজীবন রাম, এঃ লেঃ জেঃ মানিক সাহা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরাগান্ধী উপস্থিত ছিলেন। কনফারেন্সে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। পরবর্তিতে নাসিম সাহেবের মা বাবা তার নিকট উপস্থিত হলে তাদের পাশে কিছুদিন থাকার পর তিনি ১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মস্থলে যোগদানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে রওনা হন। পরবর্তীতে তিনি সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার থাকাবস্থায় ০৬ জুলাই ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
সাক্ষাতকার গ্রহণে:আবদুর রউফ




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com