আমেরিকা চাইলে যেকোনও দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে সরকারপ্রধান বলেছেন, তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, আবার দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়েই তারা ওকালতি করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এখানে এমন একটা সরকার আনতে চাচ্ছে তার গণতান্ত্রিক কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। অগণতান্ত্রিক ধারা। আর সেই ক্ষেত্রে আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবী, সামান্য কিছু পয়সার লোভে এদের তাবেদারি করে। পদলেহন করে।’
গতকাল সোমবার (১০ এপ্রিল) জাতীয় সংসদে সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আনা ১৪৭ বিধির সাধারণ প্রস্তাব ও অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সংসদনেতা তার বক্তব্যের বড় অংশ নিয়ে বাংলাদেশের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফেরত না দেওয়াসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। কথা বলেন সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধনী প্রস্তাবের দাবি, জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোতে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি খবর নিয়েও।
একইসঙ্গে ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়ন’ প্রসঙ্গ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা খুবেই বিচিত্র। আমরা আইয়ুব আমল দেখেছি। ইয়াহিয়া আমল দেখেছি। জিয়ার আমল দেখেছি। জেনারেল এরশাদের আমল দেখেছি। খালেদা জিয়ার আমলও দেখেছি।’ এ সময় যুক্তরাষ্ট্র সফরে একটি বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমেরিকায় যখন প্রথমবার যাই, সেখানকার আন্ডার সেক্রেটারির সঙ্গে আমার মিটিং হয়েছিল। বলেছিলাম, আমি একটি মনুমেন্ট দেখে এসেছি। সেখানে লেখা আছে— গবর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল। আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি, সেদেশটি হচ্ছে গবর্নমেন্ট অব দ্য আর্মি, বাই দ্য আর্মি, ফর দ্য জেনারেল। বলেছিলাম, আমেরিকা গণতন্ত্র চর্চা করে তাদের আটলান্টিকের পাড় পর্যন্ত। এটা যখন পার হয়ে যায়, তখন কি আপনাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটা বদলে যায়? কেন আপনারা একটা মিলিটারি ডিকটেরকে সমর্থন দিচ্ছেন? আমি এই প্রশ্নটি করেছিলাম।’
আমেরিকার কথায় কিছু লোক উঠবস করছেন
বিভিন্ন দেশের বিষয়ে বর্তমানে মার্কিন অবস্থানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকেও আমি বলি, যে দেশটা আমাদের কথায় কথায় গণতন্ত্রের ছবক দেয়। আর আমাদের বিরোধী দল থেকে শুরু করে কিছু কিছু লোক তাদের কথায় খুব নাচন-কোদন করছেন, উঠবস করছেন, উৎফুল্ল হচ্ছেন। হ্যাঁ, তারা যেকোনও দেশের ক্ষমতা ওল্টাতে পারেন, পাল্টাতে পারেন। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো তো আরও বেশি কঠিন অবস্থার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। আরব স্প্রিং (আরব বসন্ত), ডেমোক্রেসি সব বলে বলে যেসব ঘটনা ঘটাতে ঘটাতে— এখন নিজেরা নিজেদের মধ্যে একটা প্যাঁচে পড়ে গেছে। যতদিন ইসলামিক কান্ট্রিগুলোর ওপর চলছিল, ততদিন কিছু হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে এখন সারা বিশ্বই আজকে অর্থনতিক মন্দার কবলে পড়ে গেছে। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘তারা আমাদেরকে এখন গণতন্ত্রের জ্ঞান দিচ্ছে। কথায় কথায় ডেমোক্রেসি আর হিউম্যান রাইটসের কথা বলছে। তাদের দেশের অবস্থাটা কী? কয়েকদিন আগের কথা, আমেরিকার টেনেসিস রাজ্যে তিন জন কংগ্রেস ম্যান— এই তিন জনের অপরাধ হচ্ছে, তারা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য আবেদন করেছিল। তারা ডেমোনেস্ট্রেশন দিয়েছিল যে, এভাবে যার তার হাতে অস্ত্র থাকা, আর এভাবে গুলি করে শিশুহত্যা বন্ধ করতে হবে। এটাই ছিল তাদের অপরাধ। আর এই অপরাধে দুই জনকে কংগ্রেস থেকে এক্সপেলড করা হয়। জাস্টিস জন ও জাস্টিস পিয়ারসন। একজন সাদা চামড়া ছিল বলে বেঁচে যান। তাদের অপরাধ হলো— তারা কালো চামড়া। সেই কারণে তাদের সিট আনসিট হয়ে যায়। তো এখানে মানবাধিকার কোথায়? এখানে গণতন্ত্র কোথায়? এটা আমরা প্রশ্ন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমেরিকায় প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায়, অস্ত্র নিয়ে স্কুলে ঢুকে যায়। বাচ্চাদের গুলি করে হত্যা করছে। শিক্ষকদের হত্যা করছে। শপিং মলে ঢুকে যাচ্ছে। হত্যা করছে। ক্লবে যাচ্ছে সেখানে হত্যা করছে। এটা প্রতিনিয়ত, প্রতি দিনেরই ব্যাপার। কোনও না কোনও রাজ্যে অনবরত এই ঘটনা ঘটছে।’
আমেরিকা খুনিদের লালন-পালন করেই রেখে দিচ্ছে
সরকারপ্রধান বলেন, ‘১৫ আগস্টে যারা হত্যা করেছে, সেই খুনি রাশেদ (রাশেদ চৌধুরী) আমেরিকায় আশ্রয় নিয়ে আছে। সেখানে যতটা প্রেসিডেন্ট এসেছে, সবার কাছে আমি আবেদন করেছি। আইনগতভাবে আমরা প্রচেষ্টা চালিয়েছি। আমরা ডিপলোমেসির মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়েছি। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছি যে, এই খুনি সাজাপ্রাপ্ত আসামি, তাকে আপনারা আশ্রয় দেবেন না। শিশু হত্যাকারী, নারী হত্যাকারী, রাষ্ট্রপতির হত্যাকারী, মন্ত্রীর হত্যাকারী। এটা মানবতা লঙ্ঘনকারী। এদেরকে আপনারা আশ্রয় দিয়েন না। ফেরত দেন। কই তারা তো তাকে ফেরত দিচ্ছে না। খুনিদের লালন-পালন করেই রেখে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে। এখন দেখা যায়— দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়েই তারা ওকালতি করে যাচ্ছে। আর গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এখানে এমন একটা সরকার আনতে চাচ্ছে— যার গণতান্ত্রিক কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। অগণতান্ত্রিক ধারা। আর সেই ক্ষেত্রে আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবী, বুদ্ধি বেচে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। সামান্য কিছু পয়সার লোভে এদের তাবেদারি করে। পদলেহন করে।’
৭০ অনুচ্ছেদ সরকারকে স্থিতিশীলতা দেয়
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সোমবার সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সরকার ও দেশের উন্নয়নে স্থিতিশীলতা দেয়া সত্ত্বেও কতিপয় সংসদ সদস্য অনুচ্ছেদটির বিরোধিতা করায় তিনি তাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘অনুচ্ছেদ ৭০ গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয় ও জনগণের কাছে গণতন্ত্রের সুফল পৌঁছে দেয়ার জন্য এটিকে আরও শক্তিশালী করে। কিন্তু, আমাদের (সংসদ) সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন এই অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে। কারণ, এই অনুচ্ছেদের জন্য তারা ইচ্ছেমতো সরকার ভাঙা-গড়ার খেলা খেলতে পারছেন না।’ স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে একাদশ জাতীয় সংসদের ২২তম (বিশেষ) অধিবেশনে সমাপনী ভাষণ প্রদানকালে তিনি একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধানত সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিংয়ের কারণে ১৯৪৬ এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সরকারগুলোকে উৎখাত করার কথা উল্লেখ করে, তাদের অনভিজ্ঞতার কারণে কয়েকজন সংসদ সদস্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। যারা এটা করছেন তাদের অভিজ্ঞতার অভাব থাকতে পারে। ৭০ অনুচ্ছেদ আমাদের দেশে সরকারকে স্থিতিশীলতার সুযোগ দিয়েছে- যে কারণে দেশ উন্নয়নের সাক্ষী হয়েছে।’ বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের তার বক্তৃতায় সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের কথা বলেন। এর আগে সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ ধারায় প্রধানমন্ত্রীর ৭ এপ্রিল গৃহীত একটি রেজুলেশনের ভিত্তিতে সংসদে বিশেষ আলোচনা হয়। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সংসদে দেশের অর্জন তুলে ধরে স্মারক ভাষণ দেন। সংসদে আরও বক্তব্য দেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী ও বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের।
নাম প্রথম আলো, বাস করে অন্ধকারে
স্বাধীনতা দিবসের দিন দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি খবরের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘মাত্র একটা ছোট্ট শিশুর হাতে ১০টা টাকা দিয়ে একটা মিথ্যা বলানো। শিশুর মুখ থেকে কিছু কথা বলানো, কী কথা! ভাত-মাছ-মাংসের স্বাধীনতা চাই। একটা সাত বছরের শিশু। তার হাতে ১০টা টাকা তুলে দেওয়া এবং তার কথা রেকর্ড করে সেটা প্রচার করে স্বনামধন্য এক পত্রিকা খুবই পপুলার, নাম তার প্রথম আলো। কিন্তু বাস করে অন্ধকারে। প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু। প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু। প্রথম আলো দেশের মানুষের শত্রু (এ সময়ে সংসদে ‘সেম সেম’ শব্দ শোনা যায়)। আমি এটা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলি যে, এরা এই দেশে কখনোই স্থিতিশীলতা থাকতে দিতে চায় না।’’
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও ড.ইউনুস প্রসঙ্গ
ওয়ান-ইলেভেনে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ভূমিকার সমালোচনার করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০৭ সালে যখন ইমারজেন্সি হয়, তখন তারা উৎফুল্ল। দুটি পত্রিকা আদাজল খেয়ে নেমে গেলো। বাহবা কুড়ালো। আর তার সঙ্গে আছে একজন সুদখোর, বড়ই প্রিয় আমেরকার। আমেরিকা একবারও জিজ্ঞাস করে না যে, একটা ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংক, এটা তো একটা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। সরকারের বেতন তুলতো যে এমডি, সে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কোথা থেকে পেলো যে, আমেরিকার মতো জায়গায় সামাজিক ব্যবসা করে, বিনিয়োগ করে দেশে-বিদেশে। এই অর্থ কোথা থেকে আসে? এটা কি জিজ্ঞাসা করেছে কখনও তারা? জিজ্ঞাস করেনি। এদের কাছ থেকে দুর্নীতির কথা শুনতে হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ। এদের কাছ থেকে মানবাধিকারের কথা শুনতে হয়। যারা গরিবের রক্তচোষা টাকা পাচার করে বিদেশে বিনিয়োগ করে নিজেরা শতকোটি টাকা মালিক হয়, আবার আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়ে যায়। এ সব লোক এ দেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। আওয়ামী লীগ সরকার এসে কিছুই নাকি দেয়নি। দেশ নাকি ধ্বংস হয়ে গেছে।’
নি¤œ আয়, মধ্যম আয় সবার দিকে দৃষ্টি আছে
আওয়ামী লীগ কী করেছে, আর তার আগে কী ছিল— তার কয়েকটি হিসাব তুলে ধরতে চাই, আমি বিশ্বাস করি, দেশের মানুষও বিশ্বাস করে, ১৪ বছর একটানা ক্ষমতায় আছি বলেই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পেরেছি। হ্যাঁ, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তারপরও আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধি করে, দেশের মানুষেরর জন্য অতিরিক্ত দামে জিনিস কিনে এনেও আমরা খাদ্য নিরাপত্তা দিয়ে যচ্ছি। নিম্ন আয়, মধ্যম আয় সবার দিকে আমাদের দৃষ্টি আছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি— মানুষের ভাগ্য গড়তে। এখন গ্রাম আর শহরের পার্থক্য কমে গেছে। শহরের মাঝখানে আরেকটা শহর গড়ে উঠছে। প্রত্যেকটি গ্রামে আমরা নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দিচ্ছি।’
বিএনপি এত বড় দল কোত্থেকে হয়ে গেলো
বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা বলছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে তো কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। যে বিরোধী দলকে বড় বিরোধী দল বলা হয়, তারা ২০০৮ সালে ২৯টি সিট পেয়েছিল। তারা যদি এত বড়ই বিরোধী দল হয়ে থাকে, তাহলে ২৯টি সিট পেলো কেন? তারা এতবড় দল কোত্থেকে হয়ে গেলো। আর সাজাপ্রাপ্ত আসামি হচ্ছে সেই দলের চেয়ারপারসন। হত্যা-গুম-খুন-দুর্নীতি-জঙ্গিবাদ-সবকিছুতেই যারা পারদর্শী ছিল। তাদের জন্য দেশের মানুষ আতঙ্কে থাকতো। এখন তাদেরকে নিয়ে এত উৎফুল্লতা শুরু করছে। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য।’
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশের ইতিহাস বিকৃতি করা হয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস যেমনভাবে বিতর্কিত করা হয়েছিল, দেশের অনেক প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধ ও লাখো শহীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস বদলানো হয়েছিল। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনি। আজকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই উন্নয়নটা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া যারা সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছে, তারা দেশ ও জাতিকে কী দিতে পেরেছে? কিছুই দিতে পারেনি। নিজেদের ভাগ্য গড়তে পেরেছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে— আজকে তাদের কাছে থেকেও আমাদের গণতন্ত্রের কথা শুনতে হয়। তাদের থেকে আমাদের গণতন্ত্রের শিক্ষা নিতে হয়।’
এ সময় বিএনপি ও বর্তমান সরকারের আমলে উন্নয়নের তুলনার চিত্র তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপির আমলে ডিজিটাল-সেবা সেন্টার ছিল ৮টি, আর এখন এক হাজার ১৭৮টি। ওয়ান স্টপ সেন্টার আগে ২টি ছিল, এখন ৮ হাজার ৮২৫টি। বিএনপির আমলে সরকারি ওয়েবসাইট ছিল ৯৮টি। আর আওয়ামী লীগ আমলে ৫১ হাজার ৬৭৮টি। তিনি বলেন, ‘১৪ বছরে বাংলাদেশে বিরাট পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। এরপরও যদি কেউ উন্নয়ন না দেখে, আর সরকার কিছুই করেনি বলে, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই না। তবে যা কিছু করি, তেলা মাথায় তেল দেওয়া নয়। জনগণের জন্য করি। সাধারণ মানুষের জন্য করি, গ্রামের মানুষের জন্য করি। দেশের মানুষ ভালো আছে, এটা সব থেকে বড় কথা।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমান পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এটাই আমাদের কথা। যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেছিলাম, অনেকই নাক ছিটকিয়েছিল। বলেছিল, এটা আবার কী ডিজিটাল বাংলাদেশ। এখন সে ডিজিটাল ব্যবস্থা ব্যবহার করে আমাদের বিরুদ্ধে নানা রকম কুৎসাও রটায়। সুফল-কুফল দুইটোই আছে। মানুষ সুবিধা পাচ্ছে।’
জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর আনীত প্রস্তাব সংসদে গৃহীত: জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা আনীত প্রস্তাব (সাধারণ) আজ সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ ধারায় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা গত ৭ এপ্রিল প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাব উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তির এই মাহেন্দ্রক্ষণে সংসদের অভিমত এই যে, ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সংসদীয় গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুরূপে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন এবং আশা আকাঙ্খার সফল বাস্তবায়নে অব্যাহতভাবে কার্যকর ও সক্রিয় ভূমিকা রাখবে এবং এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র হবে সুসংহত, শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, সকলের জন্য সাম্য ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে, সংবিধানের এ অঙ্গীকারসমূহ পূরণে আমরা সকলে একযোগে কাজ করাবো, গড়ে ভুলবো আগামীর সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা- এই হোক আমাদের প্রত্যয়’।
প্রধানমন্ত্রী আনীত প্রস্তাবের ওপর আলোচনার জাতীয় সংসদের বিশেষ ও ২২তম অধিবেশনের শেষ দিনে আজ অংশ নেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, বিরোধী দলের উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও চীফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ উন্নয়নের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছাতে সর্বক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, দেশের গণতন্ত্র অব্যাহত থাকলে, উন্নয়ন টেকসই হয়। গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হলে, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। তাই সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে আমাদের গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মজবুত করতে হবে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় রাখতে দেশের সকল দল, মতের ঐকমত্য প্রয়োজন।
বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের অপর নাম, শেখ মুজিবুর রহমান’ এটি একটি কঠিন সত্য, যে সত্য বার বার অন্ধকারকে ভেদ করে বাঙালির হৃদয়ে সূর্যালোক পৌঁছে দেয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উন্নয়নে বিপুল ত্যাগ স্বীকার করায় সংসদের অভ্যুদয় এবং জাতির অস্তিত্ব একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
দেশের উন্নয়নের প্রশংসা করে উপনেতা বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছিলেন এবং তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে কৃষি ও কৃষকের সাফল্য আজ দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখছে। যার কারণে হেনরী কিসিঞ্জাররা বাংলাদেশকে আর ‘বটম লেস বাস্কেট’ বলতে পারে না।
বিএনপির ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে উপনেতা বলেন, রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও অভিযোগ থাকতে পারে, কিন্তু বিএনপি সাধারণত অনৈতিক পথ অনুসরণ করে রাজনীতিতে মিথ্যাচার করছে। এ সময় তিনি ২০০৪ সালে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা কথা উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার জাতীয় সংসদে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করেছে উল্লেখ করে চীফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী বলেন, এই সংসদে জাতির পিতার হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পাশসহ অনেক কালো আইন পাস হয়েছে। সংসদে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী, খুনি, সন্ত্রাসী, কালোবাজারিদের সদস্য করে আনা হয়েছে। সংসদের বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস করা পাশাপাশি সংসদের স্বাভাবিক কার্যপ্রণালী বিঘ্নিত করা হয়েছে। সংসদকে অকার্যকর করার সকল প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে। জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদকে কার্যকর করতে সংসদীয় কমিটিগুলোকে সক্রিয় করেছেন, সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব চালু করাসহ সংসদকে কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রকে পুনপ্রতিষ্ঠা করেছেন।
রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের কল্যাণে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। অথচ স্বাধীনতা বিরোধীরা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতাকে অবহেলা করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছে।’ সংসদ সদস্যরা বলেন, ‘বিএনপির ছত্রছায়ায় স্বাধীনতা বিরোধীরা সাংবিধানিক সরকার গঠনের প্রধান বাধা’। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদও আলোচনায় অংশ নেন।